লিখেছেন পরিমল পালমা
চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অসততা, উপসাগরীয় দেশগুলোতে শ্রমিকের চাহিদা কমে যাওয়া এবং নতুন বাজার খোঁজার ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশিদের জন্যে কমে যাচ্ছে বিদেশে চাকরির সুযোগ।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসাবে ২০১৭ সালে ১০ লাখের বেশি বাংলাদেশি বিদেশে চাকরির সুযোগ পেয়েছিলেন। গত বছর তা কমে সাত লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ জনে এসে দাঁড়ায়।
চলতি বছরের প্রথম আট মাসে বাংলাদেশিদের চাকরির সংখ্যা ছিলো চার লাখ ১৭ হাজার ৮৪টি। বছর শেষে তা ছয় লাখ ২৫ হাজার ৬২০ এ দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।
শ্রম অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং নিয়োগদাতাদের আশঙ্কা- বিদেশে শ্রমবাজার সংকুচিত হলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে যাবে। এমনকী, দেশের চাকরির বাজার ও অর্থনীতিতে চাপ পড়বে।
বিদেশে কর্মরত প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি গত বছর প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মত, নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব অসততা রয়েছে তা দূর করতে পারলে এবং বিদেশে অভিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করা গেলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরো বেশি হতে পারতো। এই অসঙ্গতিগুলোর কারণে মালয়েশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো কয়েকটি দেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের জন্যে বিধিনিষেধ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশিদের জন্যে সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার হলো মধ্যপ্রাচ্য। দুর্বল অর্থনীতির কারণে নিজেদের নাগরিকদের জন্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসংস্থান তৈরি করছে সেখানকার দেশগুলো। ফলে, বাংলাদেশিদের জন্যে সংকুচিত হয়ে আসছে সেখানকার শ্রমবাজার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা রোজানা রশীদ বলেন, “এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আমাদের যা প্রয়োজন তা হলো- শ্রমবাজারের প্রবণতাগুলো পরিষ্কারভাবে বিশ্লেষণ করা এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে তার কৌশল প্রণয়ন করা।”
মালয়েশিয়া
বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম চাকরির বাজার হলো মালয়েশিয়া। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১০টি নিয়োগকারী সংস্থার একটি সিন্ডিকেট শ্রমিক নিয়োগ ব্যবসাকে একচেটিয়াকরণ এবং ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শ্রমিকদের কাছ থেকে চার লাখ টাকা করে রিক্রুটিং ফি নেওয়ার অভিযোগে বাংলাদেশিদের নিয়োগ স্থগিত করেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি।
দেশটিতে মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন সরকার বিদেশিকর্মী নিয়োগ খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, তবে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়াটি আবার শুরু করা হয়নি।
এদিকে, মালয়েশীয় সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগে নেপাল সেই দেশে তার শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করেছিলো। সম্প্রতি, মালয়েশিয়ার সঙ্গে নেপাল একটি চুক্তি করেছে।
অভিবাসন বিশ্লেষক অধ্যাপক রোজানা বলেন, “নেপাল সফলভাবে আলোচনা করেছে এবং মালয়েশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেছে। কিন্তু, আমরা তা করতে পারিনি।”
সংযুক্ত আরব আমিরাত
সৌদি আরবের পর সংযুক্ত আরব আমিরাত হচ্ছে বাংলাদেশিদের জন্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম চাকরির বাজার। ২০১২ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বিধিনিষেধ আরোপ করে আমিরাত সরকার।
এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তবে দেশটির কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন যে, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কয়েকজন বাংলাদেশির জড়িয়ে পড়া এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির কারণে এই বিধিনিষেধ এসেছে।
২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ১৬ লাখ বাংলাদেশি সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়েছেন। রিক্রুটিং এজেন্ট এবং কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে ওই সময়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক জালিয়াতি হয়েছিলো।
আমিরাতের দুবাইয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বেশিরভাগই চাকরি ছিলো না- এমন পরিস্থিতিতে দালাল এবং শ্রমিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছিলো। এর ফলে আমিরাত কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্যে দরজা বন্ধ করে দেয়।
বর্তমানে আমিরাতের স্থানীয় লোকজন গাড়িচালক, বাগানের মালি এবং রান্নাসহ বিভিন্ন কাজের জন্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ করতে পারবেন।
বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাত গত বছরের এপ্রিলে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী উপসাগরীয় দেশটিতে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশিদের নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিলো। তবে তা এখনো শুরু হয়নি।
ঢাকায় আমিরাত দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা গত ২২ সেপ্টেম্বর ডেইলি স্টারকে বলেন, “আমি মনে করি এটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ঠিক কী কারণে এটি শুরু হচ্ছে না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।”
সৌদি আরব
গত সাত বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশের জন্য শ্রম বাজার পুনরায় চালু করে সৌদি আরব। ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ ৪৪ হাজার বাংলাদেশিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তবে, দেশটি এখন জোরালোভাবে সৌদি নাগরিকদের জন্যে কর্মসংস্থান করার ওপর জোর দিচ্ছে। এই নীতির ফলে তেল সমৃদ্ধ দেশটি কোনো বিদেশি নয়, বরং স্থানীয়দের নিয়োগ দেওয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
সৌদি সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, ২০১৭ সাল থেকে বিদেশি ও বিদেশি ব্যবসায়ের উপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করায় প্রায় ১৯ লাখ বিদেশি সৌদি আরব ত্যাগ করেছেন।
বৈধ কাগজ থাকা সত্ত্বেও কয়েক হাজার বাংলাদেশি সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন।
জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, “সৌদিতে আসা অনেক বাংলাদেশি চাকরি পরিবর্তন করেছেন বা স্থানীয় আইন লঙ্ঘন করে স্বাধীনভাবে কাজ করেছেন।”
তিনি আরো বলেন, “সৌদি কর্তৃপক্ষ এ ধরনের আইন লঙ্ঘনের ঘটনা আর মেনে নিচ্ছে না। তাই, যাদের বৈধ ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে তাদের কয়েকজনকে আইন লঙ্ঘনের কারণে আটক করে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
জনশক্তি ব্যুরোর তথ্যে জানা যায়, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত দুই লাখ ৩৪ হাজার ৭১ জন বাংলাদেশি সৌদি আরব গিয়েছেন।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রিয়াদে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশি হানিফ মিয়া বলেন, আসলে যেসব সংস্থা এই শ্রমিকদের নিয়োগ দিয়েছে তাদের অনেকেই সেসব সংস্থায় চাকরি পাচ্ছেন না। তাই, তারা আইন লঙ্ঘন করে স্বাধীনভাবে বা অন্য সংস্থায় কাজ করার চেষ্টা করছেন।”
রিয়াদ থেকে টেলিফোনে তিনি ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, “এ কারণেই তাদের আটক ও দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
তার মতে, সৌদি কর্তৃপক্ষ বিদেশিদের মোবাইল ফোন এবং ইলেকট্রনিক্সসহ কয়েকটি ব্যবসা পরিচালনা নিষিদ্ধ করে আইন প্রয়োগ করছে। তাই, এ জাতীয় ব্যবসায় যুক্ত অনেক বাংলাদেশিকে দেশে ফিরে যেতে হচ্ছে।
অন্যান্য দেশ
লেবানন ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ১৬ হাজার বাংলাদেশিকে নিয়োগ দিচ্ছিলো। এখন দেশটি বছরে সাত হাজারের মতো কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে।
বাহরাইনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দেশটি বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এ বছর আগস্ট পর্যন্ত বাহরাইন মাত্র ১৩২ জন শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছে। অথচ, গত বছর এই সংখ্যা ছিলো ৮১১ জন। সেখানে প্রতি বছর গড়ে ৩২ হাজার শ্রমিককে নিয়োগ দেওয়া হতো।
২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জর্ডান প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ২০ হাজার শ্রমিক নিতো। এটি এখন ১১ হাজারে এসে নেমেছে।
এমন চিত্র দেখা যায় ওমান, কাতার, সিঙ্গাপুরেও। দেশগুলোতে সম্প্রতি ৪০ হাজার থেকে ৭০ হাজার শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
কী করণীয়?
নতুন আশার কথা হচ্ছে- জাপান দক্ষ শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি সই করেছে।
যারা জাপানে যেতে আগ্রহী তাদের জন্য ভাষা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্প্রতি শুরু হয়েছে। জনশক্তি ব্যুরোর কর্মকর্তারা জানান, জাপানে চাকরি প্রার্থীদের প্রস্তুত করতে কিছুটা সময় লাগবে।
অভিবাসন গবেষক অধ্যাপক সৈয়দা রোজানা রশীদ বলেন, বাংলাদেশ যে বড় সমস্যাগুলির মুখোমুখি হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, উচ্চ অভিবাসন খরচ ঠেকাতে ব্যর্থতা। এর ফলেই শ্রম সংক্রান্ত অন্যান্য সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে- যেসব দেশ নিয়োগ দিচ্ছে সেসব দেশের সঙ্গে কার্যকর দেনদরবার এবং অভিবাসী শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা বাড়ানোর অভাব। উন্নত দেশগুলোতে নার্সিং, চিকিৎসা প্রযুক্তি এবং কেয়ারগিভিং খাতগুলোতে দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন। তার মতে, সেসব কাজের জন্যে শ্রমিকদের প্রস্তুত করতে এবং নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র খুঁজে বের করতে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে একজন শ্রমিকের দক্ষতা রয়েছে এক কাজে অথচ তাকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে অন্যান্য কাজে। এর ফলে, শ্রমিকের দক্ষতা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না।
রিক্রুটিং এজেন্সি এসএ ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী আব্দুল আলীম বলেন, উন্নত দেশগুলোতে কাজ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্যে তাদের দক্ষতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, “আমি কয়েক বছরে বিভিন্ন সময় সরকারকে এই কথা বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কেউ গুরুত্ব দেয় না।”
শুধুমাত্র স্বল্প ও আধা দক্ষ শ্রমিকদের নিয়োগ দিয়ে প্রথাগত শ্রমবাজারের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে ভবিষ্যতে কোনো সুবিধা পাওয়া যাবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তার মতে, “বিদেশে চাহিদা অনুযায়ী পেশাগুলোর জন্যে আমরা যদি আমাদের যুবকদের দক্ষ করে তুলতে পারি তবেই আমরা আরো অনেক কিছু অর্জন করতে পারবো। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা ও কাজ শুরু করার এখনই প্রকৃত সময়।”