লিখেছেন সানাউল্লাহ সাকিব, প্রথম আলো
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে কমপক্ষে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মালিকানায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। সেই চার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা এখন চরম খারাপ। একটি বিলুপ্তের পথে, বাকি তিনটিও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।
নানা কৌশল করে এসব প্রতিষ্ঠান দখল করেছেন মূলত একজন ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্য নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলেছেন, শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন, দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে টাকাও সরিয়েছেন। এমনকি দেশের বাইরেও কোম্পানি খুলেছেন।
আর এই ব্যক্তি হলেন প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। প্রতিষ্ঠানগুলো দখলের সময় পি কে হালদার প্রথমে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং পরে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। আর এসব কাজে তাঁকে সব ধরনের সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন—এই দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনেই সবকিছু ঘটেছে।
এখন পি কে হালদার পলাতক। আর আমানতকারীরা দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন টাকা ফেরত পাওয়ার আশায়। প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ৮ জানুয়ারি পি কে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দখলের ইতিবৃত্ত
পি কে হালদারের দখল করা প্রতিষ্ঠান চারটি হলো ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। এর মধ্যে গত বছরের জুলাইয়ে পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য অবসায়ক নিয়োগ করা হয়েছে। চারটি প্রতিষ্ঠান দখলে নিলেও কোনো প্রতিষ্ঠানেই পি কে হালদারের নিজের নামে শেয়ার নেই।
প্রশান্ত কুমার হালদার প্রতিষ্ঠান দখল ও অর্থ আত্মসাৎ করেছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনে। অনেক ক্ষেত্রে সমর্থনও পেয়েছেন।
প্রথম আলোর দুই মাসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সব শেয়ার অন্যদের নামে হলেও ঘুরেফিরে আসল মালিক পি কে হালদারই। নিজেকে আড়ালে রাখতে এমন কৌশল নেন তিনি। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে পি কে হালদার গড়ে তুলেছেন একাধিক প্রতিষ্ঠান, যার বেশির ভাগই কাগুজে। এর মধ্যে রয়েছে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, পিঅ্যান্ডএল অ্যাগ্রো, পিঅ্যান্ডএল ভেঞ্চার, পিঅ্যান্ডএল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, হাল ইন্টারন্যাশনাল, হাল ট্রাভেল, হাল ট্রিপ, হাল ক্যাপিটাল, হাল টেকনোলজি অন্যতম। এর বাইরে আনন কেমিক্যাল, নর্দান জুট, সুখাদা লিমিটেড, রেপটাইল ফার্মসহ আরও একাধিক প্রতিষ্ঠান।
কাগজে–কলমে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় আছেন পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার ও তাঁর স্ত্রী সুস্মিতা সাহা, খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারীসহ বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন। আবার ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফানউদ্দিন আহমেদ ও সাবেক সহকর্মী উজ্জ্বল কুমার নন্দীও আছেন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়।
