কথিত আইনি লড়াইয়ের নামে অনুগত বিচারক রঞ্জন গগৈকে দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদকে দখল করে নিলো উগ্রবাদী হিন্দুদের গডফাদার খ্যাত নরেন্দ্র মোদি। ফরমায়েশি এই রায়ের মাধ্যমে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট শুধু ভারতীয় মুসলমানদের প্রানকেন্দ্র ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদকেই দখল করেনি, দেশটির আইনের শাসনকেও পদদলিত করেছে। এছাড়া এই রায়ের মাধ্যমে ভারতের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এটাও প্রমাণ করলেন যে, ন্যায়বিচার শুধু সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দুদের জন্যই। এদেশে মুসলমানদের ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো অধিকার নেই।
যেসব যুক্তি দেখিয়ে বিচারকরা বাবরি মসজিদের জায়গাটি রাম মন্দিরের জন্য হিন্দুদের দিয়েছেন, সেগুলো পর্যালোচনা করলেও দেখা যায় এখানে কোনো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। শুধু সামাজিক, রাজনৈতিক ও হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে বিবেচনায় এনে মামলার রায় দেয়া হয়েছে। বলা যায়-বিচারের নামে এখানে চরম ভাওতাবাজি করেছেন ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট।
রায়ের পর্যালোচনা:
রায়ের দুই নাম্বার পয়েন্টে সুপ্রিমকোর্ট বলেছে, মসজিদের নীচে যে কাঠামোর সন্ধান মিলেছে তা যে কোনো মন্দিরের ছিল তার প্রমাণ মিলেনি। আর সেই সময় যদি এটা হিন্দুদের কোনো স্থাপত্য হয়েও থাকে তাহলে আজকের দিনে এসে সেটাকে হিন্দুদের জমি হিসেবে ধরে নেয়া যায় না।
এখানে বিচারকদের কথা মতোই এটা হিন্দুদের জমি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। অথচ আইন প্রক্রিয়া হলো- কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে হলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হতে হয়। এখানে বিচারকরা আইন মানেন নি।
এরপর তিন নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছে-এই স্থানকে যে হিন্দু ভগবান রামের জন্মস্থান হিসেবে বিশ্বাস করেন, তাতে কোনো সংশয় নেই।
আইনি প্রক্রিয়া হলো যথাযথ সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। কারো বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে কোনো মামলার রায় হতে পারে না। এখানে আদালত কোনো প্রকার প্রমাণ ছাড়াই শুধু হিন্দুদের বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে তাদের পক্ষে রায় দিয়েছে।
তারপর, সাত নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছে-মুসলমানদেরকে অযোধ্যায় ভাল ৫ একর জমি দিতে। যেখানে তারা অন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করবে।
এখানেও প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। একটি পুরনো ও ঐতিহাসিক মসজিদ অন্যায়ভাবে হিন্দুদেরকে দিয়ে মুসলমানদেরকে খয়রাতি দেবে কেন? রাম মন্দির করার জন্য হিন্দুদেরকে ৫ একর জমি দেয়ার নির্দেশ দেয়নি কেন আদালত? এখানে প্রমাণিত হলো-ধর্ম বিদ্বেষ থেকেই বিচারকরা এই রায় দিয়েছেন।
এরপর, আট নম্বর পয়েন্টে সুপ্রিমকোর্ট বলেছে-১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা বেআইনি ছিল।
সুপ্রিমকোর্ট যেহেতু বলছে ৯২ সালে মসজিদ ভাঙা বেআইনি ছিল তাহলে তো বিষয়টির মিমাংসা হয়ে গেছে। হিন্দুরা আর এই জায়গার মালিক হতে পারে না। তাই, হিন্দুদেরকে বাবরি মসজিদের জায়গা দিয়ে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট বেআইনি কাজ করেছে। তাদের এই রায় ন্যায়বিচারের মধ্যে পড়ে না।
আর নয় নম্বর পয়েন্টে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট বলেছে- হিন্দুদেরকে মসজিদের জায়গাটা দিয়ে দেয়াটা ধর্মীয় সম্প্রীতি ও আইনশঙ্খলা রক্ষার সাথে সম্পৃক্ত।
এটা থেকে প্রমাণিত হয়-বাবরি মসজিদ মামলার বিচারে কোনো প্রকার আইনি প্রক্রিয়ার অনুসরণ করা হয়নি। মোদি সরকার এবং উগ্রবাদী হিন্দুদের চাপের মুখে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট এই রায় দিয়েছে।
এছাড়া বিবিসির সাক্ষাতকারে ভারতের প্রধান শহরের বিশিষ্ট মুসলিম নারীররা প্রশ্ন তুলছেন, “১৯৯২-র ৬ ডিসেম্বর যদি বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার তীব্র দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি না-ঘটত, তাহলেও কি আজ সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দিতে পারত?”আজকের দিনটিকে ‘ভারতীয় সংবিধানের জন্য একটি চরম অমর্যাদার মুহুর্ত’ হিসেবেই দেখছেন।
তারা বলছেন, সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য অনুযায়ী কোর্ট মেনে নিয়েছে মসজিদের নিচে কিছু একটা স্থাপনা ছিল। কিন্তু সেটা কি কোনও মন্দির, বা মন্দির হলেও রামের মন্দির না কি অন্য কোনও দেবতার – সেটাই বা কে বলল? আসলে প্রশ্নটা তো শুধু এক টুকরো জমির নয়, এখানে ভারতের সামাজিক সম্প্রীতির চেহারা কিংবা এ দেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থানের চিত্রটাও কিন্তু এই মামলার সঙ্গে জড়িত।
একটা সম্পূর্ণ ‘তৈরি করা বিবাদ’ যে এভাবে দেশের শীর্ষ আদালত পর্যন্ত গড়াতে দেওয়া হল, আমি তাতে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ বলে মন্তব্য করেছেন ভারতী ড: মীরাতুন নাহার
দেশপ্রেমী একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আমি ভাবতেই পারি না, যাদেরকে আমরা দেশের ক্ষমতায় বসিয়েছি তারা কীভাবে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিকে এভাবে উসকানি দিতে পারেন!
শুধুমাত্র নিজেদের সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থের কথা ভেবে তারা ভারতের মহান সংবিধানকেও অপমান করলেন।
জমির দখল নিয়ে বিবাদ, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ দুটো পরিবারের মধ্যে হয়, কখনও বা কোর্টেও গড়ায় – এটাই চিরকাল জেনে এসেছি।
কিন্তু সেই জমির বিবাদকে ঘিরে দেশের দুটো ধর্মীয় সম্প্রদায়কেও যে লড়িয়ে দেওয়া যায় তা কখনও ভাবতেও পারিনি – আর সে কারণেই পুরো বিষয়টা আমার কাছে এতটা কষ্টদায়ক!
তিনি বলেন, আজকের রায় নিয়ে আর কী বলব? কোর্টে গেলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, তাই সেটা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার মানে হয় না।
আমার প্রশ্ন তাই একটাই, এই যে বিবাদ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া হয়েছিল সেটা কি আপনা থেকেই তৈরি হয়েছিল না কি সচেতনভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল?