লিখেছেন সি আর আবরার
বাংলাদেশের সংসদের ইতিহাসে ‘বিশেষ দিন’ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি। সেদিন সংসদের অধিবেশনে ধর্ষণ (যা সাম্প্রতিক সময়ে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে) বন্ধে ধর্ষকের শাস্তি ‘ক্রসফায়ার’ করার দাবি জানিয়েছে সরকার ও বিরোধীদলের পাঁচ সংসদ সদস্য। এছাড়া ধর্ষণের ঘটনা কেন বাড়ছে এবং এটি বন্ধে কী করা যায় সেই বিষয়ে আলোচনার জন্যও একটি দিন নির্ধারণের জন্য স্পিকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
এক প্রতিবেদনে পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এই প্রতিবেদনেরই প্রতিক্রিয়ায় দেশে প্রচলিত ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন সংশোধনের কথা জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) এক সংসদ সদস্য। তার মতে, ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে আজীবন সাজা ধর্ষণের মতো ঘটনা কমাতে কখনই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না।
তিনি বলেছেন, ‘‘ধর্ষণের প্রচলিত আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা উচিত।’’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘‘মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আপনি ক্রসফায়ারের অনুমতি দিচ্ছেন। তবে ধর্ষণের ঘটনায় কেন দিচ্ছেন না?’’
দেশে চলমান বিভিন্ন ধর্ষণ মামলার বিচারে সাক্ষী না পাওয়ার ক্রমাগত যে সমস্যা, সেটির সমাধানে জাপার আরেক সংসদ সদস্য বলেছেন, ‘‘সমাজ থেকে ধর্ষণ ভীতি দূর করতে হলে ক্রসফায়ারেই যেতে হবে।’’ যেসব মানবাধিকার কর্মীরা বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে কাজ করে, তাদের কটাক্ষ করে তিনি বলেছেন, “আপনি তখনই ধর্ষণের কষ্ট বুঝতে পারবেন যখন আপনি, আপনার মা কিংবা বোন ধর্ষণের শিকার হবেন।” তিনি আরও বলেছেন, ‘‘ধর্ষকদের যদি ক্রসফায়ারে নেওয়া হতো, তাহলে ধর্ষণের সাম্প্রতিক এ ঘটনাগুলো ঘটতো না।’’
সংসদের অধিবেশনে জাপা এমপি বলেন, ‘‘১০-১২ ধর্ষককে ক্রসফায়ারে নিয়ে হত্যা করলেই ধর্ষণের ঘটনা কমে আসবে।’’
বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে যাদের মনে দ্বিধা আছে, সেটি দূর করতে তরিকত ফেডারেশনের এক এমপি বলেছেন, ‘‘আমি এইটুক বলতে পারি যে, ধর্ষকদের ক্রসফায়ার করলে কোনো পাপ হবে না। বরং বেহেশতে যাওয়া যাবে।’’
ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে দিতে বিরোধীদলের এমপিদের যে দাবি, সেটির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন সরকারপক্ষের এক এমপিও। সাবেক এই মন্ত্রী বলেছেন, ‘‘এটি সত্যি যে ধর্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের আরও কঠোর আইন দরকার। মাদকের বিরুদ্ধে লড়তে যদি আমরা ‘ক্রসফায়ার’ দিতে পারি, তাহলে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কেন এটি দিতে পারি না?’’
তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা যদি জানি যে সে ধর্ষক, সেই এই জঘন্য কাজ করেছে, তার আর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।’’
ধর্ষকের শাস্তির ব্যাপারে বিরোধী এমপিদের যে অভিব্যক্তি এবং এটির প্রতি সরকারি দলের এমপির যে সমর্থন, সেটি আইন অবমাননার বহিঃপ্রকাশ।
বিশ্বব্যাপী আইনের সার্বজনীন কিছু তত্ত্ব রয়েছে। যেমন, ‘ন্যায়বিচার চর্চা’, ‘যথাযথ প্রক্রিয়া’, ‘প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত না করা’, ‘আইনের শাসন’। কিন্তু আমাদের এমপিদের যে দাবি সেটি এসব সর্বজনীন তত্ত্বের বিরোধী। সংসদের মতো জায়গায় দাঁড়িয়েই আমাদের এমপিরা এসব ‘অবজ্ঞা’ করলেন। অথচ কেউই তাদের বিরোধিতা করলেন না।
আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার দেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘‘আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ প্রত্যেক নাগরিকের অবিচ্ছেদ্য অধিকার।’’
৩২ অনুচ্ছেদে আরও আছে, “আইনানুযায়ী ব্যক্তি স্বাধীনতা হতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না”
একটি রাষ্ট্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্যেক কর্মকর্তাই রাষ্ট্রের আইনের প্রতি সম্মান জানাতে এবং এটির সুরক্ষায় দায়বদ্ধ। দায়িত্ব গ্রহণের আগে স্পিকার ও এমপিরা ‘আইন অনুসারে বিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন’ বলেই শপথ নেন।
ক্রসফায়ারকে বৈধতা দিতে এমপিরা যে দাবি জানালেন, এ ধরনের দাবি প্রকাশ্যে দেশের সংবিধান ও আইন লঙ্ঘনের সামিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই এমপিদের দলের নেতারা ছিলেন নীরব।
দেশের সংবিধান অনুযায়ী সংসদের প্রধান হচ্ছেন স্পিকার। তিনিই সেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, এমপিদের এমন দাবি করাটা যে ভুল, সেটি নিয়ে তাদের কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করেননি স্পিকারও।
এক্ষেত্রে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সেসময় এক এমপি শিশু ও নারী নিপীড়নকারীদের হত্যার দাবি জানালে তাকে তিরস্কার করেছিলেন ডেপুটি স্পিকার। ডেপুটি স্পিকার স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, ‘‘এ সরকার ক্রসফায়ারে বিশ্বাস করে না।’’ (তথ্যসূত্র- প্রথম আলো, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)
সংসদের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে এমপিদের এ ধরনের বেআইনি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এর বিরুদ্ধে কেউই কোনো জোরালো বক্তব্য দেননি। যা সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। সত্যিই ক্রসফায়ারের মতো কাজের বৈধতা দেওয়া হবে কী না, এ নিয়ে সাধারণ মানুষ রয়েছে দ্বিধায়।
এমপিদের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘এমপিরা সংসদে অনেক আবেগী বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এগুলোর সব বিবেচনায় নেওয়া যায় না।’’ অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘‘এটি তাদের ব্যক্তিগত মতামত। এতে আমাদের কোনো সমর্থন নেই।’’
সংসদে ১৪ জানুয়ারির এই অধিবেশন নানা ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এই পাঁচ এমপি (যাদের মধ্যে দেশের প্রবীণ নেতারাও রয়েছেন) আইনের শাসন বলতে কী বোঝায় তা বোঝার ব্যাপারে তাদের ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি আইনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধের অভাবও পরিস্কার ভাবে ব্যক্ত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এটি দেশের বিচার ব্যবস্থার বিরোধী। অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে কীভাবে বিদ্যমান আইনের সংশোধন করা দরকার, সেটি নিয়ে আলোচনার বদলে তারা সরাসরি অপরাধীকে হত্যা করার মতো কাজের বৈধতা চেয়েছেন।
তৃতীয়ত, এমপিদের এ ধরনের বক্তব্য ইঙ্গিত করে যে, আইনের বাইরে গিয়েও ‘ক্রসফায়ারের’ মতো ঘটনা ঘটানোর কিছু স্বাধীনতা দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী উপভোগ করে থাকে।
সবশেষে, সংসদের মতো জায়গায় এমপিদের এ ধরনের বক্তব্যের পরেও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতাই প্রমাণ করে, দেশের আইনের যথাযথ প্রয়োগে স্বাধীন তদন্ত, নৈতিকতা ও জবাবদিহিতা অনুপস্থিত।
এমপিদের এমন বক্তব্য আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নীতির ওপর তাদের আনুগত্যের গভীরতাও প্রকাশ করে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এ ধরনের বক্তব্য অভিযুক্ত অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে অবৈধ পদক্ষেপ নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উৎসাহিত করবে। যার ফলে এক সময় বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাবে মানুষ।
বর্তমানে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশের আইন ব্যবস্থা যথাযথ প্রতিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং দায়িত্ববান ব্যক্তিরা আইন লঙ্ঘনের মতো ব্যবস্থা গ্রহণে সমর্থন দিচ্ছে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রচলিত আইন সংশোধন করা, যাতে ধর্ষণের মতো অপরাধ বন্ধ হয়, সেটি নিয়ে আলোচনা না করে, সংসদে পাঁচ এমপির ‘ক্রসফায়ার’ দাবি কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ বন্ধ করতে বিচার ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন নিয়ে সংসদে আলোচনার বদলে তারা কি আইনের শাসনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছেন না?
সি আর আবরার: শিক্ষাবিদ ও অধিকার কর্মী