ক্রিকেট দুনিয়ায় সবাই তাঁকে চিনত ‘দ্য ওয়াল’ নামে। টেস্ট ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি ৩১,২৫৮টি বল খেলেছেন তিনি, যেখানে আর কোন ব্যাটসম্যান ৩০,০০০ বলও খেলতে পারে নি! অদূর ভবিষ্যতে কেউ পারবেন বলেও মনে হয় না। ‘দ্য ওয়াল’ নামকরণের সার্থকতা বোঝতে এই একটা পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। হ্যাঁ, বলছিলাম ক্রিকেটের সর্বকালের সেরাদের একজন, ‘মি. ডিপেন্ডেবল’ খ্যাত ভারতীয় ব্যাটিং মায়েস্ত্রো রাহুল দাবিড়ের কথা।
উল্লেখ্য, টেস্টে বল খেলার হিসাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছেন যথাক্রমে শচীন টেন্ডুলকার (২৯৪৩৭ বল) এবং জ্যাক ক্যালিস (২৮৯০৩ বল)।
শুধু বল নয়, মিনিটের হিসাবে ক্রিজে সবচেয়ে বেশি সময় অবস্থান করার রেকর্ডটাও দ্রাবিড়ের দখলে! টেস্ট ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৪,১৫২ মিনিট ক্রিজে ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ‘লিটল মাস্টার’ শচীন টেন্ডুলকারের ক্রিজে অবস্থানের সময় ৪১,৩০৪ মিনিট।
শেন ওয়ার্ন একবার বলেছিলেন, “Rahul Dravid being known as “The Wall” is pretty much spot on. “The Fortress” could also describe Rahul. Because once Dravid was set, you needed the bowling equivalent of dozen cannon firing all at once to blast him down.”
একজন ‘ওল্ড স্কুল’ ঘরানার পিওর ক্লাসিকাল ব্যাটসম্যান বলতে যা বোঝায়, দ্রাবিড় ছিলেন তাই। কোচিং ম্যানুয়ালে একেকটা শট যেভাবে খেলতে বলা আছে, ক্রিকেটীয় ব্যাকরণের একনিষ্ঠ অনুসারী দ্রাবিড় ঠিক সেভাবেই খেলেছেন। বলা যায়, টেকনিকের বিশুদ্ধতার দিক থেকে রাহুল ছিলেন একজন ‘পারফেকশনিস্ট’।
বাহারি স্ট্রোকপ্লে নয়, দ্রাবিড়ের শক্তির জায়গা ছিল জমাট রক্ষণ, গভীর মনঃসংযোগ, টেম্পারমেন্ট আর মানসিক দৃঢ়তা। যেকোন ধরনের উইকেট ও কন্ডিশনের সাথে তাঁর মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। একবার সেট হয়ে গেলে আউটই হতে চাইতেন না।
দ্রাবিড়কে নিয়ে সাবেক স্পিডস্টার শোয়েব আখতার একবার বলেছিলেন, “শচীন নিঃসন্দেহে গ্রেট ব্যাটসম্যান, তারপরও আমার কাছে রাহুলকেই বেশি নিখুঁত আর সলিড মনে হয়। ওর ডিফেন্স খুব জমাট, অন্যদের চেয়ে শট কম খেলে। যে শট কম খেলে তাকে আউট করা খুব কঠিন, কারণ শট কম খেললে ভুল করার সম্ভাবনাও কম থাকে।”
অনেকেরই ধারণা, দ্রাবিড়ের মত সোজা ব্যাটে খুব কম ব্যাটসম্যানই খেলেছেন। উইকেটের দুপাশে হরাইজন্টাল শটেও ছিলেন পারদর্শী। ফাস্ট বোলারদের দ্রুতগতির বাউন্সারের জবাব দিতেন কন্ট্রোলড হুক শটে। অফ ড্রাইভ, অন ড্রাইভ, ‘বেন্ট নি’ কভার ড্রাইভ, স্কয়ার কাট কিংবা কব্জির মোচড়ে খেলা দৃষ্টিনন্দন ফ্লিক — তাঁর প্রতিটা শটেই থাকত পারফেকশনের ছোঁয়া। কমেন্টেটরদের ভাষায়, “Everything was right about that shot”.
