বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী, এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। এমনকি বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও এখন নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এসব ঋণগ্রাহকেরা।
এসব মন্তব্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। বাংলাদেশের আর্থিক খাত বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলেছে, এখানে খেলাপি আড়াল করে রাখা আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল, ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ বেপরোয়া। নিয়ম ভাঙলে শাস্তিও পান না তাঁরা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় এবং বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে।
আন্তর্জাতিক এই ঋণ সংস্থা ছয় মাস ধরে বাংলাদেশের আর্থিক খাত পর্যালোচনা করে সরকারকে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সরকারের আমন্ত্রণেই আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা পর্যালোচনা (এফএসএসআর) করতে দুই দফায় বাংলাদেশে এসেছিল। প্রথম আসে গত এপ্রিলে, এরপর গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে। পর্যালোচনা শেষে সংস্থাটি ৪৩টি সুপারিশ করেছে। ৬৮ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে দেশের ব্যাংক খাতের নানা অব্যবস্থা ও সংকটের খোলামেলা আলোচনা করা হয়েছে।
লুকানো খেলাপি ঋণ
খেলাপি ঋণ নিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের ভয়াবহ একটি চিত্রও তুলে এনেছে আইএমএফ। তারা বলেছে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, প্রকৃত খেলাপি ঋণ তার তুলনায় অনেক বেশি। প্রকাশিত খেলাপি ঋণের তথ্য দেখলে মনে হবে তা খুব বেশি নয়। কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি অনেক বেশি খারাপ।
যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০১৮ সাল শেষে খেলাপি ঋণের হার মাত্র ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু আইএমএফ মনে করে, এর সঙ্গে যুক্ত করা উচিত আরও কয়েকটি বিষয়। যেমন আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে মোট ঋণের ৪ দশমিক ১ শতাংশকে খেলাপি ঋণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, যা অবশ্যই করা উচিত। আবার বিশেষ নির্দেশিত হিসাব বা স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট—এই নামেও রাখা আছে মোট ঋণের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থ। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে অনাপত্তি সার্টিফিকেট (এনওসি) দিয়ে রেখেছে। এ ধরনের ঋণের হার মোট ঋণের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। আইএমএফ মনে করে, প্রকৃত চিত্র বুঝতে এই তিন ধরনের খেলাপি ঋণ অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
আইএমএফ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের তথ্য নিয়ে মন্তব্য করেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে গত জুন পর্যন্ত সময়ের খেলাপি ঋণের চিত্র পাওয়া যায়। সরকারি হিসাবে এ সময়ে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ৬৭৫ জন ঋণগ্রহীতা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছেন। ফলে ঋণখেলাপি হিসেবে তাঁদের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) উল্লেখ করা হয় না। এ রকম ঋণের পরিমাণ এখন ৭৯ হাজার ২৪২ কোটি টাকা।
দুই দফা বাংলাদেশে এসে আইএমএফের প্রতিনিধিদল ৬৮ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দিয়েছে
সেখানে সুপারিশ আছে ৪৩টি
লুকানো খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি
কমাতে হবে ব্যাংক পরিচালকের সংখ্যা
ভাঙতে হবে পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের বেপরোয়া আচরণের চক্র
বিভিন্ন সময়ে বিশেষ ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়। সরকারের নির্দেশে বারবার ঋণ পুনঃ তফসিল করার উদাহরণও আছে। ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের পুনর্গঠন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এ রকম বিশেষ নির্দেশিত হিসাবে থাকা ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে গত জুন পর্যন্ত আরও ২১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে দিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক।
এভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলে দেশে এখন খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। আইএমএফ এসব ঋণ অন্তর্ভুক্ত করেই খেলাপি ঋণের হিসাব করার পক্ষে।
এদিকে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বদল করা হয়। ২০১২ সাল থেকে অনুসরণ করা আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী, ৩ মাস ঋণ অনাদায়ি থাকলে তাকে নিম্নমান বলা হতো। নতুন নিয়মে তা ৬ মাস করা হয়েছে। ৬ মাসের অনাদায়ি ঋণকে বলা হতো সন্দেহজনক, এখন তা ৯ মাস করা হয়েছে। সবশেষে ৯ মাসের সময় ঋণ অনাদায়ি হলে তাকে বলা হতো মন্দ ঋণ, এখন তা ১২ মাস করা হয়েছে।
