লিখেছেন ইমরান মাহফুজ
বাংলাদেশের অন্যন্য স্মৃতিসৌধ; কোল্লাপাথরের টিলায় শায়িত ৫০ যোদ্ধার সমাধিস্থল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলায় একটি ছোট টিলার উপরে অবস্থিত। কসবা বাংলাদেশের একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা যা মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ নম্বর সেক্টরের আওতায় ছিল এবং এর পাশের ভারতের আগরতলা, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থাকার কারণে এ অঞ্চলটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল।
বায়েক ইউনিয়নের লাল মাটির টিলা ঘেরা গ্রাম কোল্লাপাথর। গ্রামটির বিশেষত্ব উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ভারতের আগরতলা। মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লা-আখাউড়া, ভৈরব এবং ঢাকা শহর, ফরিদপুর ও নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ ছিল ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে। মেজর খালেদ মোশারফ (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর) ও মেজর এ এম এন নূরুজ্জামান (সেপ্টেম্বর -ডিসেম্বর) ছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার।
২ নম্বর সেক্টরটি আবার ছয়টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে তিনটি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এই তিনটির একটির অন্তর্গত ছিল কোল্লাপাথর। যুদ্ধের সময় মুক্তাঞ্চল হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের অন্যতম আশ্রয়স্থল ছিল কোল্লাপাথর।
এই টিলার জায়গাটি যিনি দান করেছিলেন সেই আব্দুল মান্নানের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমের ভাষ্যমতে, “জুন মাসের ৬ তারিখ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আর্টিলারি শেলে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় শহীদ হন হাবিলদার তৈয়ব আলী। চতুর্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর সাব সেক্টরের ক্যাপ্টেন গাফফার আমাকে ডেকে নিয়ে লাশ দাফনের জন্য জায়গা খুঁজে বের করতে বলেন। আমি বলি, আমাদের পারিবারিক একটি কবরস্থান আছে, সেটি খুব নিরাপদ। ক্যাম্পের কয়েকজন এসে জায়গা পছন্দ করেন। আমি আমার বাবা-মায়ের হাতে লাশ বুঝিয়ে দিই। গ্রামবাসীর সহযোগিতায় আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে তৈয়ব আলীকে দাফন করা হয়।”
সেই থেকে শুরু। এক, দুই, তিন করতে করতে পঞ্চাশ। তবে এটি আর এখন পারিবারিক কবরস্থান নেই। এখানে এনে দাফন করা হয় ৫০ বীর সেনানীকে।
অনেকক্ষণ কথা বলে জানা গেল মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিম প্রতিদিন সমাধিস্থল পরিষ্কার করা, কেউ এলে ইতিহাস বলা, আপ্যায়ন ইত্যাদিতে ব্যস্ত রাখেন নিজেকে। এ ছাড়া সমাধিস্থলের উন্নয়নে দেশের বিশিষ্টজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাও নিয়মিত কাজ আব্দুল করিমের। কথার এক ফাঁকে আবেগাপ্লুত হয়ে আরও বলেন, যাদের কবর এখানে রয়েছে তাদের স্বজনরা মাঝে-মধ্যে এখানে আসেন। জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেন। বেশিরভাগেরই আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। এ ছাড়া প্রতিবছরই বিশেষ করে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে শহীদদের পরিবারের লোকজন এখানে এসে শ্রদ্ধা জানিয়ে যান।
কোল্লাপাথরে সমাহিত শহীদরা হলেন—সিলেটের হাবিলদার তৈয়ব আলী, ঠাকুরগাঁওয়ের সৈনিক দর্শন আলী, আর কে মিশন রোড ঢাকার মো. জাকির হোসেন, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুল জব্বার (মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখনো স্বীকৃতি পাননি), বগুড়ার ল্যান্স নায়েক আবদুস সাত্তার (বীর বিক্রম), কুমিল্লার সিপাহী আক্কাছ আলী, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. ফকরুল আলম, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. ফারুক আহম্মদ, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মোজাহিদ নুরু মিয়া, ময়মনসিংহের নায়েক মোজাম্মেল হক, নোয়াখালীর নায়েক সুবেদার মো. আবদুল সালাম (বীর বিক্রম), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. নোয়াব আলী, ফরিদপুরের সিপাহী মুসলীম মৃধা, শরিয়তপুরের প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুল অদুদ, কুমিল্লার সিপাহী জসিম উদ্দীন, কুমিল্লার মো. আবদুল কাসেম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী), কুমিল্লার মো. মোশারফ হোসেন, কুমিল্লার নায়েক সুবেদার মইনুল হোসেন (বীর উত্তম), চাঁদপুরের সিপাহী মো. নুরুল হক, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুল কাইয়ুম, কুমিল্লার সিপাহী হুমায়ুন কবির, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার ল্যান্স নায়েক মো. আ. খালেক, কুমিল্লার ল্যান্স নায়েক আজিজুর রহমান, কুমিল্লার মো. তারু মিয়া, চট্টগ্রামের নায়েক সুবেদার বেলায়েত হোসেন (বীর উত্তম), ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. রফিকুল ইসলাম ও মো. মোরসেদ মিয়া, কিশোরগঞ্জের শ্রী আশু রঞ্জন দে, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. তাজুল ইসলাম, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. শওকত, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুস সালাম সরকার, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. আমির হোসেন, চাঁদপুরের মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ্রী পরেশ চন্দ্র মল্লিক, কুমিল্লার মো. জামাল উদ্দিন, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুল আউয়াল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. জাবেদ আহাম্মদ, কুমিল্লার মো. সিরাজুল ইসলাম, কুমিল্লার মো. ফরিদ মিয়া, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. মতিউর রহমান, কুমিল্লার মো. সাকিল মিয়া, চাঁদপুরের আনসার ইলাহী বক্স পাটোয়ারী (বীর প্রতীক), ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুর রশিদ, সিপাহী শহিদুল হক, সিপাহী আনোয়ার হোসেন, কুমিল্লার সিপাহী মো. আবদুল বারী খন্দকার এবং অজ্ঞাত তিনজন।
প্রত্যেকের কবরের সামনেই তাঁদের নাম-ঠিকানা লেখা আছে। এ ছাড়া সমাধিস্থলে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে শহীদদের নাম-ঠিকানাসংবলিত শ্বেত পাথরের দুটি বড় ফলক। “একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা” শিরোনামের ফলকে ৪৭ জন শহীদের নাম। বাকি তিন জন অজ্ঞাত। টিলার উপর সমাধিস্থল সাদামাটা হলেও মমতার স্পর্শ লেগে আছে সর্বত্র। উল্লেখ্য, এখানে সমাধিস্থ নায়েক সুবেদার মইনুল ইসলামের নামেই ঢাকা সেনানিবাস এলাকার অতি পরিচিত মইনুল সড়কটির নামকরণ।
এর মাঝে শরিয়তপুরের প্রকৌশলী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে একটি কবর সমান খালি জায়গা কেন রাখা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নজরুল ইসলাম মারা গিয়েছিলেন একটি হাসপাতালে। মৃত্যুর আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন তাকে যেখানেই সমাহিত করা হোক না কেন তার পাশে যেন স্ত্রীর জন্য জায়গা রাখা হয়। তার স্ত্রী এখনও বেঁচে রয়েছেন। ঢাকায় থাকেন। তাই জায়গাটি ফাঁকা।
১৯৭২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা প্রশাসক ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় স্থানটি সংরক্ষণ করেন। এছাড়াও রেস্ট হাউস, তোরণ এবং পুকুরের পাকা ঘাট নির্মাণ করে সুন্দর একটি পরিবেশ করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল করিম। নিজে থাকেন সমাধিস্থলের পাশেই পৈতৃক ভিটায়। আট মেয়ে ও তিন ছেলের বাবা আব্দুল করিম নিজের অবর্তমানে সমাধিস্থলের এই সমাদরটা থাকবে কি না এই নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন মাঝেমধ্যে।
তবু শেষ জীবনের স্বপ্ন, পাহাড়ি সৌন্দর্যময় এমন একটি ঐতিহাসিক স্থানে আশপাশের জমি অধিগ্রহণ করে এ এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও সাড়ে ১১শ’ মুক্তিযোদ্ধার কবর, জাতীয় চার নেতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ও একটি হেলিপ্যাডের সমন্বয়ে সমাধিসৌধসহ কমপ্লেক্স গড়ে তোলা।
ইমরান মাহফুজ, কবি, গবেষক ও সম্পাদক কালের ধ্বনি।