স্পিনের বিপক্ষে দ্রাবিড়কে মানা হয় সর্বকালের সেরাদের একজন। টার্নের গতিবিধি এবং বলের লেন্থ পড়ে ফেলতে পারতেন খুব দ্রুত। স্পিনের এগেইনস্টে তাঁর সাবলীল ফুট মুভমেন্ট, সফট হ্যান্ড প্লে, বলের পিচে গিয়ে খেলা, ডেপথ অফ দ্য ক্রিজের সুনিপুণ ব্যবহার এবং নমনীয় কব্জির রিস্টপ্লে ছিল দেখার মত।
আসুন এক নজরে দেখে নিই রাহুল দ্রাবিড়ের বর্ণাঢ্য আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার হাইলাইটস।
❏ ১৯৭৩ সালের ১১ জানুয়ারি মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে এক সম্ভ্রান্ত মারাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রাহুল শারদ দ্রাবিড়। জন্ম ইন্দোরে হলেও একটি জ্যাম ফ্যাক্টরিতে কর্মরত বাবার চাকরিসূত্রে তাঁর বেড়ে ওঠা বেঙ্গালুরুর কর্ণাটকে। সেখানেই পড়ালেখায় হাতেখড়ি, ক্রিকেটেও।
❐ বয়সভিত্তিক দলগুলোতে রানের বন্যা বইয়ে দিয়ে ১৯৯১ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। কর্ণাটকের হয়ে মহারাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রঞ্জি অভিষেকেই তিনি খেলেন ৮২ রানের অনবদ্য এক ইনিংস।
❐ একদিনের ক্রিকেটে রাহুলের অভিষেক ১৯৯৬ সালের ৩ এপ্রিল সিঙ্গাপুরে, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। অবশ্য খুব একটা মনে রাখার মত ম্যাচ ছিল না সেটা। মুরালিধরনের ঘূর্ণিতে আউট হবার পূর্বে দ্রাবিড় করতে পেরেছিলেন মোটে ৩ রান। তবে ফিল্ডিংয়ে নেমে দারুণ দুটি ক্যাচ নিয়েছিলেন তিনি।
❐ ১৯৯৬ সালের ২০ জুন, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ‘ক্রিকেটের মক্কা’ লর্ডসে তাঁর স্মরণীয় টেস্ট অভিষেক। একই ম্যাচে অভিষিক্ত হয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলিও।
অভিষেক ইনিংসে দ্রাবিড় নেমেছিলেন ৭ নম্বরে। সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৫ রান দূরে থাকতে ইংলিশ পেসার ক্রিস লুইসের বলে হয়েছিলেন কট বিহাইন্ডের শিকার। ডেব্যু টেস্টেই জাত চেনানো ২৬৭ বলে ৯৫ রানের ইনিংসটি খেলতে দ্রাবিড় সময় নিয়েছিলেন ছয় ঘন্টারও বেশি। ট্রেন্টব্রিজে পরের টেস্টেও খেলেন ৮৪ রানের আরও একটি সাহসী ইনিংস।
❐ ১৯৯৭ সালে জোহানেসবার্গের বিরুদ্ধ কন্ডিশনে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হাঁকান ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। ১৪৮ ও ৮১ রানের অনবদ্য দুটো ইনিংস খেলে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।
❐ একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর প্রথম শতরানটি আসে চেন্নাইতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, ১৯৯৭ সালে। পাকিস্তানের দেয়া ৩২৮ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে দ্রাবিড় খেলেছিলেন ১০ বাউন্ডারিতে সাজানো ১১৬ বলে ১০৭ রানের অনবদ্য এক ইনিংস।
উল্লেখ্য, ওই ম্যাচেই পাকিস্তানি ওপেনার সাঈদ আনোয়ার তাঁর ক্যারিয়ার সেরা ১৯৪ রানের ইনিংসটি খেলেছিলেন যেটি ওডিয়াই ইতিহাসের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড হিসেবে টিকে ছিল বহু বছর।
❐ ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে হ্যামিল্টনের সেডন পার্কে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত হাঁকান জোড়া সেঞ্চুরি (১৯০ ও ১০৩*); জিতে নেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।
একই বছর জুন মাসে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত নিজের প্রথম বিশ্বকাপেই ৬৫.৮৬ গড়ে ৪৬১ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। হাঁকিয়েছিলেন ২টি সেঞ্চুরি ও ৩টি ফিফটি।
ওই টুর্নামেন্টেই শ্রীলংকার বিপক্ষে সৌরভ গাঙ্গুলির (১৫৮ বলে ১৮৩) সাথে মিলে বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম তিন শতাধিক (৩১৮) রানের জুটি গড়েছিলেন দ্রাবিড় (১২৯ বলে ১৪৫)। তখন ওটাই ছিল একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড।
❐ ১৯৯৯ সালে নভেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২য় উইকেটে শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গে জুটি বেঁধে ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৩৩১ রানের রেকর্ড পার্টনারশিপ গড়েছিলেন দ্রাবিড়। ক্যারিয়ার সেরা ১৫৩ রানের ইনিংসটাও খেলেছিলেন সেদিনই।
উল্লেখ্য, ২০১৫ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিস গেইল ও মারলন স্যামুয়েলস মিলে ৩৭২ রানের জুটি গড়ে ভেঙ্গে দেন সেই রেকর্ড।
❐ ২০০০ সালে উইজডেন মনোনীত বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়।
টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটি করেছিলেন ২০০০ সালে, দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। দুই ইনিংসেই অপরাজিত ছিলেন যথাক্রমে ২০০* এবং ৭০* রানে। নাগপুরে পরের টেস্টেও পেয়েছিলেন সেঞ্চুরি (১৬২)।
দুই টেস্টের সিরিজে দ্রাবিড়ের সংগ্রহ ছিল ৪৩২ রান, ব্যাটিং গড়ও ছিল ৪৩২!
❐ ২০০১ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে লক্ষণ-দ্রাবিড়ের ৩৭৬ রানের জুটিটা ছিল টেস্ট ইতিহাসের এক অমর উপাখ্যান। ভিভিএস লক্ষণের ২৮১ রানের ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’ ইনিংসের আড়ালে চলে যাওয়া দ্রাবিড়ের ১৮০ রানের ‘লড়াকু’ ইনিংসটিও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ফলোঅনে পড়েও ভারতের অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়ানো, স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ইতিহাস গড়া — এসবই সম্ভব হয়েছিল দ্রাবিড়-লক্ষণের ‘কালোত্তীর্ণ’ সেই জুটির কল্যাণেই।
❐ ২০০২ সালের আগস্টে অনুষ্ঠিত হেডিংলি টেস্টে ১৪৮ রান করে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। যার সৌজন্যে ১৬ বছর পর ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট জিতেছিল ভারত।
উল্লেখ্য, ওই সফরে ট্রেন্টব্রিজ (১১৫) এবং ওভালে (২১৭) আরও দুটো সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন দ্রাবিড়। ১০০.৩৩ গড়ে ৬০২ রান করে হয়েছিলেন সিরিজের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক; জিতে নিয়েছিলেন সিরিজসেরার পুরস্কার।
❐ ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দীর্ঘ ২৩ বছর পর প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পায় ভারত; সেটাও এই দ্রাবিড়ের হাত ধরেই। অ্যাডিলেড টেস্টের দুই ইনিংসে ২৩৩ এবং ৭২ রানের অনবদ্য দুটো ইনিংস খেলে দলকে অবিস্মরণীয় এক জয় এনে দেন তিনি।
উক্ত সিরিজে ৪ টেস্ট খেলে দ্রাবিড়ের ব্যাট থেকে এসেছিল ১২৩.৮০ গড়ে ৬১৯ রান; হয়েছিলেন সিরিজসেরা।
❐ হাতে ভাল বিকল্প না থাকায় ২০০২-২০০৪ এই সময়টাতে নিয়মিত উইকেটরক্ষকের দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে দ্রাবিড়কে। ২০০৩ বিশ্বকাপে ভারতকে ফাইনালে তুলতে গ্লাভস হাতে রাহুলের অবদানটা ভুলে গেলে চলবে না। উইকেটকিপার হিসেবে তাঁর দলে অন্তর্ভুক্তির কারণেই একাদশে একজন বাড়তি প্লেয়ার খেলানোর সুবিধা পেত ভারত।
❐ ২০০৪ সালে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে ২৭০ রানের ‘মহাকাব্যিক’ এক ইনিংস খেলেন দ্রাবিড়। ৭৪০ মিনিটব্যাপী সেই ‘ম্যারাথন’ ইনিংসে ভর করেই প্রথমবারের মত পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জেতে ভারত। সেটা ছিল আবার ১২ বছর পর বিদেশের মাটিতে ভারতের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়।
