তিদিনের নিয়মে ঢাকার রাস্তায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন সুরুজ আলী (৫১)। মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া থেকে যাত্রী নিয়ে নামিয়ে দেন পল্লবীর রূপনগরে। তারপর যাত্রী নিয়ে যান কাকরাইলের হেয়ার রোডে। তারপর গুলশানে। সবকিছু স্বাভাবিকই ছিলো। সমস্যা বাঁধলো একটি ব্যাগ নিয়ে।
গুলশানের যাত্রী নিজের ব্যাগ-পত্র নামানোর সময় দেখেন সিএনজির পেছনে একটি ব্যাগ পড়ে আছে। যা তার নয়। চালক সুরুজ আলীও জানেন না, সেটি কার। কে ফেলে গেছেন?
সুরুজ আলী ভাবলেন- একটু আগেই হেয়ার রোডে বিচারপতি বাসভবনের সামনে যাত্রী নামিয়ে এসেছেন। তিনিই সম্ভবত ব্যাগটি ফেলে গেছেন। খোঁজ নিতে সেখানে গেলেন সুরুজ আলী। বিচারপতি বাসভবনের সামনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের খুলে বললেন ঘটনাটি। তারা বললেন- ব্যাগটি যারই হোক, রেখে যান, কেউ খুঁজতে এলে দিয়ে দিবো।
পুলিশের কথা মনঃপুত হয়নি সুরুজ আলীর। মনে মনে ভাবলেন, এ শহরে বিশ্বাস ও ভরসা করার মানুষ কই? অগত্যা নিজেই খুঁজতে বেরিয়ে গেলেন ব্যাগের মালিককে। কিন্তু, ততক্ষণে রাত বেড়ে গেছে অনেক।
তখন পর্যন্ত ব্যাগটি একটিবারের জন্যও খুলে দেখেননি সুরুজ আলী। নিজের বাসাতেও নিয়ে যাননি। চটের বস্তায় মুড়িয়ে সেটিকে সিএনজির সিটের নিচে লুকিয়ে রাখলেন। পরদিন ভোরে আবার বের হলেন ব্যাগ হারানো ব্যক্তির খোঁজে। তবে এবার খুললেন সে ব্যাগ। দেখলেন তাতে রয়েছে একটি নোটপ্যাড, নগদ টাকা, জমি সংক্রান্ত ও অফিসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র।
সেসব কাগজের একটি পড়ে সুরুজ আলী দেখলেন, তাতে একেএম শামসুজ্জামান নামের এক ব্যক্তির স্বাক্ষর রয়েছে। আর রয়েছে সম্প্রসারিত রূপনগর আবাসিক এলাকার ঠিকানা। পরক্ষণেই মনে পড়লো, গতকাল তো সেখানেই দুই ব্যক্তিকে নামিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
যেই ভাবা সেই কাজ। সোজা রূপনগরে চলে গেলেন সুরুজ আলী। দুপুরে সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে কর্মরত নিরাপত্তারক্ষীদের জানালেন ঘটনাটি। তারাও ব্যাগ হারানোর ঘটনার ব্যাপারে অবগত ছিলেন। আর তখনও নিজের কাজে সেখানেই অবস্থান করছিলেন ব্যাগের মালিক একেএম শামসুজ্জামান। অবশেষে সুরুজ আলী তার সাক্ষাত পেলেন। হারানো জিনিসপত্র ঠিকঠাক ফিরিয়ে দিলেন মালিককে।
একজন সিএনজি-চালকের সততার এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখে হতবাক হয়ে যান বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক একেএম শামসুজ্জামান। সঙ্গে সঙ্গে সুরুজকে নিয়ে যান নিজের বাসায়। পরিবারের সদস্যদের কাছে সুরুজ সম্পর্কে বললেন- “দেখো, এ শহরে এখনও এমন মানুষ আছেন!”
সুরুজ আলীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে পুরস্কৃত করেছেন একেএম শামসুজ্জামান। সুরুজের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।
একেএম শামসুজ্জামান বললেন, “ঘটনাটি গত ২০ জানুয়ারির। ওইদিন সকাল ১০টার দিকে আমি লালমাটিয়া থেকে সিএনজিতে উঠি। টেকনিক্যাল থেকে আমার এক সহকর্মীও উঠে। আমরা রূপনগরে নেমে যাই। আমাদের দুজনের সঙ্গেই কয়েকটি ব্যাগ ছিলো। একটি ব্যাগ যে সিএনজির পেছনে রয়ে গেছে, তখন আর তা মনে পড়েনি। যখন মনে পড়লো, ততক্ষণে সিএনজিটাকে আর খুঁজে পাইনি।”
ব্যাগে একটি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস (নোটপ্যাড), নগদ ২৪ হাজার টাকা, সম্প্রসারিত রূপনগর আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র ছিলো বলে জানিয়েছেন একেএম শামসুজ্জামান।
তিনি বললেন, “ব্যাগটি হারিয়ে মুষড়ে পড়েছিলাম। না পেলে অনেক ক্ষতি হয়ে যেতো।”
“আমাদের সমাজে এখনও এমন আদর্শিক মানুষ আছেন, এ ঘটনার আগে এমন কথা ভাবতেও পারতাম না। সুরুজ আলী আমার সে ভাবনার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। আশা করি, সুরুজের গল্প যারাই শুনবেন, তাদেরও প্রান্তিক মানুষদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তন হবে,” বললেন একেএম শামসুজ্জামান।
এ ঘটনার পর দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় সুরুজ আলীর। “ব্যাগটি ফিরিয়ে দিলেন কেনো?” এমন প্রশ্নের উত্তরে তার সোজাসাপ্টা জবাব, “যার হারায়, সে বুঝে। তাই মনে করলাম, ব্যাগটা ফিরায়ে দেওয়া দরকার। এ আর এমন কী!”
তিনি বললেন, “ব্যাগ খুলে দেখলাম ল্যাপটপ। জমিজমার কাগজ। এসব দিয়ে আমি কী করবো? নগদ টাকাও আছিলো। কিন্তু টাকার কাছে নিজের চরিত্রকে ছোট করতে চাই নাই।”
“আমার বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার জামষাট গ্রামে। অভাবের কারণে ৩০-৩২ বছর আগে ঢাকায় চলে আসি। তারপর থেকেই বেবিট্যাক্সি-সিএনজি চালাই। এমন অনেক ঘটনা আমার সঙ্গে আগেও হয়েছে। কোনো প্রতিদানের আশায় আমি এসব করি না,” বলছিলেন সুরুজ।
সিএনজি-চালকদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি? জানতে চাইলে সুরুজ বলেন, “শুধু সিএনজি-চালক কেনো, এ শহরের প্রতিটি যানবাহন চালকের প্রতি আমার আহ্বান- যাত্রীরা আপনাদের আশীর্বাদ। তাদের জানমালের হেফাজত করা আপনার একান্ত কর্তব্য।”