ড: শোয়েব সাঈদ
জাপানের গানো প্রিফেকচারের (কেন) ইনা শহরে ২০০১ সালে শিনশু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক জীবনের ইতি টেনে কর্পোরেট চাকুরীতে যোগ দিতে কিয়োশু দ্বীপের ওইতা প্রিফেকচারের (কেন) সাইকি শহরে এসেছিলাম স্বপরিবারে প্রকৃতির উজাড় করা নান্দনিকতায় পাহাড়, সমুদ্র, অসংখ্য সেতু আর টানেল পেরিয়ে দুই দিনে প্রায় ১৭০০ কিমি ড্রাইভ করে। মাঝখানে বিরতি ছিল তৎসময়ে পিএইচডি গবেষক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বন্ধু ডঃ সাইফুল ইসলাম রলিনের হিরোশিমার বাসায়। সাইকি শহরে কর্পোরেট চাকুরীর এক পর্যায়ে আরএন্ডডি সেন্টারের গবেষক থেকে টোকিওর হেড অফিসে ম্যানেজমেন্টে পদে বদলি; সময়টা ২০০৬ সালের দিকে। সাইকি থেকে আবার স্বপরিবারে হাজার কিলমিটার দূরের টোকিওতে। দীর্ঘ ড্রাইভ বাচ্চাদের জন্যে কষ্টকর তাই এবার পশ্চিম জাপানের সাইকি শহর থেকে ড্রাইভ করে টোকিওতে যেতে ইচ্ছে হলনা। অফিস থেকে পরিবারে সবার জন্যে বিমানের টিকেট বরাদ্দের সময় মনে হল বিমানে তো হর-হামেশাই উঠতে হচ্ছে, বুলেট ট্রেনে দীর্ঘ এই যাত্রাটির ব্যবস্থা করলে মন্দ তো নয়।আমার অনুরোধে অফিস থেকে বুলেট ট্রেনের টিকেটের ব্যবস্থা হল। বাচ্চাগুলো জাপানের ট্রেডমার্ক বুলেট ট্রেনে দীর্ঘ ভ্রমণটি বেশী উপভোগ করবে এই ভাবনাই ছিল সিদ্ধান্তের মূল কারণ।সাইকিতে কোম্পানির বাসায় থাকতাম সহকর্মীদের একটা আন্তরিক পরিবেশে এবং বাসাটি ছিল তিন তালায়।মালামাল পরিবহণে জাপানের বিখ্যাত কিছু কোম্পানি যেমন কুরুনেকো (কালো বিড়াল) তাক্কিউবিন, সাগাওয়া কিউবিন প্রবল জনপ্রিয়।দেখলাম তিনতালা থেকে আসবাদপত্র নামানোর জন্যে আমাদের কোম্পানির নিয়োগকৃত এজেন্ট ক্রেন নিয়ে হাজির। বারান্দার জানালা খুলে কম পরিশ্রমে, ঝুঁকিবিহীন তৎপরতায়, দ্রুততার সাথে মালামাল লোড করে চলে গেল।
পুরো অপারেশনটি ছিল দৃষ্টিনন্দ আর ইম্প্রেসিভ আর আমাদের ভূমিকা ছিল দর্শকের মত। যাক প্রসঙ্গে ফিরে আসি, মালপত্র টোকিও’র দিকে যাত্রা করার পর আমরাও বের হলাম। এক্সপ্রেস ট্রেনে সাইকি থেকে ওইতা শহর আর উষ্ণ-প্রসবণের শহর বেপ্পু’র ভেতর দিয়ে পাহাড় আর সমুদ্র দেখতে দেখতে উত্তর কিউশুর ফুকুওকা প্রিফেকচারের জংশন স্টেশন ককুরাতে। সেখান থেকে টোকিওতে যাবার বুলেট ট্রেনটি ছিল ৩০০ কিমি গতির ট্রেন নোজোমি যার অর্থ হোপ বা আশা। বাচ্চা দুটোর যথারীতি পছন্দ জানালার পাশের আসন। টোকিও পর্যন্ত যাত্রাটি ছিল প্রায় ৫ ঘণ্টার। বুলেট ট্রেনের সিট বিশেষ করে নোজোমির মত খান্দানি বুলেট ট্রেনের সিটগুলো বিমানের মতই। কিছুক্ষণ পরপর জাপানি কায়দায় খাবারের ফেরীওয়ালাদের আনাগোনা বাচ্চাদের কাছে পছন্দের প্যাকেট লাঞ্চের বায়না ধরার যৌক্তিক একটা অজুহাত বটে। এটি ছাড়া ওদের কাছে ট্রেন জার্নি অনেকটাই পানসে। ট্রেন যখন টানেলে ঢুকে বা বের হয় বাতাসের চাপে যে শব্দটি হয়, দ্রুত গতিতে অথচ মসৃণতায় চলতে থাকা ট্রেনটির অপেক্ষাকৃত নীরব পরিবেশে এটি কিচ্ছুক্ষন পরপর অনেকটা ছন্দপতনের মত। বুলেট ট্রেনে নিরাপদ ভ্রমণ ব্যবস্থার সাথে সাথে যাত্রার মসৃণতার অনেক গল্প শুনা যায়।তারমধ্যে অন্যতমটি হচ্ছে চলন্ত ট্রেনে জানালার পাশে সিগারেট দাঁড় করিয়ে রাখলে এটি পড়ে যায়না। ভাবলাম এই মিথটা নিজেই পরখ করে দেখা যাক। সিগারেট দাঁড় করালাম জানালার পাশে। যতক্ষণ পর্যন্ত ট্রেনটি বাঁক না নিচ্ছে, সিগারেটটি দাঁড়িয়ে থাকছে। বাঁকে কিংবা টানেলে প্রবেশ করার সময় চাপজনিত ঝাঁকুনিতে অবশ্য সিগারেট পড়ে যায়।