ডঃ শোয়েব সাঈদ
জাপানের গানো প্রিফেকচারের (কেন) ইনা শহরে ২০০১ সালে শিনশু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক জীবনের ইতি টেনে কর্পোরেট চাকুরীতে যোগ দিতে কিয়োশু দ্বীপের ওইতা প্রিফেকচারের (কেন) সাইকি শহরে এসেছিলাম স্বপরিবারে প্রকৃতির উজাড় করা নান্দনিকতায় পাহাড়, সমুদ্র, অসংখ্য সেতু আর টানেল পেরিয়ে দুই দিনে প্রায় ১৭০০ কিমি ড্রাইভ করে।মাঝখানে বিরতি ছিল তৎসময়ে পিএইচডি গবেষক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বন্ধু ডঃ সাইফুল ইসলাম রলিনের হিরোশিমার বাসায়। সাইকি শহরে কর্পোরেট চাকুরীর এক পর্যায়ে আরএন্ডডি সেন্টারের গবেষক থেকে টোকিওর হেড অফিসে ম্যানেজমেন্টে পদে বদলি; সময়টা ২০০৬ সালের দিকে। সাইকি থেকে আবার স্বপরিবারে হাজার কিলমিটার দূরের টোকিওতে। দীর্ঘ ড্রাইভ বাচ্চাদের জন্যে কষ্টকর তাই এবার পশ্চিম জাপানের সাইকি শহরথেকে ড্রাইভ করে টোকিওতে যেতে ইচ্ছে হলনা। অফিস থেকে পরিবারে সবার জন্যে বিমানের টিকেট বরাদ্দের সময় মনে হল বিমানে তো হর-হামেশাই উঠতে হচ্ছে, বুলেট ট্রেনে দীর্ঘ এই যাত্রাটির ব্যবস্থা করলে মন্দ তো নয়।আমার অনুরোধে অফিস থেকে বুলেট ট্রেনের টিকেটের ব্যবস্থা হল।বাচ্চাগুলো জাপানের ট্রেডমার্ক বুলেট ট্রেনে দীর্ঘ ভ্রমণটি বেশী উপভোগ করবে এই ভাবনাই ছিল সিদ্ধান্তের মূল কারণ।
সাইকিতে কোম্পানির বাসায় থাকতাম সহকর্মীদের একটা আন্তরিক পরিবেশে এবং বাসাটি ছিল তিন তালায়। মালামাল পরিবহণে জাপানের বিখ্যাত কিছু কোম্পানি যেমন কুরুনেকো (কালো বিড়াল) তাক্কিউবিন, সাগাওয়া কিউবিন প্রবল জনপ্রিয়। দেখলাম তিনতালা থেকে আসবাদপত্র নামানোর জন্যে আমাদের কোম্পানিরনিয়োগকৃত এজেন্ট ক্রেন নিয়ে হাজির। বারান্দার জানালা খুলে কম পরিশ্রমে, ঝুঁকিবিহীন তৎপরতায়, দ্রুততার সাথে মালামাল লোড করে চলে গেল। পুরো অপারেশনটি ছিল দৃষ্টিনন্দ আর ইম্প্রেসিভ আর আমাদের ভূমিকা ছিল দর্শকের মত।যাক প্রসঙ্গে ফিরে আসি, মালপত্র টোকিও’র দিকে যাত্রা করার পর আমরাও বের হলাম।এক্সপ্রেস ট্রেনে সাইকি থেকে ওইতা শহর আর উষ্ণ-প্রসবণের শহর বেপ্পু’র ভেতর দিয়ে পাহাড় আর সমুদ্র দেখতে দেখতে উত্তর কিউশুর ফুকুওকা প্রিফেকচারের জংশন স্টেশন ককুরাতে। সেখান থেকে টোকিওতে যাবার বুলেট ট্রেনটি ছিল ৩০০ কিমি গতির ট্রেন নোজোমি যার অর্থ হোপ বা আশা। বাচ্চা দুটোর যথারীতি পছন্দ জানালার পাশের আসন। টোকিও পর্যন্ত যাত্রাটি ছিল প্রায় ৫ ঘণ্টার। বুলেট ট্রেনের সিট বিশেষ করে নোজোমির মত খান্দানি বুলেট ট্রেনের সিটগুলো বিমানের মতই। কিছুক্ষণ পরপর জাপানি কায়দায় খাবারের ফেরীওয়ালাদের আনাগোনা বাচ্চাদের কাছে পছন্দের প্যাকেট লাঞ্চের বায়না ধরার যৌক্তিক একটা অজুহাত বটে। এটি ছাড়া ওদের কাছে ট্রেন জার্নি অনেকটাই পানসে। ট্রেন যখন টানেলে ঢুকে বা বের হয় বাতাসের চাপে যে শব্দটি হয়, দ্রুত গতিতে অথচ মসৃণতায় চলতে থাকা ট্রেনটির অপেক্ষাকৃত নীরব পরিবশে এটি কিচ্ছুক্ষন পরপর অনেকটা ছন্দপতনের মত।বুলেট ট্রেনে নিরাপদ ভ্রমণ ব্যবস্থার সাথে সাথে যাত্রার মসৃণতার অনেক গল্প শুনা যায়। তারমধ্যে অন্যতমটি হচ্ছে চলন্ত ট্রেনে জানালার পাশে সিগারেট দাঁড় করিয়ে রাখলে এটি পড়ে যায়না। ভাবলাম এই মিথটা নিজেই পরখ করে দেখা যাক। সিগারেট দাঁড় করালাম জানালার পাশে। যতক্ষণ পর্যন্ত ট্রেনটি বাঁক না নিচ্ছে, সিগারেটটি দাঁড়িয়ে থাকছে। বাঁকে কিংবা টানেলে প্রবেশ করার সময় চাপজনিত ঝাঁকুনিতে অবশ্য সিগারেট পড়ে যায়।ফুকুওকা থেকে টোকিও পর্যন্ত এই বুলেট ট্রেন যাত্রাটি স্বপরিবারে দীর্ঘতম হলেও প্রথম নয়।স্বপরিবারে প্রথম যাত্রাটি ছিল নাগানো বুলেট ট্রেন লাইনে নাগানো শহর থেকে উয়েদা শহরের ৩০ মিনিটের যাত্রাটি। ১৯৯৮ সালের নাগানোতে শীতকালীন অলিম্পিক হয়। শীতকালীন অলিম্পিকের উছিলায় নাগানোতে যে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলে বুলেট ট্রেন সংযোজন ছিল তারই অংশ। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য বুলেট ট্রেন চড়ার প্রথম সুযোগ হয় ১৯৯১ সালে জাপানে আসার পর পরই। উচ্চশিক্ষায় জন্যে জাপানের ওসাকার ইতামি বিমানবন্দরে প্রথম নামা। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার আগ পর্যন্ত কিয়োতোতে বোনের বাসার ২-৪ দিন থেকে কিয়োতো থেকে ৪০০ কিমি দূরের নাগানো প্রিফেকচারে শিনশু বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর শিক্ষা জীবন শুরুর প্রাক্কালে নাগানো যাবার জন্যে যে বুলেট ট্রেনটি চড়ে কিয়োতো থেকে নাগোয়া এসেছিলাম তার নাম ছিল হিকারি বা আলো। ঘণ্টায় ২৭০ কিমি গতিতে ছুটে চলা এই ট্রেনটি আমার প্রথম বুলেট ট্রেন অভিজ্ঞতা। পরবর্তীতে অসংখ্যবার বুলেট ট্রেনে চড়তে হয়েছে। জাপানের উত্তর থেকে দক্ষিন মোটামুটি বেশ কয়েকটি লাইনের বুলেট ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে অত্যাধুনিক বুলেট ট্রেন নোজমিতে বার বার চড়তে হয়েছে। ঘণ্টায় ৩২০ কিমি গতির আরেকটি বুলেট ট্রেন হায়াবুসা টোকিও থেকে উত্তর জাপানের আওমরি রুটে চলাচল করে। হায়াবুসা শব্দের অর্থ ফেল্কন পাখী।
বিগত কয়েক বছর বিজনেসের কাজে কানাডার মন্ট্রিয়ল থেকে জাপানে এলে বেশ কয়েকবার হায়াবুসাতে চড়ে আওমরিতে আসতে হয়েছে। লেট ট্রেনে স্ট্যান্ডার্ড ক্লাস ছাড়াও প্রথম শ্রেণী থাকে যাকে বলে গ্রীনশা বা সবুজ বগি। পেশাগত কাজে এই গ্রীনশা বা প্রথম শ্রেণীর কামরায় উঠবার সুযোগ হয়েছে। নশাতে সিটের বিন্যাস বিমানের বিজনেস ক্লাসের মত। জাপানিদের নয়টার গাড়ী কয়টায় বাক্যটির সাথে পরিচয় থাকার সুযোগ নেই। তারপরেও মানবিক সক্ষমতায় আর যান্ত্রিক সভ্যতায় কিছু সীমাবদ্ধতা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। বুলেট ট্রেনও এর ব্যতিক্রম নয়, ফলে এদেরও বিলম্ব হতে পারে। পাঠকদের কৌতূহল জাগতে পারে বিলম্বের পরিমাণ কত। প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতা,দায়িত্বশীলতা আর পেশাদারিত্বে বিশ্বময় খ্যাতির মাঝে এই বিলম্বের গড়পড়তা সময় হচ্ছে মাত্র ৩৭ সেকেন্ড।
সাগরের তীর ঘেঁষে কিংবা পাহাড়ের উপত্যকায়, বা ফুরুৎ করে টানেল থেকে বের হয়ে আসা বা হঠাৎ করে টানেলে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া অথবা ব্যস্ত কসমোপলিটান শহরের বুক চিড়ে সাপের মত চোখের নিমিষে এঁকেবেঁকে উধাও হয়ে যাওয়া বুলেট ট্রেনটি বাইরে থেকে দেখা আর ভেতরে বসে থেকে গতির সাথে প্রকৃতির নান্দনিকতাকে উপভোগ করা দুটো ভিন্ন বিষয়। সত্তুর শতাংশ পাহাড়ি ভূমির দেশ জাপান।
যোগাযোগের যে কোন স্থাপনায় দরকার হয় পাহাড় ফুঁড়ে বেরোবার জন্যে অসংখ্য টানেল। পাহাড় থাকলে নদীও থাকবে অনেক, আর তাই অসংখ্য সেতু নির্মাণ ছাড়া সড়ক আর রেল যোগাযোগ তো সম্ভব নয়।অর্থ আছে, প্রযুক্তি আছে, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা আছে তাই সমুদ্রের নীচ দিয়ে টানেল বানানো কিংবা উপর দিয়ে দীর্ঘ সেতু তৈরি কোন ব্যাপারই নয় জাপানিদের কাছে।আর তাই সমুদ্র, পাহাড় আর নদীর দেশ জাপানে রেল বা সড়ক যাত্রীদের প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে উচ্চমার্গের প্রযুক্তির কোলে বসে প্রকৃতির উজাড় করা সৌন্দর্যের অবগাহনে ভ্রমণের সময়টাকে একান্ত আপন করে আগলে রেখে উপভোগ করা।টোকিও থেকে ঘণ্টা খানেকের দূরত্বে শিজোওকা কেনটির বুক চিড়ে ছুটে চলা বুলেট ট্রেনের একপাশে প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তাল তরঙ্গ, অন্যপাশে চারিপাশ থেকে সমানভাবে উচু হয়ে আসা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি মাউন্ট ফুজির নয়নাভিরাম দৃশ্য। গ্রীস্মকালের ২-৩ মাস বাদে বাকী সময়টায় তুষারের টুপি পরে থাকা ফুজি পর্বতের দৃশ্যটি মেঘমুক্ত কোন এক দিবসে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা বুলেট ট্রেনের ভেতর থেকে উপভোগের ইচ্ছেটি যে কোন পর্যটকের প্রযুক্তি আর প্রকৃতির একই সত্ত্বায় মিশে যাওয়া এক সভ্যতাকে আলিঙ্গন করার দায়বদ্ধতা বটে। মাউন্ট ফুজির পাশ দিয়ে ছুটে চলা বুলেট ট্রেনের দৃশটি বিশ্বে জাপানের পরিচয়ের এক শৈল্পিক অভিব্যাক্তি।
জাপানের বাইরে বুলেট ট্রেন হিসেবে পরিচিত হলেও জাপানে এর পরিচয় কিন্তু শিনকানসেন নামে। নকানসেন জাপানি যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ব এবং আকর্ষণ। জাপানের শক্তিশালী অর্থনীতির সাথে পাল্লা দিয়ে দ্রুত বর্ধনশীল যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম উদ্ভাবন এই বুলেট ট্রেন। দ্রুত গতির জন্যে বুলেট নামটি এখন শিনকানসেনের সমার্থক শব্দ হলেও বুলেট ট্রেনের আভিধানিক জাপানি শব্দ হচ্ছে ডেনগেন রেসসা। ট্রেনের জাপানি হচ্ছে ডেনশা। প্রায় ষাট বছরের দীর্ঘ ইতিহাসে, এক হাজার কোটি যাত্রী বহন করার ভীষণ গর্বের জায়গাটিতে রয়েছে গর্বিত হবার অতি সুখকর আরেকটি অনুভূতি “নিরাপত্তায় নিরাপদ”। যাত্রী সেবার পাশাপাশি নিরাপদ চলাচলের অনন্য রেকর্ড শিনকানসেনের।বুলেট ট্রেন দুর্ঘটনাজনিত কারণে আজ পর্যন্ত জাপানে কোন যাত্রী আহত বা নিহত হবার উদাহরণ নেই। জাপানিদের ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার প্রবণতার কারণে, নিরাপত্তার এই দিকটিও কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় রাখতে হয় এবং সে অনুসারে সাধ্যমত প্রতিরোধ ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়েছে।রেল স্টেশনের রেলট্র্যাকগুলো স্বয়ংক্রিয় দরজা দিয়ে বন্ধ থাকে, ট্রেন আসলেট্রেনের দরজার সমান্তরালে খুলবে আর বন্ধ হবে। আত্মহত্যার প্রবণতার আধিক্য সাধারণত সকালের দিকেই বেশী ঘটে। ভুমিকম্পন প্রবণ জাপানে ভূমিকম্পন হলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে ফলে ভূমিকম্পের ইমপ্যাক্ট থেকে চলন্ত ট্রেনকে রক্ষা করার প্রাযুক্তিক কৌশল সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সুরক্ষা দিয়ে আসছে। ভূমিকম্প হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন থেমে যায় এবং লাইন, ব্রিজ, টানেলের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবার পর আবার চালু হয়।
১৯৬৪ সালে টোকিও অলিম্পিককে সামনে রেখে জাপানের তিনটি ব্যস্ততম শহর টোকিও, নাগোয়া আর ওসাকার মধ্যকার ৫০০ কিমি দীর্ঘ তোকাইডো শিনকানসেন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় বুলেট ট্রেনের। বিভিন্ন লাইনে আজ প্রায় ৩০০০ কিমি এর নেটওয়ার্ক। টোকিও ওসাকা রুটে আজ পর্যন্ত সাড়ে ৫০০ কোটি যাত্রী বহন করা হয়েছে। জাপানের উপচে পড়া অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ফল হচ্ছে বুলেট ট্রেন ব্যবস্থা আবার এই ব্যবস্থা থেকে উঠে আসা ব্যাপক রিটার্ন আরও সমৃদ্ধ করছে জাপানের অর্থনীতি আর সমাজকে। যে সমাজের মূল মেজাজটাই হচ্ছে ব্যস্ততা এবং ব্যস্ততা নির্ভর অর্থনীতি, সেখানে সময়ের মূল্যের রিটার্ন একটি অতি উচ্চ ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর।বুলেট ট্রেন ব্যবস্থা জাপানে প্রতি বছর বাঁচাচ্ছে ৪০০ মিলিয়ন শ্রম ঘণ্টা যার মূল্য বা অর্থনৈতিক ইমপ্যাক্ট প্রতিবছর ৫০০ বিলিয়ন ইয়েন।সংখ্যাটি বাড়াবাড়ি মনে হলেও এটাই বাস্তবতা। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগের মূল্য আমেরিকানরা শিখেছে যুদ্ধবাজ জার্মানদের কাছ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং সেই শিক্ষা প্রয়োগ করেছে নিজের দেশে, তেমনি শিখিয়েছে সহানুভূতির সাথে আনবিক বোমায় পরাজিত করা জাপানিদেরকে। টেক্কা মারা জাপানিদের সহজাত প্রবৃত্তি;
যুক্তরাষ্ট্র যেখানে রেল যোগাযোগে দুর্বল, জাপান সেখানে প্রবল। বহু বিশ্বখ্যাত গাড়ী নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের দেশ জাপান কিন্তু বুলেট ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থায় জিম্মি হয়নি গাড়ী নির্মাতাদের সিন্ডিকেটের কাছে।কথিত আছে যুক্তরাষ্ট্রে বুলেট ট্রেনের প্রোজেক্ট দাঁড়াতে পারেনি গাড়ী নির্মাতা সিন্ডিকেটের কারণে।
জাপানের বুলেট ট্রেন নেটওয়ার্ক এখন অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সর্বোচ্চ ৩২০ কিমি গতির বুলেট ট্রেন নেটওয়ার্কের আওতায় এখন জাপানের অধিকাংশ প্রিফেকচার, বড় বড় শহরগুলো। বুলেট ট্রেনের নয়টি নেটওয়ার্ক এখন ওকিনাওয়া ছাড়া জাপানের মূল চারটি আইল্যান্ডের প্রায় চল্লিশটির বেশী প্রিফেকচারের সাথে সংযুক্ত। টোকিও থেকে উত্তরে আকিতা প্রিফেকচারে যাচ্ছে আকিতা শিনকানসেন। আকিতা শিনকানসেন নেটওয়ার্কে চলাচল করার ট্রেনগুলোর নাম কোমাচি। হোক্কাইডো শিনকানসেন যাচ্ছে হনশু দ্বীপের সবচেয়ে উত্তরের প্রিফেকচার আওমরি পর্যন্ত এবং তারপর হোক্কাইডো আর হনশু দ্বীপের মধ্যকার সমুদ্রের নীচের সেইকান টানেল দিয়ে হোক্কাইডোর শহর হাকোদাতে পর্যন্ত। ২০৩০ সাল নাগাদ এই লাইনটি সম্প্রসারিত হয়ে হোক্কাইডোর রাজধানী সাপ্পোরো পর্যন্ত যাবে। ৩২০ কিমি গতিতে ছুটে চলা এই লাইনের অত্যন্ত জনপ্রিয় ট্রেনের নামটি হচ্ছে হায়াবুসা। হায়াতে নামের আরেকটি ট্রেনও এই লাইনে চলে। জয়েৎস্যু শিনকানসেনের শুরু ১৯৮২ সালে এবং চলাচল করছে টোকিও আর উষ্ণ প্রসবন, অবসরযাপন কেন্দ্র আর বিখ্যাত কশিহিকারি চাল উৎপাদন খ্যাত জাপানের নিগাতা প্রিফেকচারের মধ্যে।তকি আর তানিগাওয়া নামের ট্রেনগুলো এই লাইনে চলাচল করে। কিউশু শিনকানসেন চলছে কিউশু দ্বীপের উত্তরের প্রিফেকচার ফুকুওকা থেকে দক্ষিণের প্রিফেকচার কাগোসীমা পর্যন্ত।
