লিখেছেন আবরার আবদুল্লাহ
২০১৯ সাল মুসলিমবিশ্বের জন্য একটি হতাশা ও সংকটময় বছর ছিল। নানা ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সংকটের মধ্য দিয়ে মুসলিমবিশ্বকে যেতে হয়েছে এই বছর। পূর্ববর্তী বছরগুলোয় জন্ম নেওয়া সংকট আরো তীব্র হয়েছে এই সময়ে। পশ্চিমে মরক্কো, পূর্বে চীন, দক্ষিণে নিউজিল্যান্ড আর উত্তরে সুইডেন পর্যন্ত পুরো পৃথিবীতে মুসলিমরা নানা ধরনের বৈষম্য ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে। এক ধরনের শঙ্কা আর অস্বস্তি নিয়েই তারা বছর শেষ করেছে।
১. পুলওয়ামায় ভয়াবহ হামলা ও পাক-ভারত রাজনৈতিক উত্তাপ
১৪ ফেব্রুয়ারি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে। এতে সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্সের ৪০ জোয়ান নিহত হয়। ভারতের দাবি, এ হামলার পেছনে পাকিস্তানের মদদ ছিল। এ ঘটনায় পাক-ভারত সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয় এবং সামরিক তৎপরতায় কাশ্মীরের জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের বিমানবাহিনী পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বালাকোটে হামলা চালায়। ২৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বিমানবাহিনী পাল্টা হামলা চালায়। এই পাকিস্তানি বিমান ধাওয়া করে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হন ভারতীয় বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্ধমান। ১ মার্চ তাঁকে মুক্তি দেওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়।
২. নিউজিল্যান্ডের মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা
২০১৯ সালে মুসলিমবিশ্বের জন্য সবচেয়ে বিষাদপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৫ মার্চ শুক্রবার ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদে চালানো এই হামলায় ৫০ জন মুসল্লি নিহত হন। তাঁরা জুমার নামাজের জন্য সমবেত হয়েছিলেন। হামলার অভিযোগে ব্রেন্টন টারান্ট (২৮) নামের এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে ব্রেন্টন কাছাকাছি লিনউড মসজিদে হামলা চালান। নিহতদের মধ্যে পাঁচজন বাংলাদেশিও ছিলেন। ভয়ংকর এই হামলায় নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের নাগরিক মুসলমানদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে শোক জানায়। রাষ্ট্রীয়ভাবেও পালিত হয় এই শোক।
৩. আল্লামা তাকি উসমানির ওপর হামলা
২২ মার্চ পাকিস্তানের বিশিষ্ট আলেম আল্লামা তাকি উসমানির ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়। হামলার সময় গাড়িতে তাঁর স্ত্রী ও এক নাতিও ছিলেন। হামলা থেকে তাঁদের জীবন রক্ষা হলেও দুই নিরাপত্তারক্ষী মারা যান।
৪. ব্রুনেইয়ে শরিয়াহ আইন
২২ অক্টোবর ২০১৩ সালে ছোট্ট দেশ ব্রুনেই ইসলামী শরিয়াহ আইনের পথে হাঁটতে শুরু করে। ৩০ এপ্রিল ২০১৪ সালে সুলতান হাসান আল বালখিয়া শরিয়াহ দণ্ডবিধি বাস্তবায়ন করেন। সেই ধারাবাহিকতায় ৩ এপ্রিল ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক একাধিক আইন কার্যকর করা হয়।
৫. চেচনিয়ায় ইউরোপের বৃহত্তম মসজিদ
২৩ আগস্ট রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল চেচনিয়ায় উদ্বোধন করা হয় ইউরোপের সর্ববৃহৎ মসজিদ। চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনির শালি শহরে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে কুয়েতের অর্থায়নে। ৯ হাজার ৭০০ বর্গমিটার জমির ওপর নির্মিত মসজিদে একসঙ্গে ৩০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। মসজিদের নামকরণ হয়েছে ফখর আল মুসলিমিন বা মুসলমানের গর্ব।
৬. আসামের এনআরসি
৩১ আগস্ট চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পর অসন্তোষের সূচনা হয় আসাম প্রদেশে। এই তালিকা থেকে বাদ পড়ে ১৯ লাখের বেশি বাসিন্দা; যার মধ্যে ১১ লাখ হিন্দু বাঙালি, ছয় লাখের মতো মুসলিম এবং বাকি দুই লাখ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। ডিসেম্বরে ভারতীয় পার্লামেন্টে সংশোধিত নাগরিক আইন পাস হওয়ার পর ‘বৈষম্যমূলক’ হওয়ার অভিযোগে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
৭. পাকিস্তানে সরকারবিরোধী আজাদি মার্চ
পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতা মাওলানা ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় সরকারবিরোধী আজাদি মার্চ। তিনি পাকিস্তানের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের অভিযোগ করেন। তাঁকে সমর্থন দেন পাকিস্তানের অন্য বিরোধীদলীয় নেতারা।
৮. নরওয়েতে কোরআন পোড়ানোর চেষ্টা ও মুসলিমবিশ্বে ক্ষোভ
২৫ নভেম্বর নরওয়ের ‘ইসলামবিদ্বেষী’ সংগঠন ‘স্টপ ইসলামাইজেশন অব নরওয়ে’ (এসআইএন) ক্রিশ্চিয়ানসান্ড শহরে ইসলামবিরোধী বিক্ষোভের আয়োজন করে। এতে এক যুবক কোরআন অবমাননা ও তাতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে। পাকিস্তানি যুবক ওমর ইলিয়াস এ ঘটনার তাত্ক্ষণিক প্রতিবাদ করেন এবং তাতে বাধা দেন। এ ঘটনার পর বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ মুসলিমবিশ্বে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।
৯. আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে আলোচনায় গাম্বিয়া
১১ নভেম্বর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা দায়ের করে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। ওআইসির পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করে দেশটি। গাম্বিয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১০ ডিসেম্বর আদালতে শুনানি অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন শান্তিতে নোবেল পাওয়া অং সান সু চি। গাম্বিয়ার পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির আইনমন্ত্রী ও অ্যাটার্নি জেনারেল আবু বকর তামবাদু। একটি ছোট দেশ হয়েও সাহসী ভূমিকা গ্রহণের জন্য বিশ্ব মিডিয়ায় প্রশংসিত হয় গাম্বিয়া।
১০. কেমব্রিজের গ্রিন মসজিদের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য পুরস্কার
উদ্ভাবনী নকশার জন্য শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যের পুরস্কার লাভ করে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত গ্রিন মসজিদ। মসজিদটি যুক্তরাজ্যের স্থাপত্যশিল্প বিষয়ক একটি সম্মানজনক পুরস্কার ‘দ্য এজে আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ডস’-এর জন্য মনোনীত হয়। ২০ নভেম্বর ২০১৯ দ্য রয়াল টাউন প্ল্যানিং ইনস্টিটিউটস ইস্ট অব ইংল্যান্ড এই পুরস্কার ঘোষণা করে। ইউরোপের প্রথম পরিবেশবান্ধব মসজিদটি ২০১৯ সালের মার্চে উদ্বোধন করা হয়, যা নির্মাণে ব্যয় হয় ২৩ মিলিয়ন পাউন্ড। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত স্থপতি মার্কস বারফিল্ড ২০০৯ সালে গ্রিন মসজিদের ডিজাইন করেন। ২০১২ সালে শহর কর্তৃপক্ষ মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেয়। সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয়।