লিখেছেন রূপাঞ্জন গোস্বামী
১৮৪৮ সালের ২৪ জানুয়ারি, জেমস মার্শাল ক্যালিফোর্নিয়ার কলমা এলাকায় সোনা খুঁজে পেয়েছিলেন।সারা বিশ্বে দাবানলের মত খবরটি ছড়িয়ে পড়েছিল। সোনার গন্ধ পেয়ে দেশবিদেশ থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় হাজির হয়েছিলেন প্রায় ৩ লাখ ভাগ্যান্বেষী। শ্রমিক হয়ে নেমে পড়েছিলেন সোনার খনিতে সোনা খুঁজতে। জলে কাদায় দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পরিশ্রমের ফলে উঠে আসতো এক চিলতে সোনা।
অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল এই কাজ। শ্রমিকেরা সাধারণ পোষাক পরে খনিতে নামতেন কিন্তু রোজ তাঁদের জামা প্যান্ট ছিঁড়ে যেত। সেগুলি তাঁরা নিয়ে যেতেন লাটভিয়া থেকে আমেরিকায় আসা দর্জি জ্যাকব ডেভিসের কাছে। তিনি হিমশিম খেয়ে যেতেন জামা প্যান্টে তালি মারতে মারতে। তাঁর মাথায় ঘুরছিল একটি ভাবনা। কী করে খনি শ্রমিকদের হাতে শক্তপোক্ত কাপড়ের প্যান্ট তুলে দেওয়া যায়, যেগুলি সহজে ছিঁড়বে না এবং যা পরে শ্রমিকরা কষ্টসাধ্য কাজগুলি করতে পারবেন।
১৮৫১ সালে জার্মানি থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন লিভাই স্ট্রস নামের আরেক জার্মান ব্যাক্তি। তিনি বিভিন্ন জিনিসপত্রের অর্ডার সাপ্লায়ার ছিলেন। ১৮৫৩ সালে তিনি সানফ্রান্সিসকোতে চলে যান, ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য। জার্মানিতে রঙ এবং কাপড়ের পারিবারিক ব্যবসা ছিল। সেই ব্যবসারই শাখা সানফ্রান্সিসকোতে খুলেছিলেন লিভাই স্ট্রস।
তাঁর দোকানেই কাপড় কিনতে আসতেন জার্মান দর্জি জ্যাকব ডেভিস। তিনি একদিন লিভাই স্ট্রসকে বললেন, খনি শ্রমিকদের জামাকাপড় তৈরির জন্য একটা টেকসই কাপড়ের ব্যাবস্থা করে দিতে পারেন কিনা। দুজনে মিলে দোকানের গোডাউনে কাপড় খুঁজতে শুরু করেছিলেন।
স্ট্রসের দোকানে এক ধরণের কাপড় ছিল। বেশ মোটা ও নীল রঙের। কিন্তু তা পোষাক তৈরির কাপড় নয়। ১৭ শতাব্দী থেকে মালবাহী জাহাজের ডেকের ও ডকের জিনিসপত্র ঢাকতে ও তাঁবু তৈরির কাজে এই কাপড় ব্যবহার করা হত। কাপড়টার উপাদানকে বলা হত ডেনিম।
ফ্রান্সের Nîmes শহরে এই সুতো তৈরি হত বলে “de Nîmes” থেকে denim শব্দটা এসেছে। ফ্রান্সের তাঁতিদের তৈরি করা এই ডেনিমের সুতো দিয়ে ইতালির জেনোয়া শহরের তাঁতি একধরনের শক্তপোক্ত কাপড় বানিয়েছিলেন। তার নাম ছিল জিন ফুস্তিয়ান। যেহেতু জেনোয়া শহরে তৈরি তাই এই নাম। পরে জিন ফুস্তিয়ানের নামটি থেকে ফুস্তিয়ান শব্দটি ছেঁটে ফেলে নাম দেওয়া হয় জিনস।
জার্মান দর্জি ডেভিস খুঁজে খুঁজে এই জিনসের কাপড়ই বার করেছিলেন গোডাউন থেকে। অবাক হয়েছিলেন লিভাই স্ট্রস। কিন্তু নাছোড়বান্দা ছিলেন ডেভিস। সেই মোটা কাপড় দিয়েই বানিয়ে ফেলেছিলে শ্রমিকদের প্যান্ট। শক্ত কাপড়, মোটা সুতোর সেলাই আর পকেটের কোনে কোনে রিভেট মারা প্যান্ট খনি শ্রমিকদের খুব পছন্দ হয়েছিল। প্যান্টগুলি ছিল অত্যন্ত টেকসই এবং প্যান্টের রঙ গাঢ় নীল হওয়ায় তা ময়লা হলেও ময়লা দেখতো না। বাকিটা ইতিহাস।
প্রথম দিকে জিনসের কাপড়ে তৈরি প্যান্ট পরতেন শ্রমিক ও কাউবয়রা। গরীব শ্রেণীর কিশোরদের মধ্যেও এর জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছিল। ডেভিসের তৈরি করা প্যান্টের সব পরিস্থিতি সহ্য করার ক্ষমতা দেখে আকর্ষিত হচ্ছিলেন সমাজের উঁচু শ্রেণীও। জিনসের বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে ডেভিস আর লিভাই স্ট্রস মিলিতভাবে একটি সংস্থা খুললেন যার নাম দিলেন ‘লিভাই স্ট্রস অ্যান্ড কোং’। ১৮৭৩ সালের ২০ মে এই বিশেষ ধরনের প্যান্ট তৈরির পেটেন্ট পেল ‘লিভাই স্ট্রস অ্যান্ড কোং’।
কিন্তু দুজনের সম্পর্কে তাল কাটলো কয়েক বছরের মধ্যেই। ১৮৮০ সালে নিজের আলাদা সংস্থা ‘লিভাইস’ খুললেন লিভাই স্ট্রস। ১৮৯০ সালের মধ্যে তাঁর সংস্থার তৈরি ‘জিনস’ সারা আমেরিকায় বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯২০ সালের মধ্যে আমেরিকা ছেয়ে ফেলেছিল লিভাইস কোম্পানির তৈরি করা ‘ডেনিম ওয়েস্ট’ জিন্স।
কিন্তু অর্থ না-থাকায় ডেভিস জিনসের পেটেন্ট পাননি। পেটেন্ট ছিল লিভাই স্ট্রসের নামে। তাই লিভাই স্ট্রসের তঞ্চকতার কারণে একদিন জিনসের জগৎ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন জ্যাকব ডেভিস । জিনসের প্যান্টের স্রষ্টা।