আইএমএফের সুপারিশ হচ্ছে, ঋণ ৯০ দিন অনাদায়ি হলেই তাকে শ্রেণিবিন্যাস করে খেলাপি ঋণ করতে হবে। এটাই আন্তর্জাতিক রীতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফ যা বলছে, ঠিক সে কথাগুলোই দেশের অর্থনীতিবিদেরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন। এসব কথা যে সত্যি, তা-ই প্রমাণিত হলো। এখন প্রয়োজন প্রতিকার। এটা ঠিক যে খেলাপি ঋণ বিভিন্নভাবে লুকিয়ে রাখা হয়। এসব দেখেও না দেখার ভান করা হয়। দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণ অনেক বেশি।
প্রভাবশালীরাই সিদ্ধান্তদাতা
আইএমএফ তাদের প্রতিবেদনে প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের ক্ষমতার একটি উদাহরণ উল্লেখ করেছে। যেমন গত আগস্টেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ১১ বৃহৎ ঋণগ্রহীতার ১৫ হাজার ১৮০ কোটি টাকার ঋণ নবায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। চার বছর আগে, ২০১৫ সালে এই ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, এই বিশেষ সুবিধা নিয়ে কেউ খেলাপি হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারপরও এসব ঋণের বড় অংশ আবার খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে এবার তারা কঠোর হবে, ঋণ পুনর্গঠনের পরও যাঁরা আবার খেলাপি হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দেউলিয়া আইন-১৯৯৭ প্রয়োগ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে বলা হবে, যাতে প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারা বুঝতে পারেন, বারবার খেলাপি হলে আর পার পাওয়া যাবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে নবায়নের সুযোগ দিয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারাই এখানে আর্থিক খাতের সিদ্ধান্ত নেন। আইএমএফের মন্তব্য হচ্ছে, ঋণখেলাপিদের প্রতি এ ধরনের সহৃদয়তা দেশের সামগ্রিক ঋণ শৃঙ্খলাকেই বিনষ্ট করে।
আইএমএফ আরও বলেছে, এ দেশে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ ফেরত না দেওয়ার প্রবণতা কাজ করে। প্রভাবশালী ও ধনী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ওপর মহলের যোগাযোগ ভালো এবং তাঁরা ঋণ ফেরত দেওয়ার তাগিদই অনুভব করেন না। কারণ, তাঁরা জানেন, তাঁদের কিছু হবে না। যদিও ক্ষুদ্র ও দরিদ্রদের মধ্যে ঋণ ফেরত দেওয়ার হার অনেক বেশি। সংস্থাটি বলেছে, এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে অপরাধী ঋণগ্রহীতারা অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য হন। যদিও বাংলাদেশে এর উল্টোটা দেখা যাচ্ছে, তাঁরা ঋণ ফেরত না দিতে বরং উৎসাহ পাচ্ছেন।
সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা দৃশ্যমান, কে আর্থিক খাতের সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে। এটা সবাই জানে। এ জন্য সব সুবিধা যাচ্ছে খারাপ গ্রাহকদের পক্ষে। এতে ভালো ও ছোট গ্রাহকেরা উৎসাহ হারাচ্ছেন। তাঁদের জন্য কোনো প্রণোদনাও নেই। আমি বলব, আর্থিক খাতে এখন “বিকৃত প্রণোদনা” দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণেই আর্থিক খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ থেকে বের হতে হবে।’
ক্ষমতা প্রয়োগ করে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক
আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশে আর্থিক খাতের বড় দুর্বলতা হচ্ছে, বিদ্যমান নিয়মকানুন অনুসরণ করা হয় না। আর যখন ব্যাংক এসব মানে না, তখন তা নজরদারিও ঠিকঠাক করা হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে না। আবার ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকেরা এমন অনেক কাজ করেন, তাতে তাঁদের পদ থাকারই কথা নয়। অথচ ক্ষমতার অপব্যবহার বা দায়িত্বে অবহেলার জন্য অবশ্যই পরিচালক পদ থেকে নিষিদ্ধ করা উচিত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে বাকিদের কাছে সেটিই হতো একটি জোরালো সংকেত। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এখানে ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের বেপরোয়া আচরণের চক্র অবশ্যই ভাঙতে হবে।
আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশ ব্যাংকের যতখানি স্বাধীনতা থাকা উচিত, তা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়াতে আইএমএফ ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৫৮ ধারা সংশোধনের সুপারিশ করেছে। এ ধারায় নির্দেশনা পালনে একাধিকবার ব্যর্থ বা আমানতকারীদের ক্ষতি করছে, এমন ব্যাংককে সরকার অধিগ্রহণ, সাময়িকভাবে বন্ধ ও অবসায়ন করতে পারে। আইএমএফ এসব ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়ার পক্ষে।
আইএমএফ ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারারও সংশোধন চেয়েছে। এ ধারায় বাংলাদেশ ব্যাংক সরকার কর্তৃক মনোনীত বা নিযুক্ত কোনো চেয়ারম্যান বা পরিচালককে অপসারণ করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল এ নিয়ে সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠাতে পারে। প্রসঙ্গত, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সময় পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার জন্য ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক এই ধারা অনুযায়ী সরকারের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি।
