অধ্যাপক শ্রী আনন্দ মোহন দাস ১৯৪০ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার শাহাবাজপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক এবং পরিসংখ্যানে মাষ্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে, আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান থেকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে কৃতিত্বের সাথে মাষ্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় ষাটের দশকে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের বিশিষ্ট নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তান সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলিতে অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও সফলতার সাথে জগন্নাথ হলের নির্বাচিত ভি,পি, হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রাকস্বাধীনতাকালে পাকিস্তান সরকারের গনবিরোধী শিক্ষানীতি, বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক আচরণের বিরুদ্ধে ছাত্র গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সরকারের রোষানলে পরেন। তিনি কমরেড ফরহাদ, কাজী জাফর আহমেদ সহ অনেক প্রখ্যাত ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বহুবার কারাবরণ করেন। পাকিস্তানী সামরিক সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ, শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের গড়ে উঠা আন্দোলনে সমর্থন অব্যাহত রাখেন এবং সরকারী চাকুরীতে একজন কর্মকর্তা হিসাবে যোগ দেন। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানী গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা তাঁর কাছ থেকে উৎকোচ দাবী করলে তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন। যার পরিণতিতে মিথ্যা অভিযোগ ও তথ্যের ভিত্তিতে পাক সরকার তাঁকে চাকুরী থেকে সাময়িক কর্মচ্যুত করে। তিনি সরকারের অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট থেকে সরকারের অবৈধ আদেশ প্রত্যাহার বা বাতিল করে দেয়। তিনি চাকুরীতে বকেয়া বেতন ও ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বহাল হন। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের আঁধারে নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। তিনি পাকবাহিনী এবং তাঁদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা আক্রমণের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হওয়ার বিষয় আঁচ করতে পেরে স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের আগরতলায় আশ্রয় নেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে একটি শরনার্থী শিবিরের সচিব হিসাবে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পরে তিনি ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান, আন আরবরে (University of Michigan, Ann Arbor) জনস্বাস্থ্য বিষয়ে মাষ্টার্স ডিগ্রী (Masters in Public Health) অর্জন করেন। তিনি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের মধ্যে একজন ছিলেন, যিনি আমাদের রোগ প্রতিষেধক ও সামাজিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি তাঁর আধুনিক শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে রোগ প্রতিষেধক ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রচার, প্রসার এবং প্রয়োগের জন্য দৃঢ় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) [National Institute of Preventive and Social Medicine – NIPSOM] এর বায়ো স্ট্যাটিক্স বিভাগের প্রধান ছিলেন। তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন এবং জনস্বাস্থ্যের উপর দুই শতাধিক নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য নীতি উন্নয়ন বিষয়ক ধারণা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের অসংখ্য বিশিষ্ট চিকিৎসক এবং নীতি নির্ধারকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণের পথিকৃৎ ছিলেন।
নিপসম থেকে অবসর নেওয়ার পরে তিনি ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লিউ.এইচ.ও) এর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একজন নির্বাহী স্তরের কর্মকর্তা হিসাবে যোগদান ককরেছিলেন। তিনি শ্রীলঙ্কা ও নেপালে কাজ করেছেন। সেখানে তিনি উন্নয়ন পরিকল্পনা পদ্ধতি বিষয়ক ধারনাপত্র প্রস্তুত এবং অন্যান্য জটিল বিশ্লেষণাত্মক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ২৫ বছরের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন।
ডব্লিউএইচও থেকে অবসর নেওয়ার প্রাক্কালে তিনি নেপালে জাতিসংঘের একজন কনসাল্টেন্ট হিসাবে যোগ দেন।
নেপালে জাতিসংঘের পরামর্শকের দায়িত্ব পালন শেষে তিনি তার পরিবারের সাথে বাকী জীবন কাটাতে কানাডায় স্থায়ী বাসিন্দা হন। এমনকি অবসরপ্রাপ্ত জীবনের সময়কালেও তিনি যেভাবেই পারেন সম্প্রদায়ের সহায়তা করার জন্য সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করেছেন। তিনি কমিউনিটি সদস্যদের তাদের শরণার্থী হিসাবে প্রার্থীতায় সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন গবেষণা এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য অক্লান্ত সময় ব্যয় করেছেন। তিনি শাহরিয়ার কবিরের বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর একটি ডকুমেন্টারির জন্য এসওএস নামে ইংরেজি সাবটাইটেল তৈরি করেছিলেন। যা কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনে প্রদর্শিত হয়েছিল এবং তিনিও ঐ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। তিনি নীরবে, নিভৃতে নিজের শান্ত স্বভাব বজায় রেখে গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে কমিউনিটি ইভেন্টগুলিতে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি মন্ট্রিয়ালে অবস্থিত ভিএজি,বি নামে পরিচিত একটি বাংলাদেশী সামাজিক সংস্থার সহ-সভাপতি ছিলেন এবং বাংলাদেশে সু-শাসন প্রতিষ্ঠার উপর একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। তাছাড়াও তিনি বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক আলোচনা সভায় মূল বক্তা হিসাবে অবদান রাখেন।
তিনি সারা জীবন আত্মপ্রচার বিমূখ একজন আগ্রহী পাঠক ছিলেন। তিনি হাজার হাজার বই অধ্যয়ন করেছেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল। তিনি যে সমস্ত বই অধ্যয়ন করেছেন, বিভিন্ন আলোচনায় কিংবা কথাচ্ছলে সেই সমস্ত পুস্তকের পৃষ্ঠা নম্বর দ্বারা এবং ঘটনার তারিখ ও সময় উদ্ধৃত করে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর বর্ণনা করতে সক্ষম ছিলেন। তিনি সবাইকে বই পড়তে উৎসাহিত করতেন। যখনই বাংলাদেশে যেতেন তিনি বই ভর্তি লাগেজ নিয়ে যেতেন এবং প্রিয়জনদের বই উপহার দিতেন। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ পারিবারিক মানুষ। তিনি তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর ঊভয় পরিবারের নির্ভরশীল কর্তাব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন এক সৎ, সদাচারী, বিদ্বান এবং প্রচণ্ড বিনয়ী ভদ্রলোক।
তিনি তার দুই প্রকৌশলী পুত্র অভিজিৎ ও অরিজিৎ এবং অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী দুই কন্যা এবং চার নাতিনাতনি ছাড়াও অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, গুণগ্রাহী ভক্ত রেখে গেছেন। পরিবার পরিজন এবং কমিউনিটির সকলেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাঁর অভাব দারুণভাবে অনুভব করবেন। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।