লিখেছেন গোলাম মোর্তোজা
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে রাস্তার পাশের বাড়ি-ভবন রঙ করতে হবে। বাড়ি-ফ্ল্যাট-ভবনের অনেক মালিক সিটি করপোরেশন থেকে চিঠিও পেয়েছেন।
গণবিজ্ঞপ্তিতে সিটি করপোরেশন লিখেছে, ‘মুজিব বর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এবং বিদেশি বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশে আসবেন ও ঢাকায় অবস্থান করবেন। …শহরকে দৃষ্টিনন্দন করতে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় আলোকসজ্জা করা হচ্ছে। সে কারণে সড়কের পাশে বাড়ি/স্থাপনা, গেট ও সীমানা প্রাচীরের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও রঙ করা প্রয়োজন। এতে শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে।’
এ বছর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী, মুজিব বর্ষের ঘোষণা এসেছে আগেই। মুজিব বর্ষ পালনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে এক বছরেরও বেশি সময় আগে থেকে। যে মানুষটি সারাজীবন বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন, যার নেতৃত্বে যুদ্ধ করে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, সেই স্বাধীন দেশ তার নেতার জন্মশত বার্ষিকী অবশ্যই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পালন করবে। তা নিয়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক থাকা উচিত নয়। হয়ত নেইও, দেশে তীব্র বিভাজনের রাজনীতি সত্ত্বেও।
এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনে পৃথিবীর বহু দেশ থেকে অতিথি আসবেন। তারা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ দেখবেন। যতটা সুন্দরভাবে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা যায়, ততটা সুন্দরভাবেই উপস্থাপন করতে হবে। যাতে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র মার্কিনী অপবাদ যে অসত্য, তা প্রত্যক্ষ করতে পারেন অতিথিরা।
সেই বিবেচনায় রাস্তার পাশের বাড়ি-ভবন-দেয়াল-গেট রঙ করার প্রসঙ্গ আসতে পারে। প্রশ্ন এসেছে যেভাবে সামনে এসেছে, সেভাবে আসতে পারে কি না?
এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মো. ইমদাদুল হক বলেন, ‘আমার মনে হয় নাগরিকদেরও এ উপলক্ষে নিজেদের বাড়িঘর রঙ করা উচিত। যারা বাড়িঘর রঙ করাবেন না, তারা জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে চান না বলে মনে করব।’ (প্রথম আলো, ৪ মার্চ ২০২০)।
সিটি কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তা এভাবে কথা বলতে পারেন? মুজিব বর্ষ সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকার পাওয়া একটি কর্মসূচি। মূল আয়োজনের সপ্তাহদুয়েক আগে কেন মনে হলো, বাড়ি রঙ করতে হবে? গত এক বছর ধরে জনসাধারণের মাঝে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হলো না কেন? এখন যারা বলছেন ‘জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে চান না বলে মনে করব’- তারা এতদিন কী করছিলেন?
জনগণকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে এমন কথা একজন সরকারি কর্মকর্তা বলতে পারেন? যে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতির শতশত অভিযোগ, তারা এভাবে কথা বলতে পারেন?
তারা এও বলার চেষ্টা করছেন, আইন অনুযায়ী তারা জনগণকে বাড়ি রঙ করার কথা বলতে পারেন। হয়ত পারেন। কিন্তু সিটি করপোরেশনের যে কাজ, তা কি তারা করেন?
অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে যদি শুধু মশা প্রসঙ্গে আসি? গত ডেঙ্গুর মৌসুমে সিটি করপোরেশন পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে। শীত মৌসুমে প্রকৃতিগত কারণে মশা কমেছিল। আবার গরমের শুরুতেই ঢাকায় মশার উপদ্রব আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এখনও পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের মশা মারার কোনও তৎপরতা দৃশ্যমান হয়নি? অথচ বিশেষজ্ঞ মতামত ছিল, এ বছর ডেঙ্গু ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে।
বাড়ি রঙ করে চকচকে দেখাবেন, ভালো কথা। তো অতিথিদের মশা বা ডেঙ্গু থেকে রক্ষা করতে হবে না?
যে কেউ যে কোনও বাড়ির দেয়ালে পোস্টার লাগাতে পারে, লিখতে পারে যা ইচ্ছে তাই, মালিকের অনুমতির প্রয়োজন হয় না। আজ যারা রঙ করবেন, কালকেই পোস্টার লাগিয়ে নোংরা করা হবে না, অরুচিকর দেয়াল লিখন হবে না, নিশ্চয়তা দিতে পারবে সিটি করপোরেশন?
বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী বারবার আসবে না। একটি স্মরণীয় আয়োজন প্রত্যাশিত। বাড়ি-ভবন রঙ করা তার অতি ক্ষুদ্র অংশ। সেটাকে প্রাধান্য দিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা মানুষকে আতঙ্কিত করতে পারেন না। বাংলাদেশ যেমন, ঢাকা শহর যেমন, শহরের ঘরবাড়ি বা ভবন যেমন, গণপরিবহন যেমন অতিথিরা তেমনই দেখবেন। ক্ষত-বিক্ষত বাসগুলো রঙ করলেই চকচকে নতুন হয়ে যাবে? কার্পেটের নিচে ময়লা লুকিয়ে রেখে পরিচ্ছন্নতার ভান করে লাভ নেই। দেশি-বিদেশি কেউ-ই বোকা বা অবুঝ নন।
বিশেষ আয়োজনের বিশেষ উদ্যোগ বহু আগে থেকেই নিতে হয়। মানুষকে সহায়তা করার মানসিকতা থাকতে হয়। বাড়ি-ভবন বা ফ্ল্যাটের মালিক মানেই বিত্তবান, সব ক্ষেত্রে তা সঠিক নয়। রঙ করার জন্য তাদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া প্রয়োজন ছিল। সরকার সহায়তা দেওয়ার একটি কর্মসূচিও নিতে পারত।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সিঙ্গাপুরের চেয়েও শক্তিশালী, বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। করোনাভাইরাস আক্রান্ত একজন বাংলাদেশিকে সিঙ্গাপুর ১০ হাজার ডলার সহায়তা দিয়েছে। জাপান করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কর্মজীবী নারীদের অফিস থেকে ছুটি নিয়ে শিশুদের সঙ্গে থাকার পরামর্শ দিয়েছে। ঘোষণা করেছে ২৭ হাজার কোটি ইয়েনের কর্মসূচি। এত শক্তিশালী অর্থনীতির বাংলাদেশ তার নাগরিকদের মুজিব বর্ষ উপলক্ষে বিশেষ কোনও প্রণোদনার ঘোষণা দিতে পারত। তাহলে হয়ত গণবিজ্ঞপ্তি বা চিঠি দিয়ে বাড়ি রঙ করানোর দরকার হতো না।