এত দিন ধরে বহাল তবিয়তে থাকলেও পি কে হালদারের নাম সামনে আসে ক্যাসিনোবিরোধী সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানের সময়। এ সময় দুদক যে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে, তাঁদের মধ্যে পি কে হালদার একজন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ১৪ নভেম্বর হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছিল দুদক। তার আগে ৩ অক্টোবর তাঁর বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ঠিকই দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। বেশির ভাগ অর্থও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দুদকের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) পি কে হালদারের অর্থ লেনদেন নিয়ে এক বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করে। তাতেও তাঁর ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতির চিত্র উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পি কে হালদার ও তাঁর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হয় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের হিসেবে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, পি কে হালদারের হিসাবে ২৪০ কোটি টাকা এবং তাঁর মা লীলাবতী হালদারের হিসাবে জমা হয় ১৬০ কোটি টাকা। তবে এসব হিসাবে এখন জমা আছে মাত্র ১০ কোটি টাকার কম। অন্যদিকে পি কে হালদার এক ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকেই ২ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বের করে নিয়েছেন।
এ নিয়ে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এসব টাকা দিয়েই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা কেনা হয়। তবে ঋণ নেওয়া পুরো টাকার হদিস মিলছে না। নিয়ন্ত্রণ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্ষদে বসেছেন পি কে হালদারের একসময়ের সহকর্মী ও আত্মীয়রা। আর মালিকানা পরিবর্তনে সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কে এই পি কে হালদার
পি কে হালদারের জন্ম পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার দিঘিরজান গ্রামে। বাবা প্রয়াত প্রণনেন্দু হালদার ও মা লীলাবতী হালদার। তাঁর মা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পি কে হালদার ও প্রিতিশ কুমার হালদার—দুই ভাই–ই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে ব্যবসায় প্রশাসন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।
২০০৮ সাল পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিতে উপব্যবস্থাপনা (ডিএমডি) পরিচালক ছিলেন পি কে হালদার। ১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়েই ২০০৯ সালে তিনি রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হয়ে যান। এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই ভাই মিলে ভারতে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে কোম্পানি খোলেন ২০১৮ সালে, যার অন্যতম পরিচালক প্রিতিশ কুমার হালদার। কলকাতার মহাজাতি সদনে তাঁদের কার্যালয়।
আর কানাডায় পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিং ইনক নামে কোম্পানি খোলা হয় ২০১৪ সালে, যার পরিচালক পি কে হালদার, প্রিতিশ কুমার হালদার ও তাঁর স্ত্রী সুস্মিতা সাহা। কানাডা সরকারের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কানাডার টরন্টোর ডিনক্রেস্ট সড়কের ১৬ নম্বর বাসাটি তাঁদের।
পি কে হালদারের মুঠোফোন দুই মাস ধরে বন্ধ। প্রশ্ন লিখে হোয়াটসঅ্যাপ ও ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলেও কোনো উত্তর মেলেনি।
পি কে হালদারের এত টাকা
পি কে হালদারের নামে ব্যাংক এশিয়া, এনআরবি গ্লোবাল, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ কয়েকটি ব্যাংকের হিসাবে বিভিন্ন সময়ে জমা হয় ২৪০ কোটি টাকা। হাল ট্রাভেল (হাল ট্রিপ) এজেন্সির চেয়ারম্যান পি কে হালদার নিজে। বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা হাল ট্রিপের হিসাবে জমা হয় ৪০৭ কোটি টাকা। ফার্স্ট কমিউনিকেশনের পরিচালকও তিনি। এর ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ৮২৩ কোটি টাকা।
সুখাদা লিমিটেডে পি কে হালদারের শেয়ার ৯০ শতাংশ ও মা লীলাবতী হালদারের ৫ শতাংশ। এ হিসেবে ২০ কোটি ৪১ লাখ টাকা জমা হয়।
