রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় সক্রিয় রয়েছে সিএনজিকেন্দ্রিক দুটি ভয়ংকর ছিনতাই ও কিলিং গ্রুপ। তারা ছিনতাইয়ের আড়ালে মানুষ খুন করে ফেলে রাখত বিভিন্ন ফ্লাইওভার ও ব্যস্ত রাস্তার পাশে। ছিনতাইয়ে বাধা দিলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে বাসের নিচে পিস্ট করে মেরে ফেলত।
এ চক্রের অনেকেই ৫-৬ মাস ধরে প্রায় ৬০০ ছিনতাই করেছে। অনেকেই আছে যারা প্রায় ৩-৪ বছর ধরে ছিনতাই করছে। আবার অনেকেই ২০০০-২৫০০ ছিনতাই করেছে। রাত ৮টায় বের হয়ে সূর্যোদয় পর্যন্ত কমপক্ষে একটি থেকে সর্বোচ্চ ছয়টি পর্যন্ত ছিনতাই করার রেকর্ড আছে তাদের।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন ফ্লাইওভার থেকে চারটি মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অধিক্ষেত্রের বাইরে দুটি এলাকায় গত দুই মাসে তারা আরও চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ছিনতাইয়ের পর অজ্ঞান বা অর্ধমৃত অবস্থায় ৩০-৪০ জন যাত্রীকে বিভিন্ন ফ্লাইওভার বা নির্জন অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে সিএনজি থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ৮-১০ জন বাস-ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও জোনের ফেসবুকে পেজে এক পোস্টে এ ধরনের এক লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়া হয়েছে। পোস্টটি তুলে ধরা হলো।
‘‘৫ জানুয়ারি, ২০২০ রাত অনুমান ১.১২ ঘটিকায় অজ্ঞাত একজন পথচারী হাতিরঝিল থানার অফিসার ইনচার্জের অফিসিয়াল মোবাইল নম্বরে ফোন করে জানায়, ‘মগবাজার ফ্লাইওভারের উপরে সোনারগাঁও প্রান্তে রেলক্রসিং বরাবর পড়ে আছে এক যুবকের লাশ’। মুহূর্তেই হাতিরঝিল থানা পুলিশ চলে যায় ঘটনাস্থলে। ঘটনাস্থলে হাজির হলেন তেজগাঁও বিভাগের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ।
ঠোঁটে একছোপ রক্তছাড়া সারা শরীরে কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। ফ্লাইওভারের যে অংশে মৃতদেহটি পড়েছিল, সেখান থেকে সোনারগাঁও ক্রসিং এবং হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী যে প্রান্তে উঠতে হয় ফ্লাইওভারে, পুরো এলাকা খোঁজা হলো তন্নতন্ন করে। যদি মৃতদেহের পরিচয় শনাক্তকরণের কোনো আলামত পাওয়া যায়!
রাত ২.২৫ ঘটিকায় ফ্লাইওভারের উপরে রেইনবো ক্রসিং থেকে সোনারগাঁও প্রান্তের দিকে সামান্য এগোতেই ফ্লাইওভারের রেলিং ওয়াল ঘেঁষে একটি মানিব্যাগ পাওয়া গেল। মানিব্যাগে পাওয়া গেল একটি জাতীয় পরিচয়পত্র ও জব আইডি কার্ড। জাতীয় পরিচয়পত্র ও জব আইডি কার্ডের ছবির সাথে মেলানো হলো মৃতদেহের মুখাবয়বের। শনাক্ত হলো মৃতদেহটি।
মিজানুর রহমান। বয়স ২৫ বছর। লক্ষ্মীপুর জেলার সদর থানাধীন ছবিলপুর গ্রামে তার জন্ম। তার বাবা আমির হোসেন পেশায় মুদি দোকানদার। বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাত্র মিজানুর রহমান রাজধানীর শেওড়া এলাকায় একটি মেসে থাকত। পড়াশোনার পাশাপাশি বনানীতে অবস্থিত হোটেল ‘গোল্ডেন টিউলিপ’ এর ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ শাখায় ওয়েটার হিসেবে কাজ করত মিজানুর রহমান। নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে অবশিষ্ট টাকা পাঠাত গ্রামে। মুদি দোকানদার বাবাকে।
গত ২৩ জানুয়ারি টঙ্গী থেকে নুরুল ইসলাম এবং ২৫ জানুয়ারি গাজীপুরা ও তুরাগ থেকে আবদুল্লাহ বাবু ও জালালকে গ্রেফতার করে পুলিশ
ফেব্রুয়ারিতে জাপান যাওয়ার কথা ছিল তার। জাপানি ভাষা শেখার কোর্স কমপ্লিট করেছিল। পাসপোর্টও করে ফেলেছিল। জাপানে কোনো হোটেলে ভালো বেতনে চাকরি করে ঘুচাতে চেয়েছিল মা-বাবার নিত্যকার অভাব-অনটন। অভিনয়েও তার আগ্রহ ছিল যথেষ্ট। মান্না, ডিপজল ও ওমর সানিকে নকল করতে পারত হুবহু।
তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুকের নেতৃত্বে এসি মঈনুল ইসলাম, হাতিরঝিল থানার ইন্সপেক্টর মহিউদ্দীন, এসআই মবিন, এসআই খায়রুল এএসআই তরিকের একটি টিম গত ২৩ জানুয়ারি রাত ৮.২৫ ঘটিকায় টঙ্গী এলাকা থেকে নুরুল ইসলাম এবং ২৫ জানুয়ারি গাজীপুরা ও তুরাগ এলাকা থেকে আবদুল্লাহ বাবু ও জালাল নামে তিনজনকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারকৃত নুরুল ইসলাম মূলত সিএনজিচালক। সিএনজি চালনার আড়ালে তার মূল পেশা ছিনতাই। নুরুল ইসলামসহ আরও আটজন মিলে তারা গড়ে তুলেছে সিএনজিকেন্দ্রিক দুটি ভয়ংকর ছিনতাই ও কিলিং গ্রুপ। রাত ৮টার পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত আশুলিয়া, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা, গুলশান, ভাটারা, খিলক্ষেত, বাডডা, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, রামপুরা, ৩০০ ফিট, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, সাইনবোর্ড এলাকা চলতে থাকে তাদের অপকর্ম।
গ্রেফতারকৃত নুরুল ইসলাম জানিয়েছে, সে ৫-৬ মাস ধরে প্রায় ৬০০ ছিনতাই করেছে। তার সহযোগী ৫-৬ জন আছে যারা প্রায় ৩-৪ বছর ধরে ছিনতাই করছে। অনেকেই ২০০০-২৫০০ ছিনতাই করেছে। রাত ৮য় বের হয়ে সূর্যোদয় পর্যন্ত কমপক্ষে একটি থেকে সর্বোচ্চ ছয়টি পর্যন্ত ছিনতাই করার রেকর্ড আছে। জিজ্ঞাসাবাদে নূরুল ইসলাম, জালাল ও আবদুল্লাহ বাবু যে তথ্য দিয়েছে তা রীতিমতো লোমহর্ষক।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর ভিন্ন ভিন্ন ফ্লাইওভারে পাওয়া গেছে চারটি মরদেহ। প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের ধরন একই রকম। সবার গলায় গামছা বা মাফলার পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত ১০ ডিসেম্বর আক্তার হোসেন নামের এক স্বর্ণকারকে হত্যার পর মরদেহ ফেলে রাখা হয় কুড়িল ফ্লাইওভারে। ৩১ ডিসেম্বর খিলক্ষেত ফ্লাইওভারে ওঠার পথের ডানপাশে এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির মরদেহ পাওয়া যায়। ৩ জানুয়ারি কুড়িল বিশ্বরোড সংলগ্ন ফ্লাইওভারে মনির হোসেন নামে এক ব্যক্তির মরদেহ পাওয়া যায়। সর্বশেষ ৬ জানুয়ারি মগবাজার ফ্লাইওভারের উপরে সোনারগাঁও প্রান্তে রেলক্রসিং বরাবর মিজানুর রহমানের মরদেহ পাওয়া যায়।
গ্রেফতারকৃত নূরুল ইসলাম ও তার সহযোগী দুই ছিনতাইকারী চারটি হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে আদালতে স্বীকারাক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে নূরুল ইসলাম। মূলত সিএনজিতে যাত্রী হিসেবে উঠিয়ে ছিনতাইয়ে বাঁধা দেয়ায় তাদের হত্যা করা হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অধিক্ষেত্রের বাইরে দুটি এলাকায় গত দুই মাসে তারা আরও চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে নূরুল ইসলাম স্বীকার করেছে।
পাশাপাশি ছিনতাইয়ের পর অজ্ঞান বা অর্ধমৃত অবস্থায় ৩০-৪০ জন জন যাত্রীকে বিভিন্ন ফ্লাইওভার বা নির্জন অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে সিএনজি থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে বলে স্বীকার করেছে নূরুল ইসলাম। এদের মধ্যে ৮-১০ জন বাস-ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে।
এ চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেফতারের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।