লিখেছেন মাসকাওয়াথ আহসান
সব পরিচয় ছাপিয়ে সাদেক হোসেন খোকার প্রধান পরিচয়; উনি বাংলাদেশ স্বাধীন করতে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। ক্ষমতার চর দখলের আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিভাজনের রাজনীতিতে সারাদেশের মানুষের পাশাপাশি কষ্ট পেলেন একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা। ভাবা যায়- কেবল বিএনপির রাজনীতি করার কারণে মুক্তিযোদ্ধা খোকা দেশছাড়া হলেন। বাংলাদেশের নরভোজি রাজনীতিতে বিএনপির ক্ষমতাযুগে আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকে আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাযুগে বিএনপির অনেক নেতা দেশছাড়া হলেন।
সাদেক হোসেন খোকা, যিনি সম্মুখ সমরে অংশ নিলেন, দেশকে মুক্ত করে দখলদার পাকিস্তানিদের ফেরত পাঠালেন; সেই নিজ হাতে স্বাধীন করা মাতৃভূমি থেকে নিজেই উৎখাত হয়ে গেলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রুদ্ররোষে পড়ে। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেশচ্যুত করার এ ট্র্যাজেডি ইতিহাসে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কলঙ্ক রেখা হিসেবে বিরাজ করবে।
সাদেক হোসেন খোকার প্রবাসে মৃত্যু ইতিহাসের অমোচনীয় দায়; তাকে দেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার।
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা হচ্ছে ক্ষমতাসীনের আদালত। ফলে বিএনপি ক্ষমতাযুগের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দেয়া রায় এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতাযুগের বিএনপি নেতা-কর্মীয় বিরুদ্ধে দেয়া রায় নৈর্ব্যক্তিক নয়। এই অবস্থাটির সুরাহা হওয়া দরকার। বিচার-ব্যবস্থাকে দল নিরপেক্ষ রাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ আর এর নায়ক মুক্তিযোদ্ধারা। রাষ্ট্রব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা ও ভঙুরতার কারণে বাংলাদেশ মুক্তির নায়ক মুক্তিযোদ্ধাদের অবর্ণনীয় কষ্টের মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছে; হচ্ছে। বাংলাদেশে আমাদের হৃদয়ের ইনডেমনিটি কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। তারা সাহস করে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে গিয়েছেন জন্য আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। তাই ফেসবুকের প্রচলিত ‘লাশ কাটা ঘরে’ একজন মুক্তিযোদ্ধার শব ব্যবচ্ছেদ আমাকে ব্যথিত করে। তাই আমি আমার পর্যবেক্ষণ লিখছি প্রচলিত নরভোজি সামাজিক প্রবণতা নিয়ে।
এই পুণ্যভূমিতে ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত সবাই সাধু। আর কথিত সাধুদের দলীয় দৃষ্টিকোণকে যৌক্তিকতা দিতে রয়েছে সুচয়িত সাংস্কৃতিক লিপ-সার্ভিস। এরা এক একজন আরও বড় সাধু; মানুষের পাপ-পুণ্যের হিসাব করে রায় ও দণ্ড দেবার লোকজ আদালত। আইনের শাসন যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়নি; ক্ষমতার খুদকুঁড়ো কুড়িয়ে যেখানে নীতিহীন নাগরিক সমাজ জাড্য-জরদগব আর অমেরুদণ্ডি; সেইখানে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ক্রাইম-এন্ড পানিশমেন্টের মিথ দিয়ে করে-কম্মে খাওয়া যায়। কিন্তু কেউ-ই বিবেকের আয়নায় এতটা পবিত্র হয়ে ওঠেননি যে, কারো দেশের জন্য কান্না নিয়ন্ত্রণ কমিটি গড়ে তুলে কে কাঁদবে কে কাঁদবে না; তা নিয়ে অঙুলি হেলন করবে।
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিটি বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব হয়েছে। ফলে কথিত লিবেরেল ও কথিত মৌলবাদি উভয় শিবিরে কট্টর প্রতিক্রিয়াশীলতার ভ্রান্তি স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ঘটেছে। আর জাতির জনক ‘বঙ্গবন্ধু’-র হত্যাকাণ্ডে অনাথ হয়ে দিক নির্দেশনাহীন হয়ে পড়েছিলো সমাজ। সেইখানে ‘মুক্তিযোদ্ধার ভ্রান্তি’ ইতিহাসের মূল্যায়নে কিছু সহানুভূতি পাবে হয়তো। কেননা দেশের জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন তারা।
ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মৌলবাদী হচ্ছে সে; যে নিজের অভিমতকে অন্ধের মতো সমর্থন করে; আর ভিন্নমতের প্রতি নিষ্ঠুর হয়। যার ঔদার্য নেই; সেই মৌলিবাদি লালন করে; হতে পারে সেটা ধর্মীয় বা দলীয় মৌলবাদ।
বিএনপি দলটি জামায়াতের মতো ধর্মীয় মৌলবাদ লালন করেছে আর আওয়ামী লীগ একদলীয় মৌলবাদ লালন করেছে। সেটা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগকে ওলামা লীগের মতো ধর্মীয় মৌলবাদি শাখা রাখতে হয়েছে; হেফাজতের সঙ্গে খাস জমি বরাদ্দ ও শোকরানা মেহেফিলের মতো মৌলবাদি সরোবরে স্নান করতে হয়েছে। ফলে বিশুদ্ধতা ও পবিত্রতার রূপকথাটি আমার কাছে সোনার-পাথর-বাটি।
আমাদের জীবনে মুক্তিযুদ্ধ করার সুযোগ আসেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে দেশের জন্য এমন বড় কোন কাজও করতে পারিনি; জানিনা সেটা আদৌ সম্ভব কিনা। ফলে মুক্তিযোদ্ধাকে কখন সম্মান করা যাবে; কখন যাবে না; এতো বড় রায় দেবার কোন যোগ্যতাই আমার নেই। আর একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তার মৃত্যুর পরে জাস্টিফাই করা আমার কর্তব্য; তাতে যদি ভ্রান্ত আবেগ থাকে; তার দায়-দায়িত্ব আমার। আমি যে কোন মূল্যে সব মুক্তিযোদ্ধার কাছে আমার ঋণ যতটুকু পারি শোধ করতে চাই।
বিদায় মুক্তিযোদ্ধা খোকা। আপনার জন্য ভালোবাসা রইলো।
“ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।”