লিখেছেন গোপেন দেব
গান গল্প আর কাব্যকথার এক অনুপম অনুষ্ঠান হয়ে গেল মন্ট্রিয়লে গত ৮ ফেব্রুয়ারি শনিবার সন্ধ্যায় । মন্ট্রিয়লের সাহিত্য ও সংষ্কৃতিপ্রেমী একদল ভাবুক মানুষের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এবারের আয়োজনটির একটি অন্যরকম মাত্রা ছিল । মন্ট্রিয়ল প্রবাসী নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ কবি গল্পকার রম্যলেখক অপরাহ্ণ সুসমিতোকে প্রতিপাদ্য করেই এবারের অনুষ্ঠানটি সাজিয়েছিলেন তাঁরা । ‘সাহিত্য আড্ডার বন্ধুরা’ এর নামও দিয়েছিলেন ‘একটি অপরাহ্ণ সন্ধ্যা’। সেদিন এখানের আবহাওয়াটা মোটেও সুখকর ছিলো না । লাগাতার দুদিনের বিরামহীন তুষার ঝড়, হাড় কাঁপানো ঠান্ডা । খুব জরুরী দরকার ছাড়া বাইরে বেরুনোর কথা নয় কারো । কিন্তু এই প্রতিকুলতাকে ডিঙ্গিয়ে সবাই হাজির হয়েছিলেন যথাসময়েই । রাস্তায় তুষারের পাহাড়, হিমাংকের নীচে কুড়ি ডিগ্রি সেলসিয়াসে ঠান্ডা – এই অবস্থায় সুর্যাস্তের পরই বাইরের প্রকৃতি যখন নিশ্তব্দতায় আচ্ছন্ন, তখন ভিল সেন্ট লরেনের ২০৯০ নয়েল স্ট্রীটের চিত্র ছিল ভিন্ন । কবি অপরাহ্ণ সুসমিতোর লেখালেখি নিয়ে আলাপচারিতায়, সংলাপে, গানে বাসাটি ছিল কলগুঞ্জনে মুখর, উষ্ণ । ‘বিমল আনন্দে জাগো রে / মগন হও সুধা সাগরে / হৃদয় উদয়াচলে দেখো রে চাহি, প্রথম পরম জ্যোতিরাগ রে’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আবাহনী গান দিয়ে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান । শিল্পী মনিকা মুনা খালি গলায় এই গানটি করেন । শাষ্ত্রীয় কিংবা রাগাশ্রয়ী গানে অসম্ভব কুশলী মনিকা যখন গানটি করছিলেন তখন যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েছিলেন সেখানে উপস্থিত সকলেই ।অনুষ্ঠানের শেষ সময়টুকু অবধি কানে, প্রাণে গানের রেশটি অনুভূত হচ্ছিল – আবহ সঙ্গীতের মতো । মনিকা মুনার গানের পর কবি অপরাহ্ণ সুসমিতোর লেখালেখি ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে একটি চমৎকার বিশ্লেষনধর্মী আলোচনা হয় । এটি করেন টরন্টো থেকে আগত কবি মৌ মধুবন্তী । তিনি বলেন, অপরাহ্ণ সুসমিতোর সাটামাটা জীবনাচরণের সাথে তাঁর লেখা ছড়া, কবিতা, গল্পের একটা আক্ষরিক মিল খোঁজে পাওয়া যায় । তিনি যেমন সহজ সাবলীল ভাবে কথা বলেন, লেখালেখিতেও এই ধারাটির সম-রূপ খোঁজে পান পাঠকরা । মেদহীন শব্দচয়নে লেখা অপরাহ্ণের প্রতিটি সৃষ্টিই পাঠকরা এক নিঃশ্বাসে পড়ে । বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা তাঁর লেখাগুলো দ্রুত পঠিত হয়, থাকে প্রশস্তি-মন্তব্যের ছড়াছড়ি । অপরাহ্ণ সুসমিতোকে একজন নীরব কিন্তু নিবিষ্ট সাহিত্য কর্মি হিসেবে বর্ণনা করে মৌ মধুবন্তী বলেন, তাঁর লেখায় যেমন প্রেম বিরহ, হালকা হাস্যরস, পাওয়া না পাওয়ার আনন্দ বেদনার কথা রয়েছে তেমনি রয়েছে সমাজ ও রাজনীতির নানা অসংগতির রূপক আবার কখনো সুষ্পষ্ঠ অভিঘাতের উচ্চারণ । মানবিক প্রেম তাঁর লেখালেখির অন্যতম বৈশিষ্ট । অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষন ছিল ‘যুগলেষু’ শীর্ষক পর্ব । এতে অপরাহ্ণের লেখা একটি প্রেমের গল্পের কন্ঠ-অভিনয় করেন ইশরাত আলম, আরিয়ান রশীদ ও লেখক অপরাহ্ণ সুসমিতো । এটি পরিবেশনার সময় মনে হচ্ছিল রেডিওতে নাটক শোনা হচ্ছে । কবির লেখা থেকে আবৃত্তির পর্বটিও ছিল হৃদয় ছোঁয়া । এ পর্বে অংশ নেন আফাজ উদ্দীন তোতন, মুফতি ফারুক, নাজমুল ইসলাম, সঞ্জীব দাস উত্তম , তৌফিকুর রহমান রাঙা ও কবি অপরাহ্ণ সুসমিতো নিজে । মনিপুরী ভাষায় অনুবাদিত অপরাহ্ণের একটি লেখা থেকে পাঠ করেন শেরাম রিপন ।এছাড়া কবির বিভিন্ন লেখা থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ পড়ে শোনান আরিয়ান রশীদ, মনিকা মুনা, আবুল জাকের, শিবলী নোমান, অনুজা দত্ত ও তপন বড়ুয়া । ‘একটি অপরাহ্ণ সন্ধ্যা’কে অনির্বচনীয় ভাবালুতার আচ্ছন্ন করেছিল মন্ট্রিয়লের জনপ্রিয় শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনা। সঙ্গীতানুষ্ঠান পর্বটি গ্রন্থণা করা হয়েছিল সুনির্দিষ্ট কয়েকটি জনপ্রিয় গান দিয়ে । ডা. পুনম ঘোষ যখন গাইছিলেন ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না’ তখন ঘরময় নেমে আসে এক অপার প্রেমের আবহ । রবীন্দ্র, নজরুল, লোকজ, রাগপ্রধান ও পুরনো দিনের এমনসব গান বাছাই করা হয়েছিল যা স্মৃতিকাতরতায় নিমজ্জিত করেছিল দর্শকশ্রোতাদের মন । মনিকা মুনা ও ডা. পুনম ঘোষ ছাড়াও সঙ্গীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট শিল্পী সফিউল ইসলাম, দেবপ্রিয়া কর রুমা, অনুজা দত্ত ও সাফিনা করিম । অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্বে কবি অপরাহ্ণ তাঁর লেখালেখির জগৎ, জীবনবোধ ও ভাবনা নিয়ে মুক্ত আলোচনা করেন । পুরো অনুষ্ঠানটি গ্রন্থণা ও সঞ্চালনা করেন এই সাহিত্য আড্ডার অন্যতম উদ্যোক্তা সংষ্কৃতি কর্মি ও সংগঠক ইশরাত আলম । অনুষ্ঠানের শুরুতে দেয়া তাঁর সূচনা বক্তব্যে ওঠে আসে মন্ট্রিয়লে সাহিত্য সংষ্কৃতি ও শিল্প বিষয়ক এরকম একটি ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের পঠভূমি । ইশরাত আলম বলেন, এখানের ব্যস্ত জীবনেও মাতৃভূমির প্রতি প্রবাসীদের রয়েছে অবিরাম টান । ছেড়ে আসা স্বদেশের ভাষা সংষ্কৃতি কৃষ্টিকে আঁকড়ে ধরে রাখার প্রয়াস থেকেই তাঁরা এই অনুষ্ঠানগুলো করছেন । তিনি জানান, এবারের অনুষ্ঠানটি তৃতীয়তম । সাহিত্য সংষ্কৃতি চর্চার সাথে সাথে সমমনাদের নিয়ে একত্রে বসা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুণীদের সংবর্ধিত করাও এই উদ্যোগের অংশ । তিনি এরকম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেও অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্যে উপস্থিত সকলকে সাহিত্য আড্ডার বন্ধুদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান । উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে প্রবীণ শিল্পী সফিউল ইসলাম কবি অপরাহ্ণ সুসমিতোকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান । এছাড়া তাঁকে জালাল উদ্দীন রুমীর একটি বইও উপহার প্রদান করা হয় ।
সভায় জানানো হয়, আগামি ২২ ফেব্রুয়ারি শনিবার মন্ট্রিয়লে অনুষ্ঠিতব্য একুশের বইমেলায় অপরাহ্ণ সুসমিতোর নতুন বই ‘পরমাণু গল্প’র মোড়ক উন্মোচন করা হবে। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে কবি মৌ মধুবন্তীর জন্মদিন এবং শিল্পী দম্পতি মৃণাল পিংকু ও দেবপ্রিয়া কর রুমার বিয়েবার্ষিকীর কেক কাটা হয় । অনুষ্ঠানে সাউন্ড ও ক্যামেরার দায়িত্বে ছিলেন আরিফ সিদ্দিকী । সবশেষে নৈশভোজের পর চমৎকার একটি সন্ধ্যা উপভোগের আমেজ নিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান । কানাডা জুড়ে প্রচন্ড শৈত্যপ্রবাহকে সাহিত্যপ্রেমী এই বন্ধুরা একরাশ ভালোলাগার উষ্ণতার চাঁদর পরিয়ে মাঝরাতে ঘরে ফেরেন আগামি কোনো একদিন আবার মিলিত হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে।