দীন ইসলাম: রোলেক্স, প্যাটেক ফিলিপ, জেএলসি বা ভ্যারেশন কন্সটান্টিন। বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হাতে শোভা পা”েছ এমন দামি ব্রান্ডের বিভিন্ন কালারের ঘড়ি। মাসে লাখ টাকা বেতন পেলেও সৎ দাবিদার একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর হাতে এমন দামী ব্রান্ডের ঘড়ি নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্’ানীয় এ নেতার অনৈতিক কর্মকান্ডে চারদিকে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বলাবলি হ”েছ, তাঁর কাছে থাকা সাতটি ঘড়ির মধ্যে একটির দাম এক বছরের আয়ের প্রায় সমান। নির্বাচনের সময় দেওয়া হলফনামায় এসব দামি ঘড়ি থাকার কথা উল্লেখ করেননি। দামি ব্রান্ডের একটি ঘড়ির বদলে ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন তিনি।
গেল মাসে ওবায়দুল কাদেরের ঘড়ি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে সুইডেনভিত্তিক একটি অনলাইন নিউজ পেপার। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্ত্রী কাদের যে ঘড়িণ্ডলো ব্যবহার করেন তার মধ্যে সাতটি বিশ্বখ্যাত ব্রান্ডের। এসব ঘড়ির বাজারমূল্য নয় থেকে ২৮ লাখ টাকা। প্রতিবেদনে ওবায়দুল কাদেরের ঘড়ির সাতটি ব্রান্ডের নাম ও দাম উল্লেখ করা হয়। বিদেশি অনলাইনে প্রকাশের পরই বাংলাদেশে হইচই শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাখ লাখ শেয়ার হয়েছে নিউজটি। তবে এরপরই থেকেই বাংলাদেশে উধাও সুইডেনভিত্তিক অনলাইন নিউজ পোর্টালটি। বাংলাদেশে এটি দেখা যা”েছ না। সুইডেনভিত্তিক অনলাইনে সংবাদ প্রকাশের পর কাতারভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল জাজিরা বিস্তারিতভাবে ওবায়দুল কাদেরের সংবাদ প্রকাশ করে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের কাছে দামী ঘড়ি থাকার বিষয়টি স্বীকার করে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আমার যত ঘড়ি আছে, একটাও আমার নিজের পয়সা দিয়ে কেনা না। ফর গড সেক বলছি, এণ্ডলো আমার কেনা না। আমি পাই। হয়তো আমাকে অনেকে ভালোবাসে। ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নেইনি। কনট্রাক্টররা ইলেকশনের সময় একটা অ্যামাউন্ট দিতে চেয়েছিল। আমি সরাসরি না করে দিয়েছি। আমাকে আমার ইলেকশনের টাকা প্রাইম মিনিস্টার নিজে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের এমন বক্তব্যকে অপর্যাপ্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্’া ট্টান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি)। এক বিবৃতিতে টিআইবি বলেছে, কাদেরের সামগ্রি যদি উপহার হিসেবে পাওয়া হয়ে থাকে, কেন সেণ্ডলো রাষ্ট্রীয় তোশাখানায় জমা দেওয়া হলো না। এমন হাজারো প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে ঘুরপাক খা”েছ।
এদিকে ২০১২ সালের জুনে হালনাগাদ করা তোশাখানা বিধি ১৯৭৪ অনুযায়ি, শুধুমাত্র বিদেশি বিশিষ্টজনদের থেকে একজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ৩০ হাজার টাকা বা তার কম মূল্যের উপহার গ্রহণ করতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে এই মূল্যমানের সীমা ৫০ হাজার টাকা এবং সংসদ সদস্যসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করা আছে। এর বেশি মূল্যমানের উপহার বা উপহারটি যদি দুর্লভ বস্‘ যেমন: পুরানো ছবি বা প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হয় তাহলে সেটা সাথে সাথে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগকে জানিয়ে তোশাখানায় জমা দিতে হবে। কোন অবস্’াতেই নিজের কাছে রাখা যাবে না বা ব্যবহার করা যাবে না। সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে যে তোশাখানা আছে সেখানে এই উপাহারণ্ডলো সাজিয়ে রাখার নিয়ম আছে, যেন সাধারণ মানুষ দেখার সুবিধা পায়। এছাড়া প্রেসিডেন্ট যেসব উপহার পান সেণ্ডলো বঙ্গভবনে সংরক্ষিত থাকে। কিছু উপহার যেমন বিভিন্ন তৈজসপত্র বা যন্ত্রপাতি সরকারি দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া অব্যবহৃত কিছু উপহার যেণ্ডলো ফেলে রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে কিংবা মূল্য হারিয়ে ফেলবে সেণ্ডলো নিলামে তোলা যেতে পারে, যার অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, দুর্লভ ছবি বা ভিডিওর মতো অমূল্য সম্পদণ্ডলো জাতীয় জাদুঘরে পূর্ণ নিরাপত্তা বলয়ে রাখতে বিধিতে বলা হয়েছে। কিছু পণ্য যদি বেশ মূল্যবান হয় এবং তোশাখানা থেকে গায়েব হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে প্রসিদ্ধ ব্যাংকের লকারে সরকারি অর্থায়নে সেণ্ডলো সংরক্ষণ করতে হবে। তোশাখানার জিম্মাদারের দায়িত্ব পালন করে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ। তারা মূলত ওইসব উপহার সংগ্রহ, মূল্য নির্ধারণ ও সংরক্ষণের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে থাকে এবং সার্বিক কাজে তাদের সহায়তা করে তোশাখানা মূল্যায়ন কমিটি। এর আগে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ প্রেসিডেন্ট থাকাকালে যেসব উপহার পেয়েছিলেন সেণ্ডলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দেয়ার কারণে, ঢাকার বিশেষ জজ আদালত তাকে তিন বছরের কারাদন্ড দিয়েছিল। যদিও হাইকোর্ট পরে সেই মামলা বাতিল করে দেয়।