নজিরবিহীন কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ মাথায় নিয়ে আগামীকাল বুধবার হতে যাচ্ছে কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন। পদবাণিজ্য, অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন, কৃষকদের দুঃসময়ে পাশে না দাঁড়ানোর অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিনের। কৃষিসংশ্লিষ্ট লোকজনের পরিবর্তে ভিন্ন পেশার মানুষকে অগ্রাধিকার দিয়ে কমিটি গঠনসহ নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডে র জালে আটকা পড়েছিলেন বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্ব। শুধু কি তাই? বাংলাদেশের কৃষক স্থায়ীভাবে বসবাস না করলেও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, আবুধাবি, কুয়েত, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে দেওয়া হয়েছে কমিটি।রাজধানীতে কৃষক না থাকলেও রয়েছে বনানী, গুলশান, বারিধারা, ধানমন্ডিতে কৃষক লীগের কমিটি। দীর্ঘ ৭ বছর পর আগামীকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠেয় এই সম্মেলনকে ঘিরে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। ফলে পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে আগ্রহ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা বেশি। বিশেষ করে শীর্ষ দুই পদ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হতে নিজ নিজ পক্ষে জোর লবিং-তদবিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন আগ্রহীরা। শেষ বেলায় ধরনা দিচ্ছেন মূল দল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রীদের কাছে। সমর্থকদের নিয়ে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শোডাউনও করেছেন কেউ কেউ। দলীয় সূত্রমতে, এবারের সম্মেলনে গঠনতন্ত্রে আনা হচ্ছে বড় ধরনের পরিবর্তন। কেন্দ্রীয় কমিটির আকার ১১১ থেকে বাড়িয়ে ১৫১ জন করা হচ্ছে। বিদেশ কমিটি দিয়ে বাণিজ্য কমাতে সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ক্ষমতা কমিয়ে আনা হচ্ছে। এখন থেকে বিদেশ কমিটি দিতে হলে সংগঠনের কার্যনির্বাহী সংসদের এবং পরবর্তীতে সাংগঠনিক নেত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন লাগবে। গত ২০১২ সালের ১৯ জুলাই সম্মেলনের মাধ্যমে মোতাহার হোসেন মোল্লাকে সভাপতি ও শামসুল হক রেজাকে সাধারণ সম্পাদক করে ১১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে বিভিন্ন পদে সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রেজার পটুয়াখালী জেলার রয়েছে ২৬ জন এবং ১১১ জনের মধ্যে ৩৯ জনই আইনজীবী পেশায়। আইনজীবীরা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় শামসুল হক রেজার একটি বলয় ভারী। এ ছাড়া সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন, লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে গঠনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে কমিটিতে পদ দেওয়াসহ নানা অভিযোগ আছে। যে কারণে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক তদন্ত শুরু করেছে। বিদেশ শাখায় কমিটি দেওয়া, টাকার বিনিময়ে শিল্পপতি, বিভিন্ন পেশাজীবীকে দেওয়া হয়েছে সংগঠনের সহ-সভাপতি থেকে বিভিন্ন পদ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষক লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, মূল কমিটি লিখিতভাবে ১১১ জনের হলেও অলিখিতভাবে এর সংখ্যা প্রায় আড়াইশ ছাড়িয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সভাপতি চিঠিতে স্বাক্ষর করে পদ দিয়েছেন। কারও কারও কাছ থেকে একটি সদস্য পদের বিনিময়ে ৪০ লাখ টাকারও বেশি নেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রেজা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে তা সত্য নয়। আইনজীবীদের আমি নেতা বানাইনি। আমি সংগঠনে যে পরিমাণ সময় দিয়েছি অন্য কেউ তা দেয়নি।’ বিদেশ কমিটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার স্বাক্ষরে একটা বিদেশ কমিটি হয়নি। সুতরাং বিষয়টি বলতে পারব না।’ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষরিত কমিটির বাইরে পদ-পদবি দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু পদ শূন্য ছিল, সে কারণে নতুন করে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, কৃষক লীগের এই বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে মোতাহার হোসেন মোল্লা ও শামসুল হক রেজার নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না আওয়ামী লীগ প্রধান। খোঁজা হচ্ছে নতুন নেতৃত্ব। দক্ষ সংগঠক, কর্মীবান্ধব, দুঃসময়ের কান্ডারি ও সাবেক ছাত্রনেতাদের দেওয়া হবে কৃষক লীগের নতুন দায়িত্ব। সূত্রমতে, সংগঠনের নাম কৃষক লীগ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে কৃষি নিয়ে কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি সংগঠনটির। উল্টো ক্যাসিনোকান্ডে নাম উঠেছে সংগঠনটির এক কেন্দ্রীয় নেতার। যার সঙ্গে কৃষির ন্যূনতম সম্পর্কও নেই। তিনি হচ্ছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোহাম্মদ শফিকুল আলম ফিরোজ। রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের চেয়ারম্যান তিনি। ওই ক্রীড়া ক্লাবটিতে অবৈধ ক্যাসিনো বন্ধে র্যাবের অভিযানের পর গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে তিনি। ফিরোজ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষরিত ১১১ কমিটিতে ছিলেন না। কৃষক লীগের এমন অনেক নেতা রয়েছেন, যাদের কৃষির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই কৃষক সংগঠনটিও কৃষির সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে।
নেতৃত্বে আলোচনায় যারা : কৃষক লীগের সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় রয়েছেন প্রায় দেড় ডজন নেতা। বর্তমান সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা আবারও একই পদে থাকতে চান। তিনি সেভাবেই লবিং তদবির শুরু করেছেন। সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রেজা সংগঠনের সভাপতির পদে আসতে চান। এ ছাড়াও এ পদে আসতে চান বর্তমান কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি খান আলতাফ হোসেন ভুলু, শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, বদিউজ্জামান বাদশা, হারুনুর রশিদ হাওলাদার, বর্তমান সহ-সভাপতি শরীফ আশরাফ আলী, ওমর ফারুক। এ ছাড়াও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সারোয়ার ওয়াদুদ চৌধুরীও আলোচনায় রয়েছেন। সাধারণ সম্পাদক পদে জোর আলোচনায় আছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ সমীর চন্দ চন্দ্র, সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সুইট, আবুল হোসেন, আতিকুল হক আতিক, বিশ্বনাথ সরকার বিটু। এ ছাড়া কৃষক লীগের বর্তমান কমিটির আরও কয়েকজন শীর্ষ দুই পদের জন্য ভিতরে ভিতরে লবিং করলেও প্রকাশ্যে প্রার্থিতার কথা বলছেন না। এদিকে জাতীয় সম্মেলনে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে এবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছাই প্রাধান্য পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ দুটিতে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির আস্থাভাজন ত্যাগী ও দক্ষ নেতাদের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কৃষক লীগের আগামী নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য পদপ্রত্যাশীদের নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ নানা মাধ্যমে আদ্যোপান্ত খোঁজ নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট নেতাদের।
কৃষকের কাচারি ঘরে সম্মেলন : আগামীকাল কৃষক লীগের জাতীয় সম্মেলনকে সফল করতে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই সম্মেলন ঘিরে এখন সাজ সাজ রব বিরাজ করছে। মূলমঞ্চ নির্মাণ করা হচ্ছে কৃষকের কাচারি ঘরের আদলে। সরেজমিন দেখা গেছে, ৯০ ফুট দীর্ঘ ও ৩০ ফুট প্রস্থ সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। মূলত কৃষকের কাচারি ঘরের আদলেই তৈরি করা হয়েছে এই মঞ্চ। মঞ্চের পাশে রাখা হয়েছে ‘আমার বাড়ি-আমার খামার’র একটি মডেল। এতে দেখা যাচ্ছে, কৃষক তার উৎপাদিত ফসল বাজারে বিক্রি করছেন এমন দৃশ্য। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে স্থানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গাড়ি থেকে নেমে মঞ্চে আসবেন, সে প্রবেশ পথ তৈরি করা হয়েছে সবুজ ঘাসে। রাস্তার চারপাশে লাগানো হয়েছে বাঁশবাগান, ফলদি ও ঔষধি গাছ। মোটকথা, কৃষক লীগের সম্মেলনে কৃষকের বাড়িতে আসবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সেভাবেই সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে।