লিখেছেন ফারুক ওয়াসিফ
দেশে হোম লোন নিলে ফেরত দিতে হয়। না দিলে বাড়ি ক্রোকসহ অন্যান্য শাস্তি নিশ্চিত। এর থেকে সহজ হলো ‘সেকেন্ড হোম লোন’ নেওয়া। আপনি ব্যাংক থেকে বিরাট অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে সেকেন্ড হোম কিনবেন, দীর্ঘমেয়াদি ভিসা এবং নাগরিকত্ব কিনবেন; তারপর পগারপার হয়ে যাবেন। এই ঋণ টেকসই, এর সুদ দিতে হয় না, ফেরত দেওয়ার বালাই নেই। বরং বিদেশি পাসপোর্ট নিয়ে দেশে এসে টাকা বানানোর কারবারটা চালু রাখতে পারবেন। ঋণখেলাপের অর্থ বিদেশে বিনিয়োগ করে সেখানেও ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তার সম্মান পাবেন। কষ্ট করে সেসব দেশের নাগরিকত্ব পাওয়া বাংলাদেশিদের সমাজে মাতবরি করবেন, সপরিবার বাংলাদেশিদের সভা অলংকৃত করে বক্তৃতা দেবেন। কেউ আপনাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালালে দামি উকিল মারফত উকিল নোটিশ পাঠাবেন।
ঠিক এই কাজটাই করেছেন বেসিক ব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে কানাডায় চম্পট দেওয়া ব্যবসায়ী গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু(বণিক বার্তা, জানুয়ারি ১৮)। সম্প্রতি তাঁর কীর্তির কথা গণমাধ্যমে চাউর হলে কানাডার যে শহরে তিনি জাঁকিয়ে বসেছেন, সেই টরন্টোর অনাবাসী বাংলাদেশিরা প্রতিবাদে নামেন। অভিযোগ রয়েছে, দেশে তিনি একাই নৌপরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করেন। নিয়ন্ত্রণের এই উচ্চাভিলাষ তিনি কানাডায়ও ফলাচ্ছেন। সেখানকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি ও তাঁর স্ত্রী মধ্যমণি হয়ে থাকেন। ব্যবসা চালাচ্ছেন, বাংলাদেশি কমিউনিটির কেউকেটা হয়ে উঠছেন। এহেন ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বরদাশত করা হয়নি। তিনি টাকা পাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। অথচ দুদকের উকিল এখনো তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এ রকম অনেকের নাম প্রকাশিত হয়েছে বণিক বার্তার ওই প্রতিবেদনে।
দুদক গাজী বেলায়েত হোসেনের বাংলাদেশি ও কানাডীয় পাসপোর্টের নম্বর উল্লেখ করে নিষেধাজ্ঞা দিলেও আদালতের নির্দেশে তিনি দেশ ছেড়ে যান। তাঁর কানাডায় কেনা বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ঠিকানাও পেয়েছে দুদক। অচিরেই কানাডা সরকারের কাছে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলআর) পাঠাবে বলে জানিয়েছেন দুদকের একজন পরিচালক (২৩ জানুয়ারি, বাংলাদেশ প্রতিদিন) দুদক খুঁজে বেড়াচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নিয়ে চম্পট দেওয়া প্রশান্ত হালদার দম্পতিকেও। দুদক খোঁজ পেয়েছে, তিনিও কানাডায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন। এভাবে দেশের অর্থ চুরি করে পালানো প্রত্যেকের ব্যাপারেই এ ধরনের খোঁজখবর করা এবং তাঁদের ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার কাজটা দুদকের। এ ধরনের কঠিন পদক্ষেপ ছাড়া সংবাদমাধ্যমের খবরের বালির বাঁধ দিয়ে পুঁজি পাচার বন্ধ করা যাবে না। এমনটা চলতে দিয়েও চলতে পারবে না বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতসহ সমুদয় অর্থনীতি।
বাংলাদেশের টাকা কোথায় যায়, তার হদিস বের করেছে সরকারি সংস্থাগুলো। এক সরকারি প্রতিবেদন বলছে, প্রধানত ১০টি দেশে এই টাকা যাচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেইম্যান আইল্যান্ডস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস (১৮ নভেম্বর, ডেইলি স্টার)। আন্তর্জাতিক মুদ্রা পাচারবিষয়ক পানামা পেপারসেও অনেকের নাম ও ঠিকানা এসেছিল। গত নভেম্বর মাসে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে প্রণয়ন করা হয়েছে খসড়া ‘জাতীয় কৌশলপত্র’। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফইউ) প্রণীত এই খসড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামতের পর চূড়ান্ত হওয়ার কথা। এর মাধ্যমে ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা শনাক্ত করা হবে। ঋণের নামে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে ও এলসির অন্তরালে বিদেশে টাকা পাচার শনাক্ত করা হবে। পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের গড়ে তোলা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম, শিল্পকারখানা, বিদেশি মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন ও অনলাইনে কেনাবেচার নামে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে ব্যবস্থা। দীর্ঘদিন কারা বিদেশে অবস্থান ও দেশে কতজন অবৈধভাবে বিদেশি নাগরিক বসবাস করছেন, এরও সন্ধান চালানো হবে।
বাংলাদেশের ওপরতলার অনেকেরই নাম ঋণখেলাপ ও মুদ্রা পাচারকারীর তালিকায় আছে। অনেক নাম গণমাধ্যমে এসেছে, অনেক নাম আসেনি। জাতিসংঘের সংস্থা আঙ্কটাডের হিসাবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের করের ৩৬ শতাংশই পাচার হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার (মানে তখনকার বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ) বিদেশে পাচার হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে বলে দাবি করেছে। গত চার বছরে বিভিন্ন ব্যাংকের টাকা বিদেশে পাচার হওয়ার তথ্য নিয়মিতভাবে সংবাদমাধ্যমে এসেছে। সরকারের প্রতিক্রিয়া নামমাত্র।
ঋণ খেলাপ হয়েছে। ব্যাংক লুট হয়েছে। তারপর পালিয়েছে পুঁজি। এখন লোকগুলোও বেগমপাড়া নিবাসী হচ্ছেন। তাঁদের আটকানো না গেলে ওই অর্থ তো ফেরত আসবেই না, অর্থবল আর বিদেশি নাগরিকত্বের জোরে তাঁরা আরও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছেন। প্রতিবাদকারীদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। তাঁদের প্রতিপত্তি বাংলাদেশে তো বটেই, বিদেশেও সাধারণ বাংলাদেশিদের জন্য উৎপাত বয়ে আনবে। রেখে যাওয়া ব্যবসায়িক যোগাযোগ ও সুযোগ কাজে লাগিয়ে আরও অর্থ ও সম্পদ দেশ থেকে সরাবেন। দেশের অর্থনীতিকে ফোঁপরা করার বিরুদ্ধে কানাডীয় বাংলাদেশিরা আন্দোলন করছেন।
বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু কমই আছে। এই টাকা ফেরাতে হবে, অবৈধভাবে পুঁজি পাচার বন্ধ করতেই হবে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাম্বিয়ার মামলার আদেশথেকে শিক্ষা নিতে পারেন কানাডীয় দেশপ্রেমিকেরা। কানাডার বৃহত্তর সমাজ তো বটেই, সেখানকার বাংলাদেশি ও এশীয়দের নিজেদের স্বার্থেই এসব লুটেরাকে সেসব দেশে শক্তি অর্জন করতে দেওয়া যাবে না। তাঁরা আখেরে কষ্ট করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়া কিন্তু সম্মানজনকভাবে জীবনযাপন করা বাংলাদেশিদের বিকাশের রাস্তাজুড়ে বসে থাকবেন। তাঁদের উচিত কানাডীয়দের সঙ্গে নিয়ে সেসব দেশের আদালতে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া। গত বছরে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একটি প্রতিবেদন বলছে, কানাডা এখন দুনিয়ার অবৈধ অর্থের অন্যতম প্রধান গন্তব্য। কানাডার প্রখ্যাত ডেইলি গ্লোব অ্যান্ড মেইল পত্রিকা একটি ফাঁস হওয়া ব্যাংক প্রতিবেদন এই অভিযোগকে আরও জোরালো করেছে। কানাডার কয়েকটি প্রদেশেও এখন এটাকে গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২০১৮ সালেই কানাডার অর্থনীতিতে প্রায় ৪৬.৭ বিলিয়ন ডলার ঢুকেছে বলে কানাডীয় গণমাধ্যম সিবিসি জানিয়েছে। এর বড় অংশই ঢুকেছে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়। ২০১৭ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মধ্যে কানাডাই অর্থ পাচারকারীদের জন্য বেশি উন্মুক্ত। সেকেন্ড হোম কর্মসূচি বা বিনিয়োগের সুযোগের নামে গুরুতর অর্থনৈতিক অপরাধীদের সুরক্ষা এবং তাদের অবৈধ টাকা বৈধ করার যে সুযোগ উন্নত দেশগুলো আইনের ফাঁকে রেখেছে, তা বন্ধ করতে সেসব দেশেও জনমত গঠন করার এই সুযোগ পুরোদমে কাজে লাগাতে হবে।
জাতিসংঘের ভাষণে তৃতীয় দুনিয়ার নেতারা প্রায়ই উন্নত দেশগুলোকে আহ্বান জানান, তাঁরা যাতে এসব দেশ থেকে অর্থ লোপাটকারীদের সেসব দেশে বিনিয়োগকারীর সম্মান দিয়ে সুরক্ষা না করেন। সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও অনুরূপ ভাষণ দিয়েছেন জাতিসংঘে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরতে বিশ্বব্যাপী কার্যক্রমও আছে, আইনও আছে। তাই কানাডায় যেসব বাংলাদেশি মাতৃভূমির অর্থ লোপাটের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন, তাঁরা আসলে বিরাট এক পরিবর্তনের সূচনা করেছেন। এই আন্দোলনের পর কারও কারও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে, অনেকেই সেখানকার সমাজে একঘরে হয়েছেন। এটা চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশ সরকার কিছু না করলেও কানাডার বর্তমান কল্যাণকামী সরকার আমাদের সহায় হতে পারে।
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক