হয়তো আপনি রন্ধনশিল্পী নন। রান্না-বান্নায় তত আগ্রহীও নন, কাজটাকে রীতিমতো ঝামেলা মনে করেন। তবে মাঝেমধ্যে অতিথি আপ্যায়নে বা কোনো খাবারের স্বাদ নিজের মতো করে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষায় হয়তো আপনার রাঁধতে মন চায়। আর সে ক্ষেত্রে আপনার সম্বল হচ্ছে রান্নার একেবারেই ছকবাঁধা সাধারণ কিছু জ্ঞান। অর্থাৎ, আপনি জানেন, চুলা জ্বেলে তাতে হাঁড়ি বসিয়ে রান্না শুরু করতে হয়। এমন রান্না জ্ঞান নিয়েও ভিন্ন ঘরানার কিছু রাঁধতে এখন আর আপনি অথই সাগরে পড়েন না। সেই দিন অনেক আগেই শেষ হয়েছে। কারণ আপনার হাতের নাগালে আছে অনলাইন রেসিপি।
এই আধুনিকতায় বড় একটি সীমাবদ্ধতা তো রয়েছেই। কিছু জিনিস অনলাইনের কোটি কোটি রেসিপির মধ্যেও খুঁজে পাবেন না। যেমন ধরুন, কিছু রান্না আপনার মা দারুণ করেন। অন্যদের মতো একই উপাদান দিয়ে মা অমুক খাবারটি রাঁধেন। এরপর মা কী যেন একটা ঢালেন, এতে খাবারে চলে আসে অসাধারণ স্বাদ। ঠিক ওই স্বাদের খাবারটি তৈরিতে মায়ের সহায়তা আপনি নিতেই পারেন। যদি মা বেঁচে না থাকেন, আর সেই রান্না আপনি বা কেউ শিখে না রাখেন, তাহলে মায়ের সঙ্গে সেই খাবারের স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
এত উদাহরণ দেওয়ার একটাই কারণ—এমন কিছু বিশেষ রেসিপির কথা তুলে ধরা। এর একটি হলো ভেড়ার মাংসের পাতলা ঝোল। মূল রেসিপিতে যা যা লেখা আছে, এর সব নিয়ে রান্না শুরু করলেন। মাংস প্রস্তুত করা হয়েছে। পানি প্রস্তুত। খাঁটি দানাদার লবণ, যবের শুকনা কেক, পেঁয়াজ, পারস্যের বিশেষ পেঁয়াজ, দুধ, সব একত্র করে তাতে রসুন মাখালেন। তবে এর মধ্যে কী বাদ পড়ল, তা বাবুর্চির কাছ থেকে জেনে নেওয়া একদমই অসম্ভব। কারণ মূল রেসিপিটি যিনি লিখে গেছেন, তিনি চার হাজারের বেশি সময় আগে মারা গেছেন।
বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয়, রন্ধনবিষয়ক আন্তর্জাতিক পণ্ডিতেরা এই রেসিপির পাঠোদ্ধারের কাজ করছেন। একই সঙ্গে তাঁরা বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো আরও তিনটি রেসিপি নিয়ে কাজ করছেন। এটা রন্ধনশালা সম্বন্ধীয় প্রত্নবিদ্যা। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির বেবিলন সভ্যতার সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত ট্যাবলেটের (তক্তায় খোদাই করে লেখা) পাঠোদ্ধার করে রান্নার স্বাদের মাধ্যমে ওই সংস্কৃতির রূপ বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে। বেবিলন হচ্ছে প্রাচীন আক্কাদিয়ান ভাষার রাজ্য ও সাংস্কৃতিক এলাকা, যা কেন্দ্রীয় দক্ষিণ মেসোপটেমিয়া ঘিরে গড়ে ওঠে। ১৮৯৪ খ্রিষ্টপূর্বে আমোরীয় শাসিত রাজ্যটির আবির্ভাব হয়। এর মধ্যে বেবিলনের ছোট প্রশাসনিক শহর ছিল। আর টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদী দুটির মধ্যবর্তী এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে ঐতিহাসিক মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের অবস্থান ছিল। এখনকার ইরাকের বেশির ভাগ, কুয়েত, সিরিয়ার পূর্বাঞ্চল, তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব এবং তুরস্ক-সিরিয়া এবং ইরান-ইরাক সীমান্তে এর অবস্থান।
ইতিমধ্যে বেশ কিছু রেসিপির পাঠোদ্ধারও হয়েছে।
প্রাকৃতিক ইতিহাসের ইয়েল পিবডি মিউজিয়ামের কাচের বাক্সে রাখা নরম মলাটের বইয়ের আকৃতির ট্যাবলেটগুলো দেখিয়ে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রাচীন এই সভ্যতা বিশেষজ্ঞ গোজকো বারজামোভিচ রেসিপিগুলো সম্পর্কে বলেন, এটা অনেকটা গান পুনর্গঠনের চেষ্টার মতো, কোনো একটি নোটের হেরফের থেকে পুরো বিষয়টি পাল্টে যাবে। তিনি ট্যাবলেটগুলো থেকে পাঠোদ্ধারের কাজ করছেন। চারটি ট্যাবলেটের মধ্যে তিনটি ১৭৩০ খ্রিষ্টপূর্বের এবং একটি এক হাজার বছর আগের। সব ট্যাবলেটই বেবিলন ও আসিরিয়াসহ মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের। পুরোনো তিনটি ট্যাবলেটে ২৫টি ঝোলযুক্ত খাবারের উপকরণসহ রেসিপি আছে। আরেকটিতে রয়েছে ১০টির বেশি রেসিপি। এগুলোতে রান্নার প্রক্রিয়া ও পরিবেশনের তথ্য আরও বিশদভাবে আছে। তবে সেগুলো অনেকখানি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পড়া যাচ্ছে না।
এই দলের সদস্য হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির খাদ্য রসায়নবিদ পিয়া সোরেনসেন বলেন, সেগুলো খুব বেশি তথ্যবহুল রেসিপি নয়। হয়তো চার লাইনের। ফলে অনেক বেশি অনুমানের সুযোগ রয়েছে। কাজ করতে গিয়ে যা বোঝা যাচ্ছে, খাবারগুলোতে ঝোলের মাত্রা বেশি। এটা স্যুপের মতো।
রেসিপিগুলো নিয়ে কর্মরত হার্ভার্ড সায়েন্স অ্যান্ড কুকিং ফেলো প্যাট্রিসিয়া জুরাদো গনজালেজ বলেন, খাদ্য উপাদানগুলো আজ এবং চার হাজার বছর আগের একই। মাংসের টুকরা মানে মাংসের টুকরাই। পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে একই প্রক্রিয়া। এখানে একটি বিজ্ঞান রয়েছে, সেটা চার হাজার বছর আগে যা ছিল, এখনো তা আছে।
ইরাকের রন্ধশালাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং এ-বিষয়ক ইতিহাসবিদ নাওয়াল নাসরাল্লাহ বলেন, এটা খুব অবাক করা বিষয় যে, এখন ইরানের প্রধান খাবার যেটি তা হচ্ছে ঝোলের খাবার। এটা প্রাচীন সময়েও প্রধান খাবার ছিল। ইরাকে এটা এখন প্রতিদিনের খাবার তালিকায় থাকে। ঝোলযুক্ত তরকারি, ভাত, সঙ্গে রুটি। এটি সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মতো বিষয় যে, খাবারটি প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত টিকে রয়েছে।