লিখেছেন উজ্জ্বল হোসেন
আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। মেসো আমেরিকা বা বর্তমান মধ্য আমেরিকার সবচেয়ে পরাক্রমশালী প্রাচীনতম জাতি ছিল মায়ানরা। হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা, এল সালভেদরের উত্তরাংশ, সেন্ট্রাল মেক্সিকোর তাবাস্কো আর চিয়াপাসসহ আরো প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বসতি স্থাপন করেছিল তারা। সে সময়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থেকে মায়ানরা এই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় গড়ে তুলেছিল সমৃদ্ধ এক সভ্যতা, যার নাম মায়া সভ্যতা। তারা শুধু মধ্য আমেরিকার পরাক্রমশালী জাতিই ছিল না, পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষদের তুলনায় কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিল।
যখন অন্য মানুষেরা জানত না সভ্যতা কী, কীভাবে আবাস গড়তে হয়, সেসময়ই মায়ানরা গড়ে তুলেছিল উঁচু উঁচু স্থাপনা, এগিয়ে গিয়েছিল জ্ঞান আর বিজ্ঞানে। উদ্ভাবন করেছিল এমন অনেক কিছু, যা ঐ সময়ের তো বটেই, বর্তমান মানুষদের কাছেও বিস্ময়ের ব্যাপার। মায়া সভ্যতার এমন কিছু উদ্ভাবনের কথা থাকবে এ লেখায়।
জ্যোতির্বিদ্যা
মায়ানরা জ্যোতির্বিদ্যায় বেশ জ্ঞান অর্জন করেছিল। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। তারা ‘স্বর্গীয় দেহ’ নিয়ে গবেষণা করত। শুধু তা-ই নয় সূর্য, চাঁদ এবং তারার উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ নিয়েও মায়ানরা নানা তথ্য সংগ্রহ করে রাখত।
আমরা জানি, এক বছর সমান ৩৬৫ দিন। আসলে এক বছর মানে ৩৬৫ দিন নয়। প্রকৃত হিসাবটা হচ্ছে এক বছর সমান ৩৬৫.২৪২২ দিন। আর জর্জিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এক বছর সমান ৩৬৫.২৪২৫ দিন। কিন্তু মায়ানদের হিসাব অনুযায়ী এক বছর সমান ৩৬৫.২৪২০ দিন। অর্থাৎ, বছরের হিসাবে মায়ানদের হিসাবটিই ছিল প্রকৃত হিসাবের অনেক কাছাকাছি। এটা সত্যিই অবাক করার বিষয় যে, খ্রিস্টপূর্ব সময়েই মায়ানরা বছরের এত নিখুঁত হিসাব করেছিল। মায়ানদের হিসাব মতে, ২৩৯২ দিনে ৮১টি চন্দ্রমাস হয়। অর্থাৎ একটি চন্দ্রমাসের দৈর্ঘ্য ২৯.৫৩০৮ দিন।
আধুনিক বিজ্ঞান বলে, ২৯.৫৩০৫৯ দিনে একটি চন্দ্রমাস হয়। অর্থাৎ হাজার হাজার বছর আগেই মায়ানরা সঠিক চন্দ্রমাস গণনা করতে সক্ষম হয়েছিল। মায়ানরা শুক্র গ্রহ নিয়েও গবেষণা করেছিল। শুক্র গ্রহের পরপর দু’টি সর্বোচ্চ প্রতান (elongation)-এর মধ্যবর্তী চক্রটির প্রকৃত সময় ৫৮৪ দিন। আর মায়ানদের গণনার সাথে এই প্রকৃত সময়ের তফাত ছিল মাত্র ২ ঘণ্টা। মায়ানরা বৃহস্পতি, মঙ্গল একং বুধ গ্রহ সম্পর্কেও নানা তথ্য সংগ্রহ করেছিল। অর্থাৎ, হাজার বছর আগেই মায়ানরা জ্যোতির্বিদ্যায় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল।
সংখ্যা পদ্ধতি
ভারতীয় গণিতবিদ আর্যভট্ট শূন্যের ধারণা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত বইয়ে শূন্যকে সংখ্যার মর্যাদা দেন ব্রহ্মগুপ্ত।
তবে শূন্যের ধারণা তারও আগেই ব্যবহার করেছিল মায়ানরা। ভারতীয়দের চেয়ে ১০০ বছর আগেই মায়ানরা শূন্যের ধারণা তৈরি করে। মায়ানদের সংখ্যা পদ্ধতি গড়ে উঠেছিল তিনটি ভিন্ন চিহ্ন এবং প্রতীক দিয়ে। শেল চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হতো শূন্য। এক বোঝানো হতো একটি ডট চিহ্ন দিয়ে। পাঁচ প্রকাশ করা হতো বার চিহ্ন দিয়ে। এ তিনটি চিহ্ন দিয়েই মায়ানরা হিসাব করত বিশ পর্যন্ত। তাদের ভিত্তি সংখ্যা ছিল মোট বিশটি। এই বিশটি সংখ্যাকে ভিত্তি করেই বড় বড় সংখ্যা হিসাব করা হতো।
ক্যালেন্ডার
মায়ানরা নিজেরাই নিজেদের ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল, তা-ও আবার খ্রিস্টপূর্ব সময়েই! ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকেই মায়ানদের ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিল। অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে নয়, নিজেদের প্রয়োজনে নিজেরাই নিজেদের ক্যালেন্ডার তৈরি করে নিয়েছিল তারা।
মায়ানরা সুচারুভাবে দিন তারিখের হিসাব লিপিবদ্ধ করত। আমরা যে ধরনের ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি, মায়ানরা সেরকম ক্যালেন্ডার ব্যবহার করত না। তাদের ক্যালেন্ডার ছিল আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। তাদের ক্যালেন্ডারে অক্ষর এবং সংখ্যার পরিবর্তে ছিল হায়ারোগ্লিফিক চিত্রের সমাহার। ক্যালেন্ডারগুলোতে তারিখগুলো চক্রাকারে আবর্তিত হতো। বোঝার সুবিধার জন্য বৃত্তাকার চাকার উপরে ক্যালেন্ডারের দিন এবং বার বা মাসগুলোর চিত্র অঙ্কন করে, সেই চাকাগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দিন তারিখের হিসেব বের করা হতো।
মায়ানদের মোট তিনটি ক্যালেন্ডার ছিল। একটি হলো পবিত্র ক্যালেন্ডার বা ধর্মীয় ক্যালেন্ডার। এটি জোলকিন (Tzolk’in) নামে পরিচিত। ২৬০ দিন বিশিষ্ট এই ক্যালেন্ডার বিভিন্ন ধর্মীয় দিবসের হিসেব রাখা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য ব্যবহৃত হতো।
দ্বিতীয়টি নাগরিক ক্যালেন্ডার বা কৃষি ক্যালেন্ডার। ধর্মনিরপেক্ষ এই ক্যালেন্ডার হাব (Haab) নামে পরিচিত। এটি আমাদের প্রচলিত ক্যালেন্ডারের মতো ৩৬৫ দিন বিশিষ্ট, যদিও এতে লিপ ইয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এই ক্যালেন্ডারটি ব্যবহৃত হতো কৃষিকাজসহ দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের জন্য।
তৃতীয় ক্যালেন্ডারটিকে বলা হয় দ্য লং কাউন্ট ক্যালেন্ডার (The Long Count Calendar)। এটি ব্যবহার করা হতো ঐতিহাসিক ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করার কাজে। এর মাধ্যমে অতীতে বা ভবিষ্যতে হাজার হাজার বছর পর্যন্ত হিসেব রাখা যেত।
বল কোর্ট
মায়ানরা খেলাধুলাপ্রেমী ছিল। তাদের প্রতিটি শহরেই বল কোর্ট থাকত। এই বল কোর্টগুলোর আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে আজকের দিনের স্টেডিয়াম।
মায়ানরা তাদের বিভিন্ন উৎসবে এই বল কোর্টে খেলার আয়োজন করত। বল কোর্টগুলো দেব-দেবীর পায়ের কাছাকাছি তৈরি করা হতো তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। মায়ানরা পক-এ-টক নামে একটা খেলা খেলত। এটি মূলত আজকের দিনের ফুটবল এবং বাস্কেটবলের সমন্বয়ে একটি খেলা। এ খেলায় দুটি পক্ষ থাকত।
কোর্টের দুই দিকে দুটি হুক থাকত। এই হুকের ফাঁকা অংশ দিয়ে বল ঢুকিয়ে স্কোর করতে হতো। তবে হাত বা পা ব্যবহার করা যেত না। হাত বা পা বাদে শরীরের বাকি অংশ দিয়ে বলটিকে হুকের ভেতর দিয়ে ঢুকাতে পারলে এক পয়েন্ট অর্জিত হতো। এভাবে খেলার ফলাফল নির্ধারিত হতো। মায়ানরা তাদের নিজস্ব চেষ্টায় আজকের দিনের মতো বাউন্সি বল আবিষ্কার করে ফেলেছিলো সে সময়েই।
লিখন পদ্ধতি
সমস্ত আমেরিকানদের মধ্যে মায়ানরা লেখার জন্য সর্বাধিক উন্নত রূপ আবিষ্কার করেছিল, যা গ্লাইফস নামে পরিচিত। গ্লাইফস হচ্ছে ছবি বা চিহ্নের মাধ্যমে কোনো বর্ণ বা সাউন্ডকে বর্ণনা করা।
ইতিহাস বলে, মায়ানরা প্রায় ৭০০টিরও অধিক গ্লাইফস ব্যবহার করত। আশ্চর্যজনকভাবে মায়ানদের ব্যবহৃত গ্লাইফসের প্রায় ৮০ শতাংশ বর্তমান সময়ে এসেও বোঝা যায়। মায়ানরা তাদের ইতিহাস এবং অর্জন সম্পর্কে সচেতন ছিল। তাই তারা তাদের ইতিহাস এবং অর্জন বিভিন্ন পিলার, দেয়াল এবং পাথরে লিখে রাখত। শুধু তা-ই নয়, তারা বইও লিখত। বইয়ের বেশিরভাগ জায়গা জুড়েই থাকত ঈশ্বর, প্রাত্যহিক জীবনযাপন এবং রাজাদের নানা কথা। মায়ানরা গাছের বাকল দিয়ে তৈরি কাগজ দিয়ে বই বানাত। সেগুলোকে বলা হয়ে থাকে কোডেক্স।
মায়ান সভ্যতার মাত্র ৪টি কোডেক্স উদ্ধার করা হয়েছে অক্ষতভাবে। মায়ানদের লিখিত রূপকে বলা হয় মায়া লিপি। এটি হচ্ছে মেসো আমেরিকানদের মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত লিখন পদ্ধতি এবং মায়ানদের ইতিহাস এভাবেই সংরক্ষিত হত। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, মায়ানদের এই খোদাইকৃত লিখিত রুপ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর পূর্ববর্তী হতে পারে।
ওষুধ
মায়ানরা ওষুধও আবিষ্কার করেছিল। অন্যান্য সভ্যতার মতো মায়ানদের ওষুধেও ছিল ধর্ম আর বিজ্ঞানের মিশ্রণ। ওষুধ তৈরি করতেন ধর্মযাজকেরা। তারা উত্তরাধিকার সূত্রে ওষুধ তৈরির দায়িত্ব পেতেন এবং তাদেরকে ওষুধ তৈরির প্রশিক্ষণও দেয়া হত।
মায়ানদের কাছে সুস্বাস্থ্য এবং অসুস্থতা ছিল ভারসাম্য এবং ভারসাম্যহীনতার ব্যাপার। ভারসাম্য রাখাই ছিল সুস্বাস্থ্য এবং ভারসাম্যহীনতা মানে অসুস্থতা। তারা বিশ্বাস করত সুস্বাস্থ্যের জন্য ডায়েট, লিঙ্গ এবং বয়স গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তাদের শরীরে ক্ষত হলেই তারা তা সেলাই করে নিত। তাদের শরীরের কোনো হাড় ভেঙে গেলে কিংবা মচকে গেলে দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য ভাঙা হাড়ের চারপাশে প্লাস্টার করত। দন্ত চিকিৎসায়ও বেশ পারদর্শী ছিল মায়ানরা। দাঁতের ফাঁকা অংশ পূরণ করার জন্য তারা ধাতুর প্রলেপ ব্যবহার করত।
মায়ানরা দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য অবসিডিয়ান (কাচের মতো দেখতো এক জাতীয় আগ্নেয়শিলা) ব্যবহার করত। বর্তমান সময়ে এসেও বিভিন্ন অপারেশনে অবসিডিয়ান ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অবসিডিয়ানের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এটি কম আঘাত দেয়, দ্রুত সারিয়ে তোলে এবং কম ক্ষতচিহ্ন তৈরি করে। মায়ানরা বিভিন্ন উদ্ভিদ থেকেও ওষুধ তৈরি করত। ওষুধ তৈরির জন্য তারা প্রায় দেড় হাজারেরও অধিক উদ্ভিদ ব্যবহার করত।
শিল্পকর্ম
মায়ানদের শিল্পকর্ম শুধুমাত্র একটি নতুন আবিষ্কারই ছিল না, তাদের চিত্রকর্ম সারা বিশ্ব্যব্যাপী প্রশংসা কুড়িয়েছিল। সময়ের চেয়েও অনেক বেশি আধুনিক ছিল তাদের চিত্রকর্মগুলো। মায়ানরা নানা ধরনের উপাদান থেকে শিল্পকর্ম তৈরি করত। মায়ানদের শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে কাঠের শিল্পকর্ম, কাচের শিল্প, মৃণ্ময় পাত্র, পাথরের শিল্পকর্ম, দেয়াললিখন ইত্যাদি।
তবে তারা কাঠ খোদাই করে ছবি তৈরিতে বেশ পারদর্শী ছিল। আজকের দিনে আমরা যে পাথরের ভাস্কর্য দেখি, তা মায়ানদের সময় থেকেই বেশ জনপ্রিয় ছিল।
মুখোশ
মায়ানরা বিভিন্ন উৎসবে মুখোশ পরত। মুখোশ আবিষ্কারের ধারণা তাদের নিজেদের। নিজেদের প্রয়োজনেই তারা মুখোশ তৈরি করেছিল।
মুখোশগুলো তৈরি হত জেড, স্বর্ণ, পালক এবং বিভিন্ন ধাতু দিয়ে। মায়ানরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অথবা কারো মুত্যুর দিনে মুখোশ পরত বেশি। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, মায়ানরা বিশ্বাস করত পাতাল থেকে দৈত্য এসে তাদেরকে মেরে ফেলতে পারে। এসব দৈত্যদের ভয় দেখাতে মায়ানরা বিভিন্ন মুখোশ পরত। তাদের মুখোশগুলো ছিলো মূলত দৈত্যদের ভয়ের প্রতীক।
মায়ান পুরাকথার জনপ্রিয় প্রাণী, যেমন- জাগুয়ার এবং সাপের মুখোশ মায়ানরা ব্যবহার করত। মৃতদেহ পোড়ানোর সময় এসব মুখোশ তারা মৃতদেহের পাশে রাখত। তবে মায়ানরা যেসব মুখোশ পরত, তার বেশিরভাগই ছিল কোনো না কোনো ঈশ্বরের প্রতীক। মায়ান শ্যামানরা সাধারণত চার ধরনের মুখোশ পরতো। বাকিরা পরতো আট ধরনের মুখোশ।