উল্লেখ্য, ২০০৩-০৪ মৌসুমে যথাক্রমে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে আহমেদাবাদে ২২২, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অ্যাডিলেডে ২৩৩ এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাওয়ালপিন্ডিতে করেছিলেন ২৭০ — অর্থাৎ টানা তিন সিরিজে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন দ্রাবিড়।
উল্লেখ্য, স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের পর ইতিহাসের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হলেন দ্রাবিড় যিনি পর পর তিনটি সিরিজে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানোর কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
❐ ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের ‘প্রথম’ ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০টি টেস্ট খেলুড়ে দেশেই সেঞ্চুরি হাঁকানোর বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন দ্রাবিড়।
❐ ২০০৪ সালে একই সাথে ‘আইসিসি প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার’ এবং ‘আইসিসি টেস্ট ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার’ খেতাবে ভূষিত হন দ্রাবিড়। বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা আইসিসির উদ্যোগে ক্রিকেটারদের সম্মান জানানোর এই উদ্যোগটা শুরুটা হয়েছিল রাহুলকে দিয়েই।
❐ ২০০৫ সালে প্রথমবারের মত ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মনোনীত হন রাহুল দ্রাবিড়।
❐ ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে লাহোরে ৪১০ রানের এক ‘মহাকাব্যিক’ ওপেনিং জুটির অংশীদার হয়েছিলেন দ্রাবিড় (১২৮)। বিরল এই অর্জনে তাঁর সঙ্গী ছিলেন বীরেন্দর শেবাগ (২৫৪)।
টেস্টে উদ্বোধনী জুটিতে এর চাইতে বেশি রান তোলার রেকর্ড আছে আর মাত্র দুটি; স্মিথ-ম্যাকেঞ্জি (৪১৫) এবং ভিনু মানকড়-পঙ্কজ রায় (৪১৩)।
❐ ২০০৬ সালের জুনে, দীর্ঘ ৩৫ বছর অপেক্ষার পর দ্রাবিড়ের অধিনায়কত্বেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে প্রথমবারের মত টেস্ট সিরিজ জেতে ভারত। সিরিজ নির্ধারণী শেষ ম্যাচের দুই ইনিংসে দ্রাবিড় করেছিলেন ৮১ আর ৬৮। ইনিংস দুটোর ‘ভ্যালু’ বোঝাতে একটা তথ্য দিই। ওই ম্যাচে ফিফটি করা একমাত্র ভারতীয় ব্যাটসম্যান ছিলেন দ্রাবিড়!
১ সেঞ্চুরি ও ৪ ফিফটিতে ৪৯৬ রান করে সিরিজের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহকও ছিলেন দ্রাবিড়; হয়েছিলেন সিরিজসেরা।
❐ ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে রাহুলের নেতৃত্বেই দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথমবারের মত টেস্ট জিতে ইতিহাস গড়েছিল ভারত।
❐ ২০০৭ সালের জুলাইতে রাহুলের অধিনায়কত্বেই ২৬ বছর পর ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জেতে ভারত।
একই বছর আগস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ওডিয়াই ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসটি খেলেন দ্রাবিড়। ব্রিস্টলের কাউন্টি গ্রাউন্ডে ১১ বাউন্ডারি ও ১ ওভার বাউন্ডারিতে দ্রাবিড় উপহার দিয়েছিলেন ৬২ বলে অপরাজিত ৯৩ রানের এক বিধ্বংসী ইনিংস। যার সুবাদে শেষ পর্যন্ত ভারত জিতেছিল মাত্র ৯ রানে।
❐ ২০১১ সালে ভারতের হয়ে শেষবারের মত ইংল্যান্ড সফর করেন দ্রাবিড়। ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় সিরিজটা ৪-০ ব্যবধানে ‘হোয়াইটওয়াশ’ হয় ভারত। তবে ইংলিশ কন্ডিশনে সুইং ও সিম বোলিংয়ের সামনে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের অসহায় আত্মসমর্পণের বিপরীতে প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে তুলেছিলেন একমাত্র তিনিই! ৩ সেঞ্চুরিতে দ্রাবিড় যেখানে একাই করেছিলেন ৪৬১ রান যেখানে আর কোনো ভারতীয় ব্যাটসম্যানের একটাও সেঞ্চুরি ছিলনা!
উল্লেখ্য, পরাজিত দলে থেকেও সেবার দ্রাবিড়ের মাথাতেই উঠছিল সিরিজসেরার মুকুট।
রাহুলের তিন সেঞ্চুরির দুটোই এসেছিল মেকশিফট ওপেনারের ভূমিকায়! ব্যাট হাতে একবার পুরো ইনিংস ‘ক্যারি’ পর্যন্ত করেছিলেন তিনি। ওভাল টেস্টে ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমে ১৪৬ রানে অপরাজিত ছিলেন অলআউট হওয়া পর্যন্ত।
❐ ২০১১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, কার্ডিফে ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে ম্যাচটি খেলেন দ্রাবিড়। গ্রায়েম সোয়ানের বলে বোল্ড হওয়ার ৭৯ বলে ৬৯ রানের একটি ঝকঝকে ইনিংস খেলেন তিনি।
টেন্ডুলকারের মত রাহুলও আন্তর্জাতিক টি২০ ম্যাচ খেলেছেন মাত্র একটি। ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ওই একই সফরে। সে ম্যাচে রাহুল করেছিলেন ৩১ রান।
❐ ২০১২ সালের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অ্যাডিলেড টেস্টটাই ছিল রাহুলের ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ওই বছরই মার্চ মাসের ৯ তারিখ সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে আনুষ্ঠানিক অবসরের ঘোষণা দেন দ্রাবিড়।
❐ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পরও ক্রিকেটের সাথেই তাঁর সম্পৃক্ততা। বেশ কয়েক মৌসুম তিনি খেলেছেন আইপিএলে। ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের ব্যাটিং পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন কিছুদিন। ইদানীং ধারাভাষ্যকক্ষেও প্রায়শই দেখা যায় তাঁকে। এই তো বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত যুব বিশ্বকাপে তাঁর কোচিংয়েই রানার্সআপ হবার গৌরব অর্জন করে ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ যুব ক্রিকেট দল।
এবারে চলুন এক নজরে দেখে আসি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দ্রাবিড়ের যত রেকর্ড।
▪ক্যারিয়ারে মোট ১৬৪টি টেস্ট খেলেছেন দ্রাবিড়। তাঁর চাইতে বেশি টেস্ট খেলার রেকর্ড আছে শুধুমাত্র ৪ জনের। তাঁরা হলেন শচীন টেন্ডুলকার, স্টিভ ওয়াহ, জ্যাক ক্যালিস ও রিকি পন্টিং।
▪১৯৯৬ সালে অভিষেকের পর থেকে ভারতের হয়ে টানা ৯৩টি টেস্ট ম্যাচে অংশ নিয়েছেন দ্রাবিড়। অভিষেকের পর তাঁর চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন শুধুমাত্র অ্যাডাম গিলক্রিস্ট (৯৬), এবি ডি ভিলিয়ার্স (৯৮) এবং ব্রেন্ডন ম্যাককালাম (১০১)।
▪টেস্ট ইতিহাসের চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হলেন রাহুল দ্রাবিড় (১৩২৮৮ রান)। টেস্টে তাঁর চেয়ে বেশি রান করেছেন শুধুমাত্র টেন্ডুলকার, পন্টিং এবং ক্যালিস।
▪দ্রাবিড়ের টেস্ট সেঞ্চুরির সংখ্যা ৩৬টি। টেস্টে তাঁর চেয়ে বেশি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন কেবল টেন্ডুলকার (৫১), ক্যালিস (৪৫), পন্টিং (৪১) এবং সাঙ্গাকারা (৩৮)।
▪ শচীন টেন্ডুলকারের পর দ্বিতীয় ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই ১০ হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন রাহুল দ্রাবিড়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই দুর্লভ কীর্তি আছে মাত্র ৭ জনের।
▪টেস্টে দেশের বাইরে সর্বোচ্চ রানের মালিক শচীন টেন্ডুলকার (৮৭০৫ রান)। এরপরেই আছেন রাহুল দ্রাবিড় (৭৬৯০ রান)। দ্রাবিড়ের দেশের মাটিতে গড় ৫১.৩৫ আর দেশের বাইরে ৫৩.০৩!
▪টেস্টে টানা ৪ ইনিংসে সেঞ্চুরি করা একমাত্র ভারতীয় ব্যাটসম্যান হলেন রাহুল দ্রাবিড়।
▪টেস্ট ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৭৫০টি পার্টনারশিপ গড়েছেন শিবনারায়ন চন্দরপল। ৭৩৮টি পার্টনারশিপ নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন রাহুল দ্রাবিড়। পার্টনারশিপ রানের দিক থেকে অবশ্য এগিয়ে আছেন দ্রাবিড়ই (৩২০৩৯ রান)।
▪টেস্ট ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৮৮টি সেঞ্চুরি এবং ১২৬টি ফিফটি জুটির অংশীদার হলেন রাহুল দ্রাবিড়।
▪টেস্টে সর্বাধিক ৪টি ‘তিন শতাধিক’ রানের জুটির অংশীদার হলেন দ্রাবিড় এবং লক্ষণ।
▪ওয়ানডেতে একমাত্র দ্রাবিড়েরই আছে ২টি ‘তিন শতাধিক’ রানের জুটি; শচীন টেন্ডুলকার ও সৌরভ গাঙ্গুলির সাথে।
▪টেস্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৬৫৪টি বাউন্ডারি মেরেছেন রাহুল দ্রাবিড়। ২০৫৮টি বাউন্ডারি নিয়ে এক নম্বরে আছেন শচীন টেন্ডুলকার।
▪টেস্টে সর্বাধিক নার্ভাস নাইন্টিজে আউট হওয়া (১০ বার) ব্যাটসম্যান হলেন দ্রাবিড়। এ রেকর্ডে তাঁর যৌথ অংশীদাররা হলেন স্টিভ ওয়াহ এবং শচীন টেন্ডুলকার।
▪ওয়ানডেতে একটানা সর্বোচ্চ ১২০ ইনিংস ‘ডাকবিহীন’ থাকার রেকর্ডটি রাহুল দ্রাবিড়ের।
▪ওয়ানডেতে ১৩ বার এবং টেস্টে ১১ বার ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছেন দ্রাবিড়। যার মধ্যে ১৯টিই ছিল দেশের বাইরে!
▪ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি দ্রাবিড় ছিলেন একজন বিশ্বমানের ফিল্ডার। টেস্টে রেকর্ড সর্বোচ্চ ২১০টি ক্যাচ নিয়েছেন দ্রাবিড় যার বেশিরভাগই এসেছে স্লিপে।
উপমহাদেশের বাইরে এশিয়ার অবিসংবাদিত সেরা ব্যাটসম্যান মানা হয় রাহুল দ্রাবিড়কে। দু’একটা পরিসংখ্যান দিলেই পরিষ্কার হবে বিষয়টা।
❐ সাবকন্টিনেন্টের বাইরে এশীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড় দ্রাবিড়ের ৫৪.৫৮!
সেরা পাঁচে আছেন যথাক্রমে সুনীল গাভাস্কার ৫১.৫৭, শচীন টেন্ডুলকার ৫০.৩৭, মহিন্দর অমরনাথ ৪৮.৪০ এবং কুমার সাঙ্গাকারা ৪৭.১৬।
❐ সাবকন্টিনেন্টের বাইরে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের ভেতর সর্বোচ্চ ১৩টি টেস্ট জিতেছেন দ্রাবিড় এবং লক্ষণ। জেতা ম্যাচে সর্বোচ্চ রান এবং ব্যাটিং গড়ও দ্রাবিড়ের!
সাবকন্টিনেন্টের বাইরে জেতা ম্যাচে ২২ ইনিংসে দ্রাবিড় করেছেন ১৩৫৪ রান, ৭১.২৬ গড়ে!