এ অবস্থায় আইএমএফ বলেছে, সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সরকারি ব্যাংকগুলোকে পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির আওতায় আনা হবে। সুতরাং তারা সরকারি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে।
আর নতুন ব্যাংক নয়
আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশে আর নতুন ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না। নতুন যেসব ব্যাংক এসেছে, তারা কেউ কার্যকর প্রতিযোগিতা গড়ে তুলতে পারেনি। তারা নতুন তহবিলও আকৃষ্ট করতে পারছে না। বরং উচ্চ ঝুঁকির বিনিয়োগ করছে। এমনিতে অন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি, কিন্তু পরিচালনার দক্ষতায় অনেক পিছিয়ে। ব্যাংক খাতের জন্য দক্ষ ও ভালো বিনিয়োগকারী যদি থেকেই থাকে, তবে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা না করে তারা বিদ্যমান ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করতে পারে।
উল্লেখ্য, দেশে এখন ব্যাংকের সংখ্যা ৫৯। এর বাইরে আরও তিনটি কার্যক্রম শুরুর প্রক্রিয়ায় আছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার ১৪টি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। এর অনেকগুলোই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। এর আগে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আরও ১৩টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এর বাইরে এরশাদের আমলে ৯টি এবং বিএনপির আমলে (১৯৯১-৯৬) আরও ৮টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। আর বিএনপির পরের মেয়াদে চাপ থাকলেও নতুন ব্যাংক দেওয়া হয়নি।
পরিচালকের সংখ্যা কমাতে হবে
বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা যেমন বেশি, পরিচালকের সংখ্যাও বেশি। বর্তমানে প্রতিটি ব্যাংকে পরিচালকের সংখ্যা ২০। আইএমএফ মনে করে, ব্যাংকের সুশাসনের জন্য এই সংখ্যা অনেক বেশি। আইএমএফ স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যাও তিনজন থেকে বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি নিরীক্ষা কমিটি ও ঝুঁকি নিরূপণ কমিটি যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়াও তারা আগামী ৫ বছরের মধ্যে ব্যাংকের ন্যূনতম মূলধন ৪০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০০ কোটি টাকা করতে বলেছে।
ঝুঁকির মধ্যে ব্যাংক খাত
আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশ সন্ত্রাসী অর্থায়নসহ টাকার সব ধরনের অবৈধ ব্যবহার বা মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে। এসব কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে বাংলাদেশের অগ্রগতি খুবই কম। বিশেষ করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারি ব্যাংকগুলো পিছিয়ে আছে। ফলে বাংলাদেশের পুরো আর্থিক খাত সুনামহানির ঝুঁকির মধ্যে আছে। সুনামজনিত সংকট দেখা দিলে বিদেশের অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন এবং নিউইয়র্কের বাজারে ঢুকতে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অসুবিধা হতে পারে। বিশেষ করে গত ১ সেপ্টেম্বর চীন বাংলাদেশের ৫টি ব্যাংককে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এটা হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি সতর্ক বার্তা, যাতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে, নইলে বিপদে পড়বে বাংলাদেশ।
সবশেষে আইএমএফ জ্বালানি খাতে অনেক বেশি পরিমাণে ঋণ দেওয়া হচ্ছে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি তাদের সুপারিশ হচ্ছে, কোনো একক ঋণগ্রহীতা বা গ্রুপকে মোট মূলধনের ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার যে সীমারেখা, তা কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা প্রয়োজন। কেননা, এই ব্যবস্থায় মাত্র তিনজন বড় ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে পুরো ব্যাংকই দেউলিয়া হয়ে যাবে।
সামগ্রিক বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফ যা বলছে, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে দিন দিন শুধু খারাপই হচ্ছে। প্রভাবশালীরা ব্যাংকিং খাতকে তাঁদের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করছেন। নীতিনির্ধারণী পরিবর্তনও আনছেন। বাজার ব্যবস্থার পরিপন্থী অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুদহারে ৬ ও ৯ শতাংশ, ২ শতাংশ জমা দিয়ে ঋণ পুনঃ তফসিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতের জন্য আসলে সহায়ক কোনো ভূমিকাই নেওয়া হয়নি।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, আইন পরিবর্তন করে ব্যাংকগুলোকে একক পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আবার একটি পরিবার বেশ কয়টি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির নামে বড় অঙ্কের ঋণ কয়েকজন গ্রাহকের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে।