হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ
এ পৃথিবীতে আমরা কেউ অবিনশ্বর নই। সবাইকে একসময় এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে।
তেমনিভাবেই পরম সত্যের মুখোমুখি হয়ে জীবনের সর্বশেষ পরিণতি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হলো শ্রদ্ধেয় সাদেক হোসেন খোকাকে, মাত্র ৬৭ বছর বয়সে। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ সাবেক মেয়র, মন্ত্রী, রণাঙ্গনের গেরিলা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রদ্ধেয় সাদেক হোসেন খোকা গত সোমবার ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর এই মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বমহলে এবং মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই শোক জানাতে থাকে তাঁর নিজ দল বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ সব রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। সবাই তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের সাফল্যের নানা দিক তুলে ধরেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও ছেয়ে যায় এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুসংবাদের শোক। সব স্তরের মানুষ তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি। ২০১৪ সালের ১৪ মে চিকিৎসার জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং সেখানেই তাঁর চিকিৎসা চলছিল।
জনপ্রিয় এই রাজনীতিবিদ দলীয়ভাবে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
সাবেক মন্ত্রী; অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র থাকলেও এসব পরিচয় ছাপিয়ে খোকা খ্যাতিমান ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অসীম। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তিনি নিবেদিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। ঢাকার মেয়র থাকাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ঢাকার বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করেছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধারা কে কোন দল করেন, তা কখনো দেখেননি তিনি। একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ই ছিল সবচেয়ে বড়। মুক্তিযুদ্ধে সফল এই গেরিলা যোদ্ধা অতঃপর জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন এবং ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ওই সময় স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষণা এলে সাদেক হোসেন খোকা পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়েই গোপনে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। ট্রেনিং শেষ করার পর তিনি কখনো সম্মুখযুদ্ধে আবার কখনো গেরিলাযুদ্ধে ঢাকায় বিভিন্ন অপারেশন চালিয়েছেন, যা তিনি তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধের স্বর্ণালী দিনগুলো’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের কথা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চিন্তা করলে তাঁর মন সব সময় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত। তিনি বলতেন মন শুধু রণাঙ্গনের সাহসী সহযোদ্ধাদের হারানোর কারণেই ভারাক্রান্ত হয় না, তার চেয়েও বেশি হয় মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-চেতনার দুর্দশা দেখে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা স্বপ্ন যা-ই বলি না কেন সেটা শুধু একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নয়, একটি সার্বিক মুক্তিই ছিল এ মহান যুদ্ধের মূল স্পিরিট। সে কারণেই এর নাম হয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ’। সত্যিই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর এই আবেগ সবাইকে ব্যথিত করে এবং অনুপ্রেরণা দেয়।
১৯৮০-র দশকে সাদেক হোসেন খোকা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিতে যোগদান করেন। অবিভক্ত ঢাকা মহানগর বিএনপির সভাপতিসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন খোকা। নব্বইয়ের দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ছিলেন খোকা। পুরান ঢাকার নয়াবাজার নবাব ইউসুফ মার্কেটে বিএনপির কার্যালয় থেকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেন ৭ দলীয় জোটের নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এই কঠোর আন্দোলনে ঢাকা মহানগর সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব পেয়েছিলেন খোকা। বিভিন্ন সময় আন্দোলনে রাজপথের এই রাজনীতিবিদ প্রতিপক্ষের হামলায় রক্তাক্ত হয়েছেন বারবার। ১৯৯০ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার চেষ্টা হলেও তা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সাদেক হোসেন খোকা। এতে করে পুরান ঢাকাবাসীর কাছে একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ হিসেবে তিনি আস্থা অর্জন করেন। ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়ে ২০১১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত টানা ১০ বছর ঢাকাবাসীর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। জনবান্ধব নেতা হিসেবে যথেষ্ট সুনাম ছিল তাঁর। তাঁর নেতৃত্বে পুরান ঢাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষসহ দল-মত-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের বিপদে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন। যখনই তাঁরা তাঁকে ডেকেছেন, তখনই তিনি ছুটে গেছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, বিনয়ের সঙ্গে সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছেন। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অপরিসীম। তিনি শুধু রাজনীতিতে নন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরেই ১৯৭২ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়নের দায়িত্ব নিয়ে ক্লাবকে তিন বছরের মধ্যে তৃতীয় থেকে প্রথম বিভাগে উন্নীত করেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা খোকা ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ও ফরাশগঞ্জ ক্লাবের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ছিলেন। জনবান্ধব নেতা হিসেবে যথেষ্ট সুনাম ছিল তাঁর। এ জন্য তিনি পেয়েছেন ঢাকাবাসীর বিপুল সমর্থন এবং তা তাঁকে পরিচিত করে তুলেছে সমগ্র মানুষের কাছে।
বলাবাহুল্য মুক্তিযুদ্ধের এই গেরিলা যোদ্ধা যখন কিডনি ক্যান্সারের জন্য নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, তখন ২০১৭ সালে পাসপোর্ট নবায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু বারবার আবেদন করেও নানা অজুহাতে তিনি তাঁর পাসপোর্ট নবায়ন করতে পারেননি। যে মাটির জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন সেই মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু পাসপোর্ট আটকে থাকায় শেষ ইচ্ছার আক্ষেপ নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রেই অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হলো তাঁকে। তবে তাঁর মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের আন্তরিকতা প্রশংসার দাবিদার।
বর্তমান রাজনীতি ও গণতন্ত্রের সংকটকালে অহিংস ও পরমতসহিষ্ণুতার মতো নেতার খুব প্রয়োজন ছিল। জীবনের পথপরিক্রমায় তিনি প্রতি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছেন। অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা তাঁকে যেমন রাজনীতির শীর্ষ শিখরে নিয়ে গেছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিশাল ভূমিকার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা খেতাবে ভূষিত করেছে। অসময়ে তাঁর এই চলে যাওয়া রাজনীতির অঙ্গনে বিরাট এক শূন্যতা তৈরি করবে, নিঃসন্দেহে তা বলা যায়। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, আইনের শাসন ও উদারনৈতিক গণতন্ত্রে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী ছিলেন এই মানুষটি। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাঁর অবদান ছিল সর্বজনবিদিত। পক্ষান্তরে রাষ্ট্র ও সমাজের অসংগতি, ত্রুটি বা দুর্বল দিকগুলো অপসারিত করে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেটাই ছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ও প্রচেষ্টা। গণতন্ত্র রক্ষা, মানবাধিকার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সামনের কাতারের সৈনিক ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। কিন্তু অকস্মাৎ তাঁর এই মৃত্যু আমাদের সবাইকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছে, মর্মাহত করেছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে মৃতদেহ আসার পর সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাঁর লাশটি রাখা হলে তাঁর প্রতি সম্মান দেখানো হবে সবচেয়ে বেশি। মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদান ও মানব কল্যাণে নিবেদিত এই মানুষটির জন্য নিশ্চয়ই সেটা প্রাপ্য।
লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি