লিখেছেন চৈতালী চক্রবর্তী
স্বাধীনতা তখনও আসেনি। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে অজানা জ্বরে। ব্রিটিশ সৈন্যদের ক্যান্টনমেন্টেও কাঁপুনি। ম্যালেরিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে মহানিধনযজ্ঞে মেতেছে সেই অজানা জ্বর। মৃত্যুছায়া ঢেকেছে রায় পরিবারকেও। ১৯২৩ সাল। মৃত্যুশয্যায় শায়িত সুকুমার রায়। চোখে জলের ধারা, শোকে পাথর স্ত্রী সুপ্রভা দেবী। ৩৫ বছর বয়সে মৃত্যু এল। তার দু’বছর আগেই জন্ম হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের।
রোগের নাম কালাজ্বর। এই জ্বরের প্রতিষেধক দিশি ওষুধ ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কার হয়েছে এক বছর আগেই। কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কারক বঙ্গসন্তান উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ততদিনে সুপরিচিত। এই ওষুধ অসমে প্রাণ বাঁচাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। অথচ সুকুমার রায় কেন এই ওষুধ পেলেন না? তার জবাব আজও মেলেনি। শোনা গিয়েছিল, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কলকাতার ডাক্তারদের এই ওষুধ প্রয়োগের ছাড়পত্র দেয়নি।
কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজের (বর্তমানে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ) খুপরি অন্ধকার ঘরে বসে দিনরাত জেগে চিন্তার যে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন উপেন্দ্রনাথ তার যোগ্য স্বীকৃতি তিনি পাননি। সামান্য সরঞ্জাম, ছিল অর্থের অভাবও। তবুও সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে ১৯২২ সালেই কালাজ্বরের টিকা বের করে ফেলেছিলেন রায় বাহাদুর উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চে তার সফল প্রয়োগের কথাও লিখেছিলেন তিনি। প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল সেই যুগান্তকারী ওষুধ ইউরিয়া স্টিবামাইন। যদিও এই আবিষ্কারের জন্য ব্রিটিশ শাসকের তরফে ‘নাইটহুড’ উপাধি পেয়েছিলেন উপেন্দ্রনাথ, তবুও সর্বোচ্চ সম্মান নোবেল অধরাই থেকে গিয়েছিল তাঁর কাছে।
নীলমণি ডাক্তারের ছেলের অঙ্ক, রসায়ন, ভেষজবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান
বিহারের মুঙ্গের জেলার জামালপুরে নীলমণি ডাক্তারের তখন খুব নাম। বাঙালি ডাক্তার, স্বভাবেও নরম। ছেলে উপেন্দ্রনাথ যেন মেধা নিয়েই জন্মেছিলেন। ছোট থেকেই অঙ্ক, রসায়ন, জীববিদ্যায় তুখোড়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তার বিকাশ ঘটে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে। ১৮৯৩ সালে হুগলির মহসিন কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক। রসায়নেও আগ্রহ। ১৮৯৪-তে প্রেসিডেন্সি থেকে রসায়নে মাস্টার্স। তারপরেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এলএমএফ। সেটা ১৮৯৮। পরের বছরই ভেষজবিজ্ঞান ও শল্যচিকিৎসায় এমবি। গুডিভ ও ম্যাকলেয়ড পদক পেয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সিতেই আলাপ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে। আচার্যের অনুপ্রেরণায় নিজের জীবন সাজিয়েছিলেন। লোহিত রক্তকণিকা বিষয়ক গবেষণায় তাঁর তথ্য আজও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে মূল্যবান।
উপেন্দ্রনাথের প্রতিভা মুগ্ধ করেছিল ব্রিটিশ সার্জন ও ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের ডিরেক্টর জেনারেল স্যর জেরাল্ড বমফোর্ডকে। তাঁরই আহ্বানে ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলে কয়েক বছর অধ্যাপনা করেছিলেন উপেন্দ্রনাথ। দেশে ফিরে যোগ দেন ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে ১৯০৫ সালে। এখানেই ২০ বছরের অধ্যাপনা ও গবেষণাকালে আবিষ্কার করেন কালাজ্বরের এই যুগান্তকারী ওষুধ।
কলকাতায় তখন ‘রেতে মশা দিনে মাছি,’ ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্ট উজাড় হল অজানা জ্বরে
১৯০২ সাল। গোটা বিশ্বজুড়েই কালাজ্বরের প্রভাব দুর্দান্ত। ভারতেও থাবা বসিয়েছে অজানা জ্বর। গ্রামের পর পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক আবিষ্কার হলেও কালাজ্বরের নিরাময় তখনও অজানা। ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বরের ফারাকই করতে পারছেন না চিকিৎসকরা। অতএব গ্রামেগঞ্জে শয়ে শয়ে মৃত্যু। লোক মরছে ব্রাজিল, ইতালিতে। স্যর লিওনার্ড রজার্স কালাজ্বর নিয়ে তাঁর গবেষণা শুরু করেন। পটাসিয়াম থেকে তৈরি টারটার এমেরিক প্রয়োগ করা হয় ভারতবাসীর উপরে। স্বস্তি মেলে না। উল্টে শুরু হয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ইতালির ডাক্তাররা দাবি করেন অ্যান্টিমোনাইল পটাসিয়াম টার্টারেট প্রয়োগ করে সে দেশে ভালো ফল মিলেছে। কিন্তু উপেন্দ্রনাথ জানতেন ভারতে এই ওষুধ কার্যকরী হবে না। ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে তাঁর নিজের ছোট্ট ল্যাবরেটরিতেই গবেষণা শুরু করলেন উপেন্দ্রনাথ। শুরু হল এক ঐতিহাসিক যাত্রা।
কালাজ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কারে আগ্রহ দেখাননি রোনাল্ড রস
১৯০২ সাল। নোবেলজয়ী স্যর রোনাল্ড রসকে তখন বসানো হয়েছে কালাজ্বর কমিশনের মাথায়। কিন্তু প্রতিষেধক আবিষ্কারের তেমন ঝোঁক নেই চিকিৎসকের। বিভিন্ন এলাকায় রোগীদের পরীক্ষা করে তিনি জানান ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বর একই রোগ নয়। ম্যালেরিয়া জীবাণু বাহিত হয় মশার মাধ্যমে। কালাজ্বর তেমনটা নয়। কারণ কুইনাইনের ডোজে এই জ্বর সারেনি। তবে তিনি বলেছিলেন এই জ্বরের কারণ প্রোটোজোয়া বা পরজীবী। লিশম্যানিয়া গণের পরজীবী Leishmania donovani এই রোগ ঘটায়।
বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, আঁধার ঘরে বসেই আলোর পথ দেখালেন বঙ্গসন্তান
স্যর রোনাল্ড রস ব্যস্ত তাঁর ম্যালেরিয়ার গবেষণায়। কালাজ্বর কমিশন থেকেও সরে গিয়েছেন তিনি। কলকাতার বুকে বসেই তাঁর নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে তখন সরগরম বঙ্গসমাজ। এদিকে চোখ রাঙাচ্ছে কালাজ্বর। শহরের বুকে যেন মহামারীর মহাপার্বণ শুরু হয়ে গেছে। হাল ধরলেন উপেন্দ্রনাথ। তিনি দেখলেন ইতালির ডাক্তারদের ব্যবহৃত পটাসিয়ামের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রবল। কাজেই বিকল্প হিসেবে সোডিয়ামের ব্যবহার শুরু করলেন। সেই সময় সিফিলিস, আফ্রিকান স্লিপিং সিকনেসের প্রতিষেধক হিসেবে আর্সেনিক, অ্যান্টিমনি ব্যবহৃত হত। উপেন্দ্রনাথ সোডিয়াম অ্যান্টিমনি টার্টারেট নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। কিন্তু যে প্রতিষেধক তৈরি হল সেটা তেমন কার্যকরী নয়। অ্যান্টিমনি ধাতু নিয়ে নিজেই পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করলেন।
ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজের ছোট্ট ঘরে তখন বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। জলের পাম্প নেই। সরঞ্জামও নিতান্তই সামান্য। আর্থিক অনুদানও মেলেনি। তবে এইসব বাহ্যিক সমস্যাকে হেলায় উড়িয়ে দিয়েছিলেন উপেন্দ্রনাথ। তাঁর জেদ ও অধ্যবসায়ের কাছে হার মেনেছিল পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতা।
উপেন্দ্রনাথ বললেন, এই জ্বরের কারণ বেলেমাছি (Phlebotomus argntipes)। তার লালায় বাহিত পরজীবী মানুষের প্লীহা, যকৃত, অস্থিমজ্জাতে সংক্রমণ ঘটায়। রোগের লক্ষণ বারে বারে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, হুহু করে ওজন কমে যাওয়া, রক্তাল্পতা, অবসাদ, চামড়ায় কালচে ছোপ, প্লীহার আকার অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া। সঠিক চিকিৎসা না হলে মৃত্যু অবধারিত। উপেন্দ্রনাথ দেখলেন ধাতব অ্যান্টিমনি সহজেই প্লীহার মধ্যে বেড়ে চলা পরজীবীদের নষ্ট করে ফেলতে পারে। অবশ্য এরই