লিখেছেন মুহাম্মদ নুরুল হুদা
অস্বীকার করার উপায় নেই যে বর্তমান সরকার পুলিশের বহুদিনের বিভিন্ন দাবি পূরণ করে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা বলবেন যে পুলিশের মর্যাদা সরকারের দৃষ্টিতে উন্নীত হয়েছে। তবে সমাজে তাদের আসল মর্যাদা নির্ভর করে জনসাধারণের সঙ্গে তাদের আচরণ ও কাজ করার ওপর। অন্য কথায়, মূল বিষয়টি হলো, পুলিশ আইন যাচাই বাছাই না করেই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ দেখবে নাকি তারা জনসাধারণের অর্থে পরিচালিত সত্যিকারের সরকারি কর্মচারী হিসাবে কাজ করবে।
উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া সহজ হবে না। কারণ বিশ্বের এই অঞ্চলে পুলিশের পেশাটি এখনও সম্মানজনক পেশা হতে পারে নি। আর কেনো হতে পারেনি তার কারণগুলো সকলেরই জানা। এটি অবশ্য নিরপেক্ষ পেশাদার পুলিশ সংস্থার গুণাবলী সম্পর্কে জানতে বা বুঝতে এর নিয়ন্ত্রকদের কোনো বাধা সৃষ্টি করেনি। বাস্তবতা হলো, তাদের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাগুলো পর্যাপ্ত না।
যার কারণেই দেখতে পাবেন জনসাধারণের পুলিশের ওপর নির্ভর করার কথা থাকলেও তারা তা করে না। জনসাধারণ যদি তাদের বিশ্বাস করেও, আইন করে না। এটি পুলিশকে একটি ভিন্ন রকমের পরিস্থিতিতে ফেলেছে। পুলিশ ও জনসাধারণের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি হয়ে আসছে ঐতিহাসিক ভাবেই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াতে পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এমন আইন তৈরি করা হয়েছিলো যাতে ঔপনিবেশিক দখল চিরকালের জন্য বজায় থাকে।
যখন পুলিশ সংগঠিত হয়েছিলো তখন তাদের নিম্ন মর্যাদা এবং স্বল্প বেতনের সঙ্গে আরও বেশি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। যাতে তারা সত্যিকার অর্থে জনগণের সেবা না করে জনগণকে যারা শাসন করছে তাদের সেবা করতে পারে। আমাদের দেশে পুলিশের বিবর্তনের অবস্থান বুঝতে হলে এই পটভূমিটি অবশ্যই স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে। একটি বিষয়ে সবার একই মত রয়েছেন, আর তা হলো পুলিশকে অপব্যবহার করা হয়েছে। যার ফলে আইনের শাসনের অবনতি হয়েছে এবং পুলিশের প্রতি অবিশ্বাস বাড়ছে। এই অবস্থানটি সরাসরি সম্মানের প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে চলে আসা অপরাধ, প্রমাণ এবং কার্যবিধির আইনগুলো একটি সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষার জন্য তৈরি করা। অথচ সেগুলোই এখনও আমাদের পুলিশ বাহিনীর প্রতিদিনের কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। প্রশ্নটি হচ্ছে, কোনো ঔপনিবেশিক পুলিশ কী একটি মুক্ত সমাজের মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারে? এটি বলা বাড়াবাড়ি হবে না যে সংস্কারের বেশিরভাগ প্রচেষ্টা রাজনৈতিক এবং তথাকথিত সিভিল সার্ভিসের বাধার মুখে পরেছে। আমাদের সমাজ পুলিশ সদস্যদেরকে বিদ্রূপ ও অবজ্ঞার সঙ্গে দেখে এবং সে অনুযায়ীই তাদের সঙ্গে আচরণ করে। তারা কিছুটা বুঝতে পারে যে আইনের অভিভাবকদের মতোই “বৈজ্ঞানিক তদন্ত” এবং “পরিষ্কার জিজ্ঞাসাবাদ” বলে কিছুই নেই।
ফৌজদারি কার্যবিধি এবং সাক্ষ্য আইন পুলিশ কর্মকর্তাদের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখে। যা তাদের মনোবল ও দক্ষতা কমিয়ে দেয়। এটা তাদের চরিত্রকেও প্রভাবিত করে। বিবেচনার বিষয় হলো যেখানে দেশের আইন পুলিশকে বিশ্বাস করে না সেখানে জনগণ কি করে তাদের বিশ্বাস করতে পারে। পুলিশের প্রতি এই অবিশ্বাস যে শুধু সকলের জানা আছে তাই নয়, প্রতিদিন দেশব্যাপী আদালতগুলোতে তা প্রকাশ করা হয়। সুতরাং, পুলিশ কর্মকর্তাদের আংশিকভাবে প্রমাণাদি উপস্থাপন করা অস্বাভাবিক কিছু না। কারণ তারা যা করে এবং যা বলে তা সন্দেহজনকভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। বিশ্বাসযোগ্য না হলে পুলিশ কীভাবে কাজ করতে পারে?