তিন ধরণের ট্রেন এই লাইনে চলে স্যুবামে, সাকুরা আর মুযিহো।কিউশু শিনকানসেন নেটওয়ার্কের মধ্যে স্যুবামে সবচেয়ে ধীরগতির ট্রেন।হকুরিকু শিনকানসেন চলছে টোকিও থেকে নাগানো, তয়োমা আর কানাজাওয়া প্রিফেকচার পর্যন্ত।এই লাইনে চলছে কাগাইয়াকি, আসামা, হাকুতাকা আর স্যুরুগি নামের ট্রেনগুলো।কাগাইয়াকি ট্রেনটি হচ্ছে এই লাইনের সবচেয়ে দ্রুতগতির, যাচ্ছে দূরবর্তী কানাযাওয়া পর্যন্ত। আসামা যাচ্ছে টোকিও থেকে জাপানের পর্বতময় প্রিফেকচার নাগানো পর্যন্ত।আসামা নামটি এসেছে নাগানোর বিখ্যাত রিসোর্ট শহর কারুইযাওয়া সংলগ্ন জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আসামা আগ্নেয়গিরির নামানুসারে।আসামা আগ্নেয়গিরি দেখা হয়েছে অনেকবার। ভবিষ্যতে আসামাকে নিয়ে লিখার ইচ্ছে রইল। হাকুতাকা কিছুটা ধীর গতির এবং কানাযাওয়া পর্যন্ত চলাচল করে। স্যুরুগি সিরিজের ট্রেনগুলো চলছে কানাযাওয়া আর তয়োমা এর মধ্যে। এই নীল বুলেট ট্রেনের নামটি নেওয়া হয়েছে মাউন্ট স্যুরুগি নামানুসারে।
সানিও শিনকানসেন চলছে জাপানের অন্যতম মেগাশহর ওসাকা আর কিউশু দ্বীপের প্রধান শহর ফুকুওকা পর্যন্ত। এটি জাপানের দ্বিতীয় বুলেট ট্রেন লাইন এবং চালু হয়েছে ১৯৭৫ সালে। পাঁচ ধরণের ট্রেন এই লাইনে চলছে। নোজমি অর্থাৎ আশা বা হোপ, হিকারি বা আলো, কোদামা, মিযুহো আর সাকুরা।দ্রুত গতির নোজমি চলে ঘণ্টায় ৩০০ কিমি গতিতে।গতির দিক দিয়ে নোজমি’র পরে হিকারি। কোদামা অনেকটা লোকাল ট্রেনের মত, অনেক স্টেশনে থামে। সাকুরা অবশ্য দ্রুতগতির ট্রেন, ঘণ্টায় ৩০০ কিমি গতির।
তোহোকু শিনকানসেন চলে আওমরি প্রিফেকচার পর্যন্ত তবে তোহোকু অঞ্চলের মিয়াগি প্রিফেকচারে প্রধান শহর সেন্দাই হচ্ছে মূল গন্তব্য। হায়াবুসা, ইয়ামাবিকো, হায়াতে ইত্যাদি হচ্ছে এই নেটওয়ার্কের প্রধান ট্রেন সিরিজ।ইয়ামাগাতা শিনকানসেন তোহোকু শিনকানসেনের অংশ। স্যুবাসা নামের ট্রেনগুলো ইয়ামাগাতা লাইনে টোকিও আর শিনজো’র মধ্যে চলাচল করে।
তোকাইডো শিনকানসেন নেটওয়ার্ক জাপানের সবচেয়ে পুরাতন, ব্যস্ততম আর জনপ্রিয় বুলেট ট্রেন লাইন।জাপানের বড় বড় শহরগুলো যেমন টোকিও, ইয়োকোহামা, নাগোয়া, কিয়োতো, ওসাকা এই লাইনের মাধ্যমে সংযুক্ত।এই লাইনের সম্প্রসারিত অংশ সানিও নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কিউশু দ্বীপের প্রধান শহর ফুকুওকা পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্যতম দ্রুতগতির ট্রেন নোজোমি টোকিও থেকে ফুকুওকা পর্যন্ত চলাচল করে। এই লাইনে ৩ শ্রেণীর ট্রেন চলাচল করে; নোজমি, হিকারি, আর কোদামা। নোজমি আর হিকারি চলে কমবেশি ৩০০ কিমি গতিতে আর কোদামা চলে ২৮৫ কিমি গতিতে।কোদামাতে ভাল গতি থাকলেও অনেক স্টেশনে থামে বলে সময় লাগে বেশী।
দ্বিতীয় বারের আনবিক আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছিল নাগাসাকি।চীন সাগরের তীরের এই বন্দর নগরীর অবস্থান এক পাশে হবার কারণে দীর্ঘ দিন থাকতে হয়েছে বুলেট ট্রেনের মূল ট্র্যাকের বাইরে। নাগাসাকি পর্যন্ত শিনকানসেন লাইন সম্প্রসারণের কাজ চলছে এবং ২০২৫ সাল নাগাদ চালু হবে।
বুলেট ট্রেনের যুগের রমরমা ব্যবসা ছড়িয়ে গেছে তাইওয়ান আর চীন পর্যন্ত।জাপানের বুলেট ট্রেন প্রযুক্তি রফতানি হয়েছে সেখানে। ইউরোপিয়ানরা আগেই থেকেই রেল যোগাযোগে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ, এখনো এগিয়ে চলছে সমানতালে। তবে নিরাপত্তা আর যাত্রী সেবায় অনেক এগিয়ে জাপান। প্রযুক্তির টিকে থাকা আর এগিয়ে চলা উভয়টিই নিহিত রয়েছে উন্নত থেকে উন্নততর সংস্করণে রূপান্তরের মাঝে। বুলেট ট্রেনের যুগের রমরমা ব্যবসা আর প্রতিযোগিতার মাঝে শুরু হতে যাচ্ছে নতুন প্রযুক্তির যুগ, গতি আর নিরাপদ যাত্রাকে আরও সংহত করতে।প্রায় দ্বিগুণ গতির প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে জাপানিরা। এক দশকের মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে ম্যাগ্লেভ যুগের। ৫০০ কিমি গতির চাইতে অধিক গতির ট্রেন। ২০১৫ সালে জাপানিরা পরীক্ষামূলকভাবে চালিয়েছে ঘণ্টায় ৬০০ কিমি গতিতে। টোকিও থেকে নাগোয়া পর্যন্ত চালু হবে ২০২৭ সাল নাগাদ আর ওসাকা পর্যন্ত ২০৪০ সালে। টোকিও থেকে কফু, ইইদা হয়ে নাগোয়া যেতে সময় লাগবে ৪০ মিনিট।ম্যাগ্লেভ হচ্ছে সুপার কন্ডাক্টিং চুম্বকীয় ট্রেন। ম্যাগ্লেভ অর্থাৎ ম্যাগনেটিক লেভিয়েসন প্রযুক্তিতে দুই সেট ম্যাগনেট থাকে যাতে এক সেট ট্র্যাকের উপর ট্রেনটি উঠাতে আর আরেক সেট ভাসমান ট্রেনকে ধাবিত করতে সাহায্য করে। চাকা নয়, পুরো ট্রেনটি চলমান থাকে ম্যাগনেটিক শক্তিতে।বিশ্রামের সময় রাবারের চাকার উপর দাঁড়িয়ে থাকে এটি, ঘণ্টায় প্রায় ১৫০ কিমি স্পীড পর্যন্ত ট্রেনটি চাকার সাহায্য নেয় এবং এরচেয়ে বেশী গতি ট্রেনটিকে প্রায় চার ইঞ্চি বা ১০০ মিমি উপরে তুলে দেয় এবং একই শক্তি ট্রেনকে সামনে চলতে সাহায্য করে।ম্যাগ্লেভ প্রযুক্তির বড় সমস্যা অত্যাধিক ব্যয়, ফলে বুলেট ট্রেনের যুগের অবসানে সময় লাগবে কয়েক যুগ।