আসামের এনআরসিকে কেন্দ্র করে যে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ তা নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে লেখালেখি চলছে গত কয়েক বছর ধরে। ‘ডিটেনশন ক্যাম্পে’ মৃত্যুর সংবাদ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গণমাধ্যমের নিয়মিত সংবাদ। কংগ্রেসসহ বিরোধীদল ক্যাম্পগুলো নিয়ে কথা বলতে শুরু করে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের সময় থেকে।
ভারত-জুড়ে বিক্ষোভ-সংঘর্ষ, প্রাণহানি চলতে থাকা অবস্থায় নরেন্দ্র মোদি সরকার বলতে শুরু করে ‘ভারতে কোনো ডিটেনশন ক্যাম্প’ নেই। এটা বিরোধীদলের মিথ্যা প্রচারণা। কিন্তু, ভারতের ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’র সংবাদ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। মোদি সরকার যাকে ‘আটক কেন্দ্র’ বলছে তা আসলে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’- ভারতীয় রাজনীতি বিশ্লেষকরা তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বহুদিন ধরে সেকথা বলছেন।
আল-জাজিরা সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আসামের গোয়ালপাড়ায় তৈরি হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে বড় আটককেন্দ্র বা ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’। এই ক্যাম্পে ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করেন আলী (২৫)। কাজের ফাঁকে বিশ্রামের সময় তার মনে হয়, এখানেই আর কিছুদিন পর তার বোনের স্বামী আটক থাকবেন। শেষ হয়ে যাবে তার বোনের সংসার।
আলীর বোন জামাইয়ের নাম উঠেনি জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে (এনআরসি)। প্রায় ১০ লাখ ৯০ হাজার ‘অবৈধ’ অভিবাসীর তালিকায় ঠাঁই হয়েছে তার। এখন হয় তাকে দেশ ছাড়তে হবে, নয়তো থাকতে হবে গোয়ালপাড়ার এই ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’-এ।
২৫ বিঘার বেশি জায়গা নিয়ে তৈরি প্রায় ৩ লাখ বর্গফুটের ক্যাম্পটি আসামের গুয়াহাটি থেকে ১২৯ কিলোমিটার দূরে। প্রায় তিন হাজার মানুষের জায়গা হবে এতে।
প্রকল্প প্রকৌশলী রবীন্দ্র দাস বলেন, “নারী ও পুরুষদের আলাদা জায়গায় রাখা হবে। মাঝে থাকবে ছয় ফুট উঁচু লাল দেয়াল। ১৩টি ব্লকে চারজন করে থাকবেন।”
“ডিটেনশন ক্যাম্পটি দুটি দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত থাকবে। ভেতরেরটি ২০ ফুট উঁচু, বাইরেরটি ৬ ফুট,” বলেন রবীন্দ্র দাস।
নিরাপত্তায় ছয়টি ওয়াচ-টাওয়ারে সার্বক্ষণিক নজরদারি থাকবে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের জুন মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে এটি নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয় এবং ডিসেম্বরের মধ্যেই এর কাজ শেষ করতে বলা হয়। পরে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এর সময় বাড়ানো হয়েছে।
আরও কিছু ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’
ভারত সরকার সারাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে এনআরসির ঘোষণা না দিলেও দেশটির বিভিন্ন জায়গায় ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ তৈরি করা হচ্ছে।
আসামে এরই মধ্যে ছয়টি ক্যাম্প চালু আছে। সরকারি হিসাবে, আসামের গোয়ালপাড়ার ‘ডিটেনশন ক্যাম্পে’ ২০১, কোকরাঝাড়ে ১৪০, শিলচরে ৭১, দিব্রুগড়ে ৪০, জোরহাটে ১৯৬ এবং তেজপুরের ক্যাম্পে ৩২২ জন বন্দি আছেন।
গত ১১ বছরে এসব ‘ডিটেনশন ক্যাম্পে’ একশোরও বেশি বন্দির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনাও রয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক রাজ্যে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ নির্মাণ করতে বলা হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রায়। এজন্য একটি রোল মডেলও দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ নির্মাণে কলকাতা ও উত্তরচব্বিশ পরগনায় দুটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও নরেন্দ্র মোদি সরকারের কঠোর সমালোচনাকারী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, প্রাণ থাকতে তিনি পশ্চিমবঙ্গে আটককেন্দ্র বা ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ হতে দেবেন না।
গত বছর ডিসেম্বরে কর্ণাটকে অনিবন্ধিত অভিবাসীদের জন্য একটি ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ চালু করা হয়। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের গোয়ায় প্রথম ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ চালু হয় মে মাসে। রাজস্থানের কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর তৈরি করা হয়েছে বন্দিশালা। পাঞ্জাবের ‘ডিটেনশন ক্যাম্পের’ কাজ চলতি বছরের মে মাসে শেষ হবে বলে জানা গেছে।
রাজধানী দিল্লিতে ২০০৬ সাল থেকেই আটককেন্দ্র বা ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ চালু আছে। মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে আটককেন্দ্র নির্মাণে জায়গা নির্ধারণ করেছে এর আগে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি সরকার। যদিও ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধভ ঠাকরে মুসলিমদের এনিয়ে ভয় না পাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার সরকার কেন্দ্রের আদেশ মানবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাধা এই শিবসেনা নেতা।
কেরালা সরকারও ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ নির্মাণের প্রস্তাবিত এলাকায় স্থগিতাদেশ দিয়েছে।
ভারতজুড়ে এনআরসি, মুসলিমদের শঙ্কা
মানবাধিকার সংস্থা ইউনাইটেড এগেইনস্ট হেইট’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামের এনআরসিতে নাম না থাকা ১০ লাখ ৯০ হাজার মানুষের প্রায় অর্ধেকই মুসলিম।
ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলমান জনগোষ্ঠীর শঙ্কা, দেশজুড়েই এনআরসি করবে মোদি সরকার। গত ডিসেম্বরে পাস হওয়া সংশোধিত নাগরিক আইন এই শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে অন্তত ২৬ জন নিহত হয়েছেন।
সংশোধিত নাগরিক আইনে ২০১৫ সালের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে যাওয়া নাগরিকদের বৈধতা দেবে, তবে মুসলমান বাদে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ধর্মভিত্তিক বিভাজনের এই আইন ভারতের সংবিধান পরিপন্থি।