আমাদের দেশে পুলিশের নেয়া সাক্ষীদের জবানবন্দিতে তাদের স্বাক্ষর করার অপ্রয়োজনীয়তার আইনটি বজায় রেখেছে। পুলিশ অফিসারের সামনে করা স্বীকারোক্তি প্রমাণ হিসাবে গ্রহণযোগ্য না। বিভিন্ন সময়ে পুলিশের অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান গ্রহণযোগ্য হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তির কোনও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদালতের কাছে সন্দেহযুক্ত। কেবলমাত্র সাক্ষীর স্বতন্ত্র প্রমাণের ভিত্তিতে কাওকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি পুলিশ অফিসার হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ বা ডাকাতির মতো অপরাধে একমাত্র সাক্ষী হন তাহলে শুধুমাত্র তার সাক্ষীর ভিত্তিতে কাওকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।
থানায় অভিযোগকারীদের সঙ্গে প্রায়শই দুর্ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য করার প্রবণতা আছে। পুলিশকে যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের প্রতি সহানুভূতির মনোভাবে তাদের ঘাটতি থাকে। পুলিশকর্মীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বুঝতেই পারেন না যে থানায় অভিযোগ নিয়ে আসা ব্যক্তি সাধারণত একজন আক্রান্ত ব্যক্তি হন। তিনি অনেকটা ডাক্তারের কাছে যাওয়া রোগীর মতো। তাদের সঙ্গে যে কোনও খারাপ আচরণ করা মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন হিসাবে গণ্য। পুলিশের অন্যান্য সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে টহলরত অবস্থায় সাধারণ মানুষকে মৌখিক নির্যাতন এবং অযৌক্তিক আচরণ, গ্রেপ্তারের সময় নিরীহ ব্যক্তিদের হয়রানি করা, ট্র্যাফিক লঙ্ঘনকারীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা ইত্যাদি।
পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উচিত পুলিশ সদস্যদের প্রয়োজনীয় আচরণগত পরিবর্তন আনার প্রতি চেষ্টা করা। যদি পুলিশের জন্য করা নিয়মকানুন ও পুলিশকে উন্নত করা হয় এবং পুলিশ বাহিনীকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় তাহলে পুলিশের আচরণে আশানুরূপ পরিবর্তন আসতে পারে। তখন তাদেরকে সবাই বিশ্বাস করতে পারবে।
ক্রমবর্ধমান সহিংসতা, অপরাধের ধরণ পরিবর্তন, অপরাধে আরও নতুন নতুন অস্ত্রের ব্যবহার এবং নিরাপত্তাহীন পরিবেশে পুলিশকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ক্ষমতা দেওয়া আইনগুলো পর্যালোচনার দাবি রাখে। আমাদের (ক) বহিরাগতদের হাত থেকে পুলিশকে মুক্ত করতে হবে; (খ) পুলিশকে জনগণ ও আইনের কাছে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে; (গ) অন্ততপক্ষে সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এমন বিশ্বাসযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত করা যাতে তারা জবানবন্দি নিতে পারে; (ঘ) নাগরিকের দৃষ্টিতে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে; এবং (ঙ) একটি স্বাধীন এজেন্সির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ এবং বাহ্যিক তদারকির মাধ্যমে পুলিশের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো অবিশ্বাসযোগ্য কোনও সংস্থাকে হঠাৎ করে বিশ্বাসযোগ্য করতে পারবে বলে হয়তো আপাতো দৃষ্টিতে মনে হবে না। কিন্তু, এখন অন্য কোনও বিকল্পও নেই। চরিত্র এবং নৈতিকতা যেভাবে হ্রাস পাচ্ছে, শিক্ষিত মানুষ যেভাবে আইন লঙ্ঘন করে, তা আমাদের কঠোর কিছু করতে বাধ্য করে। পুলিশের প্রতি যখন আস্থা ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তখন তার যথাযথ প্রতিক্রিয়াও পাওয়া যায়। আমরা আশা করি, এই আস্থার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারবো।
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: সাবেক আইজিপি।