❐ সাবকন্টিনেন্টের বাইরে টেস্টে সর্বোচ্চ ৮ বার ম্যাচসেরা ও ৪ বার সিরিজসেরা হয়েছেন দ্রাবিড়; আর কোন এশীয় ব্যাটসম্যান যে রেকর্ডের ধারেকাছেও নেই।
চলুন এক নজরে দেখে নিই রাহুল দ্রাবিড়ের ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান।
১৬৪ টেস্টে ২৮৬ ইনিংসে দ্রাবিড়ের সংগ্রহ ১৩,২৮৮ রান। ব্যাটিং গড় ৫২.৩১। হাঁকিয়েছেন ৩৬টি সেঞ্চুরি, ৫টি ডাবল সেঞ্চুরি এবং ৬৩টি হাফ সেঞ্চুরি। সর্বোচ্চ ইনিংস ২৭০, পাকিস্তানের বিপক্ষে।
এছাড়া ফিল্ডিংয়ে ২১০টি ক্যাচ আর বল হাতে ১টি উইকেটও আছে তাঁর।
৩৪৪ ওয়ানডেতে ৩৯.১৬ গড়ে দ্রাবিড় করেছেন ১০,৮৮৯ রান। হাঁকিয়েছেন ১২টি শতক আর ৮৩টি অর্ধশতক। সর্বোচ্চ ইনিংস ১৫৩, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।
এছাড়া উইকেটরক্ষক হিসেবে ২১০টি ডিসমিসাল; বল হাতে নিয়েছেন ৪ উইকেট।
খেলোয়াড়ি জীবনে দ্রাবিড় ছিলেন বরাবরের পার্শ্বনায়ক। ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় তাঁকে থাকতে হয়েছে টেন্ডুলকারের ‘ছায়াসঙ্গী’ হয়ে। এমনকি ওয়ানডে খেলোয়াড়িক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ইনিংস (১৫৩ রান) খেলার দিনেও তারকাদ্যুতিতে তাঁকে ম্লান করে দিয়েছিলেন ভারতীয় লিটল মাস্টার!
এই বিষয়টা নিয়ে মুরালিধরন একটা কথা বলেছিলেন, “রাহুল বরাবরই শচীনের ছায়া হয়ে থেকেছেন। তবে আপনি কখনোই দু’জনের মধ্যে তুলনা করতে পারবেন না। কারণ দু’জনের ব্যাটিংয়ের ধরন আলাদা।”
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঐতিহাসিক কলকাতা টেস্টের কথা বললেই যেমন স্মৃতির মানসপটে ভেসে ওঠে ভিভিএস লক্ষণের ২৮১ রানের মাস্টারক্লাসের কথা; দ্রাবিড়ের ১৮০ রানের ইনভ্যালুয়েবল ইনিংসটা তাতে ঢাকা পড়ে যায়! একবার কিংবা দুবার নয়, এমনটা হয়েছে বারবার। আড়ালে থেকে নিজের দায়িত্বটুকু ঠিকই পালন করে গেছেন অথচ দিন শেষে কৃতিত্বটা ছিনিয়ে নিয়ে যেত অন্য কেউ। তাতে অবশ্য ‘দ্য ওয়ালে’ কোনো চিড় তো ধরেইনি বরং দিনের পর দিন তা আরো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে।
ক্রিকেট মাঠে দ্রাবিড় ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই একজন জেন্টলম্যান। তাঁর মত বিনয়ী ও ভদ্র ক্রিকেটার আজকালকার দিনে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। খেলোয়াড়ি জীবনের মত ব্যক্তিজীবনেও দ্রাবিড় ছিলেন অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুবর্তী। স্পোর্টসম্যানশিপ স্পিরিটকে মনেপ্রাণে লালন করা দ্রাবিড় দেখিয়েছেন একজন ভাল ক্রিকেটার কীভাবে একজন ভাল মানুষ হতে পারেন। তাইতো অসংখ্য তরুণ ক্রিকেটার তাদের রোলমডেল হিসেবে আজও দ্রাবিড়কেই বেছে নেয়।
শেষ করব ‘ক্রিকেটের বরপুত্র’ ব্রায়ান লারার একটা বিখ্যাত উক্তি দিয়ে। “If I have to put anyone to bat for my life, it’ll be Kallis or Dravid.”