লীলাবতী হালদারের ৩টি ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ১৬০ কোটি টাকা। রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে নেওয়া ৩ গ্রাহকের ঋণের ৬৩ কোট টাকাও লীলাবতী হালদারের হিসাবে জমা হয়। ওই সময়ে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি ছিলেন পি কে হালদার। একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের হিসাবে এত টাকা জমা হওয়া নিয়ে কোনো ব্যাংক কখনোই প্রশ্ন তোলেনি।
ভাই প্রিতিশ কুমার হালদারের ব্যাংক হিসাবে ৫০ লাখ টাকা জমা থাকলেও তাঁর নামে রয়েছে হাল টেকনোলজি, হাল ট্রিপ টেকনোলজি, পিঅ্যান্ডএল হোল্ডিং, মাইক্রো টেকনোলজিস, নর্দান জুটসহ আরও নানা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ৫০০ কোটি টাকার বেশি জমা হয়, ঋণও রয়েছে।
কার টাকা, গন্তব্য কোথায়
ব্যাংক এশিয়ার ধানমন্ডি শাখায় পি কে হালদারের দুটি হিসাবে বিভিন্ন সময়ে ২৪৪ কোটি টাকা জমা হয়। এই হিসাব থেকে রিলায়েন্স ব্রোকারেজে যায় ২০৫ কোটি টাকা, লীলাবতী হালদারের হিসাবে ৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা, পিঅ্যান্ডএল অ্যাগ্রোতে ১১ কোটি টাকা, আনন কেমিক্যালে ৩ কোটি ও এফএএস ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টে যায় ৪০ লাখ টাকা।
২০১৫ সালে পিপলস লিজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয় আনান কেমিক্যাল। এফএএস ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট ও রিলায়েন্স ব্রোকারেজের মাধ্যমে এই শেয়ার কেনা হয়।
লীলাবতী হালদারের ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন সময়ে ১৬০ কোটি টাকা জমা হয়। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে তাঁর হিসাবটি ২০১৩ সালের ৭ মার্চ খুলে ওই বছরের ২৬ আগস্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই ৫ মাসে ওই হিসাবে ১৯ কোটি টাকা জমা করে ইমেক্সকো, বর্ণা ও ওরিয়াল নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান। আরেকটি হিসাবে জমা করে ৯ কোটি টাকা, যা ৩০ দিনের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ তিন প্রতিষ্ঠানই রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে ৬৩ কোটি টাকা ঋণ পায়। ওই সময়ে পি কে হালদার ছিলেন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি। পুরানা পল্টনের ইস্টার্ন ট্রেড সেন্টারের ১০ তলায় এ তিন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়, যা তিন মাস ধরে বন্ধ।
হাল ট্রাভেল সার্ভিস মূলত ট্রাভেল এজেন্সি প্রতিষ্ঠান, যা হাল ট্রিপ নামে পরিচিত। এর চেয়ারম্যান পি কে হালদার ও এমডি তাজবীর হাসান। পি কে হালদারের শেয়ারই ৯০ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির কয়েকটি ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন সময় জমা হয় ৪০৭ কোটি টাকা।
হাল ট্রিপের কার্যালয়ে বসে গত ২১ ডিসেম্বর এমডি তাজবীর হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে হাল ট্রাভেলের মালিকানায় যুক্ত হোন পি কে হালদার। প্রতি মাসে সর্বোচ্চ তিন কোটি টাকার টিকিট বিক্রি হয়। ৩ বছরে ৪০০ কোটি টাকা কারা জমা করল? এ প্রশ্নের কোনো জবাব তিনি দিতে পারেননি।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইন্টারনেট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান (আইজিডব্লিউ) ফার্স্ট কমিউনিকেশনের পরিচালক পি কে হালদার। প্রতিষ্ঠানটির ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের হিসাবে বিভিন্ন সময় জমা হয় ৮২৩ কোটি টাকা। পি কে হালদার এমডি থাকাকালে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ দিয়েছিল, যার বর্তমান স্থিতি ৪৩ কোটি টাকা।
পি কে হালদারের বাংলাদেশ মাইক্রোটেকনোলজি ও হাল টেকনোলজি একীভূত হয়ে বর্তমানে হাল টেকনোলজি। এর চেয়ারম্যান ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফানউদ্দিন আহমেদ, তিনি অংশীদারও।
ইরফানউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাল টেকনোলজি একীভূত হওয়ার পর আমি যোগ দিয়েছিলাম। সম্প্রতি ছেড়ে দিয়েছি।’ তবে এখনো পি কে হালদারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেখভাল করছেন বলে জানা গেছে।
যেখানে সব বেনামি কোম্পানি
