লিখেছেন মাহমুদুল হাসান রুবেল
ভারতের কেরালার একটি গ্রাম মদ জুয়া আর বিভিন্ন নেশায় আসক্ত ছিলো। পুরো একটা গ্রাম কিভাবে নিজেদের বদলে নিল- তা অবিশ্বাস্য! তাদেরকে যেতে হয়নি কোন নেশামুক্তি কেন্দ্রে অথবা নিতে হয়নি নেশা মুক্তির জন্য কোন ঔষধ। তবে নেশা মুক্তির জন্য তো নিশ্চয়ই কোন মাধ্যমের আশ্রয় তো নিতে হয়েছিল। আর সেটা হচ্ছে দাবা। এই দাবা খেলতে খেলতেই পুরো গ্রামটা নেশামুক্ত হতে পেরেছিল। অবাক করা ঘটনা কিন্তু এতে অলৌকিক কোন কিছু নাই। ঐ গ্রামেরই একজন সি আন্নি কৃষ্ণান নামক এক দাবাড়ু এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন এই দাবার গুনে।
ঐতিহাসিকদের কারো কারো মতে এই দাবা খেলার জন্মস্থান ভারতবর্ষ। তবে চীনারাও দাবী করে দাবা খেলা তাদের আবিষ্কার। তা যা হোক দাবা আজ বিশ্বজনীন, বুদ্ধির খেলা। প্রাচীনকালে এই খেলার নাম ছিল চতুরঙ্গ। হাতি, ঘোড়া, রথ ও সৈন্য এই চার উপাদান ছিল এই খেলার প্রাণ। একসময় পারস্যের বণিকেরা এটাকে পারস্যে নিয়ে যায় এবং চতুরঙ্গের নতুন নামকরন হয় শতরঞ্জ। পরবর্তী সময়ে এই খেলা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আর হয়ে উঠে বিশ্বজনীন। তৈরি হয় আধুনিক নিয়ম কানুন। প্রতিযোগিতার নিয়ম কানুনসহ শ্রেষ্ঠতার পরিধি। ন্যাশনাল মাস্টার, ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার, গ্র্যান্ড মাস্টার ইত্যাদি পদক।
দীর্ঘ এ ভূমিকা এবং শিরোনাম পড়ে নিশ্চয়ই আপনাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে সাপ্তাহিক ভোরের আলো মন্ট্রিয়ল ব্যুরো আপনাদের সামনে পরিচয় করে দিবে এক দাবাড়ুকে। হ্যাঁ, আমরা মন্ট্রিয়লের এক ১৯ বছর বয়সের এক দাবাড়ুকে আপনাদের সামনে নিয়ে আসছি যে মাত্র ৬ বছর বয়স থেকে একান্ত নিজের চেষ্টায় ইতিমধ্যে কানাডায় ন্যাশনাল মাস্টার (এনএম) খেতাব অর্জন করেছে।
বাংলাদেশের নরসিংদীর পশ্চিম কান্দা পাড়াস্থ উত্তম কুমার সাহার নেশা ছিলো দাবার প্রতি। মন্ট্রিয়লে আসার পরও সে নেশা তাঁর যায়নি। ব্যস্ত প্রবাস জীবনে কাজ শেষে ঠিকই বসে পড়তেন দাবা নিয়ে। তাঁর বড় ছেলে আনন্দ সাহা পিতার দাবা খেলা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আজ কানাডায় দাবার জগতে এক পরিচিত এবং জনপ্রিয় মুখ। প্রচারবিমূখ আনন্দ সাহা কিছুতেই সাক্ষাৎকার দিতে চাননি। আর সেটা সম্ভব হয়েছে শ্রী কৃষ্ণপদ সেন এবং শ্রীমতি ঝুমুর চক্রবর্তীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে। পাশাপাশি সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং এ প্রতিবেদন তৈরিতে শ্রী কৃষ্ণপদ সেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
আনন্দ সাহার কাছে প্রথম প্রশ্নই ছিলো, আপনার লক্ষ্য কি ? তিনি অত্যন্ত কনফিডেন্স এর সাথে জবাব দিলেন আরো ভালো খেলতে হবে এবং গ্র্যান্ড মাস্টার হওয়ার জন্য সব রকমের চেষ্টা করবো। ইতিমধ্যে আমার রেটিং পয়েন্ট ২৩০০ এর উপর আছে। গ্র্যান্ড মাস্টার হতে হলে ২৫০০ রেটিং পয়েন্ট পেতে হবে এবং অর্জন করতে হবে তিনটি আর্ন্তজাতিক গ্র্যান্ড মাস্টার নর্মও। অসম্ভব নয়। একাগ্রচিত্তে খেলা চালিয়ে গেলে সেটা সম্ভব। এজন্য আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আর আমি তা করে যাচ্ছি। তার ফলও পাচ্ছি। আমি একাধিক আর্ন্তজাতিক গ্র্যান্ড মাস্টারকে হারিয়েছি যা আমার আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
একটা সময় আমাদের সাক্ষাৎকার পর্বটি আড্ডায় পরিণত হয়। তাঁর কাছে জানতে পারি দাবার বিভিন্ন বিষয়। সে জানায়, দাবা চ্যাম্পিয়নদের কখনো গ্র্যান্ড মাস্টার বলা হয়না। যদি তারা ‘গ্র্যান্ড মাস্টার’ হন তাহলেই বলা হয়। মানে চ্যাম্পিয়ন হওয়া আর গ্র্যান্ড মাস্টার দুটো ভিন্ন জিনিস। গ্র্যান্ড মাস্টার হতে হলে ধাপে ধাপে ‘নর্ম’ অর্জন করতে হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। আনন্দ সাহা বিশ্বের দাবাড়ুর পাশাপাশি বাংলাদেশের দাবাড়ুদের খবরও রাখেন। তিনি জানালেন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৫ জন পুরুষ গ্র্যান্ড মাস্টার এবং একজন মহিলা গ্র্যান্ড মাস্টার আছেন। বেশ কয়েকজনের নামও বললেন। সেসাথে বর্তমানে ভারতের দাবাড়ুরা খুব ভালো করছেন সেটাও জানালেন।
আনন্দ সাহা কানাডার প্রায় সব প্রদেশেই দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তিনি একাধিকবার কুইবেক চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু। বাবার অনুপ্রেরণা ছাড়াও তাঁর স্নেহময়ী মা সুস্মিতা সাহা সব সময়ই উৎসাহ দিয়ে আসছেন। সাধারণত আমাদের সংস্কৃতিতে ক্যারিয়ার নির্ভর অর্থ্যাৎ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারের প্রত্যাশা করেন বাবা-মা। এখানে ব্যতিক্রম উত্তম কুমার সাহা এবং সুস্মিতা সাহা। দাবার প্রতি ছেলের আগ্রহ এবং ভালোবাসাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। তার ফলও পাচ্ছেন। দাবার পাশাপাশি পড়ালেখায়ও আনন্দ ভালো করছে।
আনন্দ সাহা আরো জানান, জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক অনেক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ ছাড়াও তিনি জুনিয়রদের কোচিং করান। দাবা কোচিং পার্টটাইম পেশা হিসেবে ভালো আয় করা যায়।
আনন্দ সাহার সাথে আমাদের এ আড্ডা ঘন্টাখানিক চলার পর তাকে চলে যেতে হয় আরেকটি দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য। তাঁর সাথে কথা বলে খুবই ভালো লেগেছিল তার আত্মবিশ্বাস দেখে। একজন খেলোয়াড়ের প্রধান গুণই আত্মবিশ্বাস। হয়তো বা অদূর ভবিষ্যতে আনন্দ সাহা প্রথম বাংলাদেশী ক্যানাডিয়ান গ্র্যান্ড মাস্টার খেতাবে ভূষিত হবেন। যা হবে আমাদের গর্ব করার মতো একটি বিষয় হবে। আর আনন্দ যদি তা হয় তবে আমার ব্যক্তিগত আনন্দের সীমা থাকবে না। কারণ তার প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র সাক্ষাৎকারটি আমি নিয়েছি এবং ভোরের আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাই তাঁর সাথে আমরাও ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবো অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে। শুভকামনা আনন্দ সাহার জন্য।