সঙ্গে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হয়েছিল তাঁকে। আরও একটা অসুবিধা ছিল। অ্যান্টিমনি ধাতু সে সময় সহজলভ্য ছিল না। প্রতিবার নিজেকেই সে ধাতু বানিয়ে নিতে হত। উপেন্দ্রনাথের পরিশ্রম আর একাগ্রতা দেখে ১৯১৯ সালে ইন্ডিয়ান রিসার্চ ফান্ড অ্যাসোসিয়েশনের তরফে তাঁকে অনুদান দেওয়া হয়। শুরু হয় বৃহত্তর গবেষণা। অ্যান্টিমনি ও জৈব যৌগের সংযোগ ঘটিয়ে একদিন অন্ধকারে ঘরেই আলোর বিচ্ছুরণ ঘটান উপেন্দ্রনাথ। তৈরি হয় ইউরিয়া স্টিবামাইন। প্রথমে খরগোশের উপর প্রয়োগ করে সুফল পান উপেন্দ্রনাথ। পরে মানুষের উপর প্রয়োগ করে একই ফল পান। তৈরি হয় কালাজ্বরের জীবনদায়ী ওষুধ। সালটা ১৯২২।
ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজেও তখন কালাজ্বরের ছায়া, রোগ সারিয়ে প্রাণ বাঁচালেন উপেন্দ্রনাথ
১৯২৩ সালে ক্যাম্পবেল ও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কালাজ্বর রোগীদের ওপর ইউরিয়া স্টিবামাইনের প্রয়োগ করেন উপেন্দ্রনাথ। দেখা যায়, মাত্র দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে কোনওরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই রোগ নিরাময় সম্ভব হচ্ছে। পর পর ন’জন রোগীকে সুস্থ করে তোলে উপেন্দ্রনাথের প্রতিষেধক। নাম ছড়ায়। ব্রিটিশ সরকারের তখনও খুঁতখুঁতে ভাব। ওষুধের স্বাস্থ্যকর ফলের তুলনায় এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে তখন মাথা ঘামাচ্ছে চিকিৎসক মহল।
তবে উপেন্দ্রনাথের আবিষ্কারের স্বীকৃতি দিলেন অসমের গর্ভনর স্যর জন খের। তিনি বললেন, এক বছরে প্রায় তিন লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে ইউরিয়া স্টিবামাইন। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত আরোগ্যের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০ লাখে। গোটা অসমজুড়ে সার্বিক ভাবে এই ওষুধের প্রয়োগ করতে নির্দেশ দেন তিনি। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রিস, ফ্রান্স, চিন-সহ কিছু কিছু দেশেও এই প্রতিষেধকের প্রয়োগ শুরু হয়। কালাজ্বরে মৃত্যুর হার নেমে এল ৭ শতাংশে।
প্রতিষেধকের পেটেন্ট নেননি উপেন্দ্রনাথ, নোবেলও অধরা থেকে যায়
বিশ্বজোড়া খ্যাতির বদলে মানুষের প্রাণ বাঁচানোই মূল লক্ষ্য ছিল এই প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক-বিজ্ঞানীর কাছে। বিনামূল্যে রাজ্যে রাজ্যে তাঁর আবিষ্কার পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বেঁচেছিল। জনহিতকর কাজের জন্য ১৯২৪ সালে তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি দেওয়া হয়। তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড লিটনের কাছ থেকে পান ‘কায়সার-ই-হিন্দ’ পদক। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘নাইটহুড’ উপাধিতে সম্মানিত করে। তা ছাড়াও, কলকাতা স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন থেকে মিন্টো পদক, বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে স্যার উইলিয়াম জোনস পদক, পুরস্কার দেওয়া হয় অজস্র। অথচ কালাজ্বরের মতো প্রাণঘাতী রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়ার ব্যাপারে টুঁ শব্দটিও করেনি নোবেল কমিটি। ১৯২৯ সালে নোবেলের জন্য মনোনয়ন পেলেও, সেই স্বীকৃতি তাঁকে দেওয়া হয়নি।
তার পরেও কাজ থামাননি উপেন্দ্রনাথ। ব্ল্যাক ওয়াটার ফিভার উপশমের ওষুধও তাঁরই আবিষ্কার। কুষ্ঠ, মেনিনজাইটিসের মতো দুরারোগ্য ব্যধির উপরেও তাঁর গবেষণা বিস্তর। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে নিজের বাড়িতেই তৈরি করেন ‘ব্রহ্মচারী রিসার্চ ইনস্টিটিউট।’ বিশ্বের দ্বিতীয় ও দেশের প্রথম ব্লাড ব্যাঙ্ক তিনিই তৈরি করেন। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান তাঁর তথ্যসূত্র অনুসরণ করে আজও। আন্তর্জাতিক দরবারে উপেক্ষিত থেকে গেলেও দেশের মাটিতে আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর নাম।