ঋণ নিতে ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে কাগজে–কলমে যত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে, তার বেশির ভাগের ঠিকানা পুরানা পল্টনের ইস্টার্ন ট্রেড সেন্টারের ১০ তলা এবং কারওয়ান বাজারের ডিএইচ টাওয়ারের ৮ ও ১৪ তলা।
ইস্টার্ন ট্রেড সেন্টারের ১০ তলায় সুকুমার মৃধা প্রায় ২০ বছর ধরে আইনি ব্যবসা করছেন, তার প্রতিষ্ঠানের নাম সুকুমার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। দীর্ঘদিন ধরে পি কে হালদার ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কর ফাইলের কাজ করেন সুকুমার মৃধা। এ সূত্র ধরেই ওই ভবনের ১০ তলার পুরোটাই বেনামি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ওই ১০ তলার ঠিকানা ব্যবহার করেই হাল ইন্টারন্যাশনাল, হাল এন্টারপ্রাইজ, সুখাদা লিমিটেড, সন্দীপ ইন্টারন্যাশনাল, উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল, বর্ণা, ইমেক্সো, আরবি এন্টারপ্রাইজ, এসএ এন্টারপ্রাইজসহ আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন করা হয়। কয়েকটি কক্ষে এখনো সাইনবোর্ড লাগানো আছে। দুই মাস ধরে এসব কক্ষে তালা ঝুলছে।
ইস্টার্ন ট্রেড সেন্টারে কথা হয় সুকুমার মৃধার সঙ্গে। ওই সময়ে তিনি প্রিতিশ কুমার হালদারের কর ফাইল নিয়ে কাজ করছিলেন। সুকুমার মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওরা (হালদার পরিবার) আমার পূর্বপরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের কর ফাইল আমি প্রস্তুত করে থাকি। তাঁরা হঠাৎ করেই আমার দরজায় হাল এন্টারপ্রাইজের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন। আমি এর সঙ্গে জড়িত নই।’
তবে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয়ে (আরজেএসসি) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উইন্টেল ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক পদে আছেন সুকুমার মৃধার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধা। ওই প্রতিষ্ঠান এফএএস ফাইন্যান্স থেকে ৪০ কোটি টাকা ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৬০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করছে না। সুকুমার মৃধার মেয়ের নামে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিআইএফসির শেয়ারও কেনা হয়।
ইস্টার্ন ট্রেড সেন্টারেরর মালিক সমিতির সভাপতি শহীদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ওই তলার কক্ষগুলো কারা ব্যবহার করেন, এটা সুকুমার মৃধা ভালো বলতে পারবেন।
কারওয়ান বাজারের ডিএইচ টাওয়ারে আছে রেপটাইল ফার্ম, আনন কেমিক্যাল, নর্দান জুট, রহমান কেমিক্যাল, আজিজ ফাইবারসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। সবই পি কে হালদারের।
গত ২১ ডিসেম্বর কারওয়ান বাজারের ডিএইচ টাওয়ারে কথা হয় উজ্জ্বল কুমার নন্দীর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পি কে হালদারের ডাকে সারা দিয়ে আমি প্রথমে এফএএফ ফাইন্যান্স ও পরে পিপলসের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিই। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।’ তিনি জানান, নর্দান জুটের দায়িত্ব প্রিতিশ কুমার হালদারের কাছে হস্তান্তর করেছেন। এখন অন্য সব দায়িত্বও ছেড়ে দিতে চাইছেন।
উজ্জ্বল কুমার নন্দী ২০১০ সাল পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসির কোম্পানি সচিব ছিলেন। ২০১৩ সালের অক্টোবরে তাঁকে এফএএস ফাইন্যান্সের পরিচালক করেন পি কে হালদার। এরপর তাঁকে আনন কেমিক্যাল ও পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান করা হয়। একই সঙ্গে উজ্জ্বল নন্দীকে নর্দান জুট, রহমান কেমিক্যাল, ক্লিউইস্টন ফুডের চেয়ারম্যানের পদ দেন পি কে হালদার।
চার আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল যেভাবে
মূলত শেয়ারবাজার থেকে শেয়ার কিনে চারটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন পি কে হালদার। এভাবে নিয়ন্ত্রণ নেওয়া চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পিপলস লিজিং ও বিএফআইসির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের একধরনের সহায়তা ছিল। এই দুই প্রতিষ্ঠানের আগের পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সদস্য আইন ভেঙে নামে-বেনামে ঋণ নেওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এই সুযোগে এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠান দুটির নিয়ন্ত্রণ নেন পি কে হালদার।
যেমন বিআইএফসির নিয়ন্ত্রণ সুকুজা ভেঞ্চার ও কাঞ্চি ভেঞ্চার নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের হাতে। আরজেএসসি সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের একই দিনে এ দুটি প্রতিষ্ঠান কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। সুকুজা ভেঞ্চারের শেয়ার সুখাদা লিমিটেড ও সুকুমার মৃধার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধার হাতে। এর মধ্যে অনিন্দিতা মৃধার শেয়ারই ৯০ শতাংশ। আর সুখাদা লিমিটেডের মনোনীত পরিচালক ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফানউদ্দিন আহমেদ। ইরফানউদ্দিন আহমেদ কিছুদিনের জন্য বিআইএফসির চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। আর কাঞ্চি ভেঞ্চারের ৯৫ শতাংশ শেয়ার হাল ইন্টারন্যাশনালের হাতে, যার প্রতিনিধিও ইরফানউদ্দিন আহমেদ।
সুকুমার মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পি কে হালদার আমার মেয়েকে কোম্পানির পরিচালক বানিয়েছেন। এর বেশি কিছু আমি জানি না।’
পিপলস লিজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল আনন কেমিক্যাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের। আবার আনন কেমিক্যালের ৯৪ শতাংশ শেয়ার প্রিতিশ কুমার হালদারে হাতে ও ৫ শতাংশ শেয়ার তার খালাতো ভাই অভিজিৎ অধিকারীর হাতে।
এফএএস ফাইন্যান্সের নিয়ন্ত্রণ পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল ও রেপটাইল ফার্মের হাতে। আবার রেপটাইলস ফার্মের মালিকানায় আছে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, কেএইচবি সিকিউরিটিজের এমডি রাজীব সোম ও তাঁর স্ত্রী শিমু রায়। এর ফলে ময়মনসিংহের কুমির চাষ প্রকল্পটি বনে গেছে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক। মালিক মূলত পি কে হালদারই।
রাজীব সোম গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মূলত সিকিউরিটিজ ও রেপটাইল ফার্মের বেতনভুক্ত কর্মচারী। ফার্মে ও সিকিউরিটিজে আমাদের কিছু শেয়ারও আছে। এর বাইরে আমি কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত নই।’
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ হাল ইন্টারন্যাশনাল, বিআর ইন্টারন্যাশনাল, নেচার এন্টারপ্রাইজ, নিউ টেক এন্টারপ্রাইজের হাতে। এসব প্রতিষ্ঠান ২০১৫ সালে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। হাল ইন্টারন্যাশনালের ৭০ শতাংশ শেয়ারের মালিক পি কে হালদার নিজে।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং একসময় ভালো চলছিল। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরই প্রতিষ্ঠানটি ভেঙে পড়ে। প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠানের নামে বের করে নেওয়া হয় ২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। এর সব কটির সুবিধাভোগীও পি কে হালদার বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ সামগ্রিক বিষয় নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, একজন ব্যক্তি কীভাবে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিলেন, এটা বোধগম্য হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি বলে কি কিছুই ছিল না। জানার পরও কেন সেখানে প্রশাসক বসায়নি। আর্থিক অপরাধের বিচার না হওয়ায় সবাই অনিয়মে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, এখনই সরকারের পক্ষ থেকে এসব অপরাধ শক্ত হাতে দমন করতে হবে। না হলে আর্থিক খাতকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে, যার পরিণতি কারও জন্য সুখকর হবে না।