লিখেছেন আলাউদ্দিন আরিফ
সুনামগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর অংশ হিসেবে গতকাল সোমবার রতনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিস দিয়েছে দুদক। তাকে ১৮ ফেব্রুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হয়ে অনুসন্ধান টিমের কাছে বক্তব্য দিতে বলা হয়েছে। আর এনায়েত উল্লাহর সঙ্গে তার স্ত্রী নার্গিস সামসাদ, মেয়ে চাশমে জাহান নিশি ও ছেলে রিদওয়ানুল আশিক নিলয়ের গাড়ি-বাড়ি ও সম্পদের তথ্য চেয়ে বিআরটিএসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে দুদক।
রতনকে তলবি নোটিস পাঠান দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন। তার অভিযোগের বিবরণীতে বলা হয়েছে, ‘ঠিকাদার জি কে শামীমসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে অবৈধ প্রক্রিয়ায় পরস্পরের যোগসাজশে ঘুষ নেওয়ার মাধ্যমে বড় বড় ঠিকাদারি কাজ নিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ক্যাসিনো ব্যবসা ও অন্যান্য অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা অবৈধ প্রকিয়ায় অর্জনপূর্বক বিদেশে পাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন।’ আর এনায়েত পরিবারকে চিঠি দেন অভিযোগের অনুসন্ধান কর্মকর্তা মোহা. নূরুল হুদা। চিঠিতে অভিযোগের সংক্ষিপ্ত বিবরণীতে বলা হয়, ‘তিনি রাজধানী ও আশপাশে চলাচলকারী বিভিন্ন রুটের ১৫ হাজার বাস থেকে দৈনিক ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায়সহ নামে-বেনামে শতকোটি সম্পদ অর্জন করেছেন।’ চিঠিতে এনায়েতের ধানমণ্ডির বাসার ঠিকানা ও ফেনীর ছাগলনাইয়ার গ্রামের বাড়ির ঠিকানা দেওয়া হয়েছে।
রতনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, পেশায় ডিপ্লোমা প্রকৌশলী রতন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি বিটিসিএলে লাইনম্যানের কাজ করতেন। ২০০৮ সালে হঠাৎ নৌকার টিকিট পেয়ে সাংসদ হন। শূন্য থেকে তিনি ঢাকা, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনায় ১৩টি বিলাসবহুল বাড়ি ও ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। ক্যাসিনো কারবারেও তার সম্পৃক্ততা ছিল। রতনের জন্ম সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার নওদা গ্রামে ১৯৭৩ সালে। তার কৃষক বাবা আবদুর রশীদ ওরফে দারোগ আলী ধর্মপাশার বাদশাগঞ্জ বাজারে রাস্তার পাশে বসে একসময় আটা বিক্রি করতেন। সেই রতন ধর্মপাশায় নিজ গ্রামে ১০ কোটি টাকায় ‘হাওর বিলাস’ নামে বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। বাড়িটির অধিকাংশ জমি জনৈক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তির কাছ থেকে দখল করা। সুনামগঞ্জ শহরের মল্লিকপুরে জেলা পুলিশ লাইনসের বিপরীতে ৭ কোটি টাকায় বাড়ি কেনেন রতন। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘পায়েল পিউ’। বাড়িটি এক লন্ডনপ্রবাসীর কাছ থেকে কিনে নেন তিনি। ধর্মপাশা উপজেলা সদরে তার আরও সাতটি বাড়ি রয়েছে। মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরেও রয়েছে দুটি বাড়ি। নেত্রকোনা জেলা শহরেও একটি বাড়ি রয়েছে। নেত্রকোনা শহরে তার মা-বাবার নামে মেডিকেল কলেজ করার জন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে জমি ক্রয় করেছেন তিনি। এ ছাড়া ঢাকার গুলশান নিকেতনের কয়েকটি ফ্ল্যাটের মালিক রতন। অভিযোগে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে তার সহোদর যতন মিয়ার নামে ৫০০ একর জমি কেনা হয়েছে। ওই জমিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্টের জন্য একটি বিদেশি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে প্রকল্প তৈরি করেন তিনি। কিন্তু তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ওই কোম্পানির সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও মোটা অঙ্কের পাওনা নিয়ে দেনদরবার চলছে। তা ছাড়া রতনের নিজ নামেও আছে কমপক্ষে ৬০ একর জমি। রতনের কানডায়ও বাড়ি রয়েছে বলে অভিযোগে বলা হয়। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য রতনের মোবাইলে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। এর আগে এসব অভিযোগের বিষয়ে রতন দেশ রূপান্তরকে বলেছিলেন, ‘অভিযোগ তো যার বিরুদ্ধে যা খুশি আসতেই পারে। আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। আমার আয়কর বিবরণীতে সব তথ্য দেওয়া আছে।’ ক্যাসিনো কারবার ও জি কে শামীমের সংশ্লিষ্টতায় তার নাম আসা প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেছিলেন, ‘ক্যাসিনো কী? আমার চৌদ্দগুষ্টির কেউ ক্যাসিনোর সামনে দিয়ে হেঁটেছে কি না, সন্দেহ আছে। আর জি কে শামীমের সঙ্গে আমার কোনো ব্যবসা নেই।’
এনায়েতের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, রাজধানী ও এর আশপাশে বিভিন্ন রুটের প্রায় ১৫ হাজার বাস থেকে দৈনিক ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা তুলছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লা। তার বিরুদ্ধে বাসচালক ও মালিকরা এই অভিযোগ করেন। সড়কে চাঁদাবাজি নিয়ে মালিক শ্রমিক ঐক্য লীগ নামের একটি সংগঠন এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে একাধিক সংবাদ সম্মেলন করে। সংগঠনের সদস্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন সেখানে বলেন, দেশের পরিবহন খাত এনায়েতের কবজায় । এই সংগঠনের নেতারা দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলেছেন, গত জোট সরকারের সময়েও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এনায়েত। তখন এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। সেই এনায়েত ভোল পাল্টে নব্য আওয়ামী লীগ সেজে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সারা দেশে চাঁদাবাজি করছেন। এতে মহাজোট সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। মহাজোট সরকারকে বিব্রত করার জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ৬৫ বার পরিবহন ধর্মঘট দিয়েছিল। অভিযোগে ভিক্টর ও আকাশ পরিবহনের মালিক আবদুর রাজ্জাককে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘সকালে বাস বের করার পরপর ঢাকা মালিক সমিতি ও বিভিন্ন রুটের মালিক সমিতিকে (গেট পাস-জিপি) প্রতিটি গাড়ি বাবদ দিতে হয় ১২শ থেকে ১৮শ টাকা। এর মধ্যে ত্রিশ শতাংশ শ্রমিক ইউনিয়নকে, পাঁচ শতাংশ শ্রমিক ফেডারেশনকে এবং বাকি টাকা দিতে হয় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিকে। ৬৫ শতাংশ টাকা কেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিকে দিতে হয় তার সুস্পষ্ট জবাব কারও কাছে নাই। চাঁদা না দিলে রাস্তায় বাস চলতে দেওয়া হয় না। অভিযোগে আরও বলা হয়, ফেনীর ছাগলনাইয়া থানার উত্তরপানুয়া গ্রামের বাসিন্দা খন্দকার এনায়েত ১৯৮৪ সালে গুলিস্তান-মিরপুর রোডে একটি মিনিবাস নামান দুজনের অংশীদারত্বের ভিত্তিতে, যার মূল্য ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। সেই এনায়েত বিএনপির মির্জা আব্বাসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক হন। কমিটিতে মির্জা আব্বাস ছিলেন সভাপতি।
অভিযোগে আরও রয়েছে, এনায়েত উল্লাহ দেশে-বিদেশে নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদের বিশাল পাহাড় গড়েছেন। ধানম-িতে একটি ও গুলশানে কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে তার। পূর্বাচলসংলগ্ন ৩০০ ফিট রাস্তার পাশে প্রায় শত বিঘা জমি আছে। সারা দেশে এনা পরিবহনের আট শর বেশি গাড়ি আছে, যার প্রতিটির মূল্য এক থেকে দেড় কোটি টাকা। সিলেটে কয়েক বিঘা জমির ওপরে এনা পরিবহনের নিজস্ব টার্মিনাল রয়েছে। ময়মনসিংহ, ভালুকায় রয়েছে ২৩ বিঘা জমির ওপর এনা ফুডস নামের বিশাল ফ্যাক্টরি। মালয়েশিয়া ও কানাডায় আছে এনায়েতের সেকেন্ড হোম। ময়মনসিংহে প্রায় শত বিঘা জমি আছে তার। ঢাকার মিরপুরে আছে বহুতল ভবনের ৭টি বাড়ি। কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় আবাসিক হোটেল আছে তার। হবিগঞ্জ-মাধবপুরে কয়েক বিঘা জমির ওপর হোটেল ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে খন্দকার ফুড নামে একটি বিশাল রেস্টুরেন্টের মালিক তিনি। মহাখালীতে নিজস্ব জায়গায় রয়েছে এনা পরিবহনের বিশাল অফিস।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে খন্দকার এনায়েত উল্লাহ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে দাবি করেন। গতকাল মোবাইল ফোনে দেশ রূপান্তরের কাছে এ দাবি করে তিনি বলেন, ‘কারও অবৈধ সম্পদ থাকলে দুদক অনুসন্ধান করতেই পারে। এটা তাদের এখতিয়ার আছে। আমরাও দুদককে স্বাগত জানাই এবং সহযোগিতা করতে চাই। বিআরটিএকে আমার ও আমার পরিবারের গাড়ি সম্পর্কে চিঠি দিলে সেটার জবাব বিআরটিএ দেবে। আমাদের এনা ট্রান্সপোর্টের বহু গাড়ি আছে। আমি সরকারকে ট্যাক্স দেই। এসব গাড়ির নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া। এসব আমাদের ট্যাক্স ফাইলে সব দেওয়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বছর দুয়েক আগে কয়েকজনকে চাঁদাবাজি, খুন রাহাজানির অভিযোগে সংগঠন থেকে বের করে দিয়েছিলাম। তারা বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন প্রপাগান্ডা করে। সম্ভবত ওরাই কোনো অভিযোগ দিতে পারে। ইসমাইল হোসেন বাচ্চু নামে একজন খুনি ও চাঁদাবাজ এসব করে থাকতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘বলা হচ্ছে ঢাকা ও আশপাশে ১৫ হাজার গাড়ি আছে। অথচ গাড়ি আছে ৫ হাজার। এর থেকেও বিষয়টি মিথ্যা প্রমাণ হয়।’