ভোরের আলো রিপোর্ট: কানাডার ব্যবসায়ী তারেক রানাকে নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। তাকে নিয়ে কানাডার টরেন্টোর বাঙ্গালিপাড়ায় চলছে নানা আলোচনা। অনেকেই বলাবলি করছেন, বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী খন্দকার তানভির ইসলাম ওরফে জয়ই আসলে তারেক রানা। নিজের পরিচয় গোপন করে তিনি এখন কানাডার টরোন্টোতে আস্তানা গেড়েছেন। কারন জয় ও তারেক রানার ছবিতে, শরীরী চিহ্নে, বাবার নাম, জন্মতারিখ এমনকি স্ত্রীর নাম- সব কিছুতেই আশ্চর্য রকমের মিল রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, দু’জনেরই দুই পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে। যদিও তারেক রানা দাবি করছেন, তিনি কিছুতেই খন্দকার তানভির ইসলাম ওরফে জয় নন। বাংলাদেশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ডন’ তানভিরের সঙ্গে তার এত্ত মিল তাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। যদিও ইন্টারপোলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, তাদের জারি করা ‘রেড কর্নার নোটিস’ যার বিরুদ্ধে, সেই খন্দকার তানভির ইসলাম এবং কানাডার উদ্যোক্তা তারেক রানা আসলে একই ব্যক্তি। ২০১৪ সালে কলকাতা থেকে
কানাডা আসেন তারেক রানা। এখন কানাডাতেও লাপাত্তা তিনি। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, তানভির ইসলাম জয় বাংলাদেশে কয়েক ডজন খুন, চাঁদাবাজি ও অপহরণের মামলায় অভিযুক্ত। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের অনুরোধে ইন্টারপোলে তার বিরুদ্ধে ‘রেড কর্নার নোটিস’ জারি হয়। বাংলাদেশ পুলিশ জানায়, সেই সময়েই তারা জয়ের মাথার দাম ঘোষণা করেছিল ৫০ হাজার টাকা। বাংলাদেশের কুখ্যাত সেভেন স্টার গ্যাংয়ের প্রধান ছিল জয়। ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করত ‘সেভেন স্টার গ্যাং’। টাকা না দিলে খুনও করতে পিছপা হত না তারা। বাংলাদেশ পুলিশের দাবি, ২০০৬ সালের ১৪ মে ট্টাভেল এজেন্ট ‘তুর্কি অ্যাসোসিয়েট’-এর মালিককে ৮ লাখ মার্কিন ডলার চেয়ে ফোন করে জয়। টাকা না দেওয়ায় ওই সংস্’ার অফিসে ঢুকে ৬ জনকে ণ্ডলি করে খুন করে জয়ের লোকজন। জয় তখন সিঙ্গাপুর থেকে ফোন করে টাকা চেয়েছিল বলে বাংলাদেশ পুলিশের দাবি। এ রকম একের পর এক খুনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ঢাকা পুলিশের দাবি, এখনও শহরের বুকে জয়ের দলবল চাঁদা তোলে একই রকমভাবে। ৫ কোটি পর্যন্ত চাঁদা চায় জয়ের গ্যাং। এক সময়ে নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসাবেও পরিচয় দিত সে। কিন্তু, জয়কে সেই সময় কেউ ধরতে পারেনি। এর পরের ঘটনা ভারতের কলকাতায়। সেটা ২০০৭ সাল। বাণ্ডইআটির চীনার পার্কের একটি বাড়ি থেকে জয়কে গ্রেপ্তার করে সেখানকার সিআইডি। দেখা যায়, ভোল বদলে তারেক রানা নামে সে গা ঢাকা দিয়েছিল বাণ্ডইআটির ওই ভাড়া বাড়িতে। ভুয়া নথির মাধ্যমে তারেক রানা নামে সে তত দিনে ভারতীয় পাসপোর্ট থেকে শুরু করে ড্রাইভিং লাইসেন্স সবই জোগাড় করে ফেলেছে। কলকাতায় তখন তার পরিচয় ‘জি ফ্যাশন’ নামে একটি পোশাক সংস্থার মালিক! ভারতীয় সিআইডি তার বিরুদ্ধে আলাদা পাঁচটি মামলা দায়ের করে। সেই সময় সিআইডির ডিআইজি (অপারেশনস) ছিলেন সিআইডির বর্তমান এডিজি রাজীব কুমার। তার নেতৃত্বেই তৈরি হয় স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ। তারাই গ্রেপ্তার করে জয়কে। এই মামলাণ্ডলো যখন চলছে, তখনই জয়কে ফেরত পেতে ভারতকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। সেই সময়ে স্পেশাল অপারেশন গ্রুপের এক সদস্য জানান, ওই প্রত্যর্পণ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই জামিন পেয়ে যায় জয়। তার পর প্রায় কর্পূরের মতো সে কলকাতার বুক থেকে উধাও হয়ে যায়। এর পর জয়ের আর কোনও ‘খোঁজ’ পাওয়া যায়নি। কানাডার অভিবাসন দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে পর্যটক ভিসা নিয়ে সে দেশে তারেক রানা নামে এক ব্যক্তি যান। সেই তারেক রানাকেই ২০১৪ সালে কানাডার অভিবাসন দফতর ১০ বছরের ভিসা দেয়। তখন থেকেই তিনি সেখানে আছেন। ইতোমধ্যে কলকাতা থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে কানাডার টরোন্টোর শহরতলি আয়াঙ্ে ওই ‘ভারতীয়ের’ নাম একজন সফল ব্যবসায়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। তারেকের দাবি, তার জন্ম থেকে বড় হওয়ার সবটাই কলকাতায়। আয়াঙ্রে অভিজাত এলাকায় তার ‘এসজে ৭১’ সংস্থার বিশাল অফিস রয়েছে। নিয়মিত তাকে সেখানকার ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দেখা যায়। বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত মোটা অংকের অর্থসাহায্য করেন তিনি। এমনকি সেখানকার রাজনৈতিক দলণ্ডলোর তহবিলেও দেন মোটা অংকের চাঁদা। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে তারেককে একজন উদ্যোক্তা হিসেবেও বর্ণনা করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, তিনি সে দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, এনেছেন বিনিয়োগও। কলকাতার উদ্যোক্তা হিসেবে আয়াঙ্ে থাকা তারেক রানার সঙ্গে কলকাতায় গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশি ডনের একের পর এক সাদৃশ্য খুঁজে পান কানাডার পুলিশ কর্মকর্তারাও। ২০১১ সালে প্রথম বার কানাডা যান তারেক রানা। ২০১৪ সালে তৈরি করেন সম্পত্তি কেনাবেচার ‘এসজে ৭১’ সংস্থা। সম্প্রতি ‘এসজে ৭১’-এর ডিরেক্টর তারেক রানার সঙ্গে বাংলাদেশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ডন’ তানভিরের সঙ্গে সব রকম মিল খুঁজে পেয়েছে কানাডা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। গোয়েন্দা বিভাগ বলছে, ২০০৫ সালে খন্দকার তানভির ইসলাম ওরফে জয়ের যে ছবি ইন্টারপোলের রেড কর্নার নোটিসে রয়েছে, তার সঙ্গে ২০০৭ সালে কলকাতায় গ্রেফতার হওয়া জয়ের ছবি এবং তারেক রানার সাম্প্রতিক ছবিতে সাদৃশ্য রয়েছে। এছাড়া খন্দকার তানভিরের বাবার নাম এবং তারেক্ রানার বাবার নাম একই অর্থাৎ খন্দকার নজরুল ইসলাম। তাদের দু’জনের জন্মসালও এক, ১৯৬৭। একই সঙ্গে উভয়েরই দুইপায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে। তার চিহ্নও দু’জনের শরীরেই রয়েছে। এছাড়াও পাসপোর্টে তাদের দু’জনের স্ত্রীর নামও একই বলে জানা গেছে। শুধু কানাডার অভিবাসন দফতর নয়, সিআইডির কর্মকর্তারা, যারা জয়কে ২০০৭ সালে কলকাতায় গ্রেপ্তার করেছিলেন, তারাও কানাডার তারেক রানার ছবি দেখে এক মুহূর্তে চিনতে পারছেন। তারা নিশ্চিত, বাংলাদেশের কুখ্যাত ডন খন্দকার তানভির ইসলামই আসলে এই তারেক রানা। গেল অক্টোবরে কানাডার অভিবাসন দফতর একাধিকবার জয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরপর হঠাৎ করেই অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ তিনি ‘উধাও’ হয়ে যান। কানাডায় তার পরিচিতদের তারেক জানিয়েছিলেন, তিনি কলকাতায় যাচ্ছেন। ২৮ নভেম্বরের মধ্যে তিনি ফিরবেন এজাঙ্ে। ডিসেম্বরের ৯ তারিখ পর্যন্ত তিনি কানাডায় ফেরেননি। তিনি কোথায় আছেন জানতে তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে ওই মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে বাংলাদেশ পুলিশের দাবি, তারেক রানা বর্তমানে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে রয়েছেন। কানাডা পুলিশ জানিয়েছে, তার এজাঙ্রে অফিস তালাবদ্ধ। পাওনাদাররা টাকা না পেয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।