এক সময় বলতে গেলে তার কথাই ছিল ‘আইন’। তার ডাকে মুহূর্তে হাজির হতো শত শত কর্মী। তার সঙ্গে একটি সেলফি তুলতে পারলে অনেকেই নিজেকে ধন্য মনে করত। তবে ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে পাল্টে যায় হাওয়া। এক সময়ের আলোচিত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট রাতারাতি যেন তার সাম্রাজ্য হারিয়ে ফেলেছেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিস্কৃত সভাপতি সম্রাট এখন ১০ দিনের রিমান্ডে। গ্রেফতারের পর থেকে রিমান্ড পর্যন্ত অনেক বিষয়ে মুখ খুলেছেন তিনি। তিনি এমন প্রশ্ন তোলেন- ‘শুধু আমি কেন, ক্যাসিনোর অর্থ তো অনেকেই পেয়েছেন।’ সম্রাট এও বলেন, ‘ক্যাসিনো খেলা ছিল তার পুরনো অভ্যাস। সেই কুঅভ্যাসই তাকে এখন ভোগাচ্ছে।’ জীবনের উত্থান-পতনের কথা বলতে গিয়ে একাধিকবার সম্রাটের গলা ভারী হয়ে ওঠে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, সম্রাটের আগেই ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের একজন নেতা ক্যাসিনোর কারবার শুরু করেন। হোটেল সেরিনায় ওই কারবার খুলে বসেন তিনি। সেখানে ক্যাসিনো চালাতে কয়েকজন নেপালিকেও ঢাকা নিয়ে আসেন যুবলীগ উত্তরের ওই নেতা। তবে সেরিনায় ক্যাসিনো কারবার জমানো সম্ভব হয়নি। পরে সম্রাট তার সঙ্গীদের নিয়ে শুরু করেন ক্যাসিনো। এতে তিনি দ্রুত কোটি কোটি টাকা কামাতে থাকেন। সম্রাটের নিয়ন্ত্রণে ছিল ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাব। এ ছাড়া মতিঝিলে দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব থেকেও ক্যাসিনোর টাকা পেতেন সম্রাট। ভিক্টোরিয়া ক্লাব ও মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের ক্যাসিনোর অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি। সম্রাটের টাকার ভাগ আরও অনেকের কাছে যেত। গ্রেফতারের পর সম্রাটের প্রশ্ন- ক্যাসিনোর জন্যই যদি তার এই পরিণতি হয়, তাহলে অন্যরা কেন বহাল তবিয়তে। যুবলীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা ক্যাসিনো কারবার থেকে মাসে ১০ লাখ টাকা চাঁদা নিতেন। এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাও ক্যাসিনোর সুবিধাভোগী ছিলেন।
গ্রেফতারের পর সম্রাট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জানান, তার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন যুবলীগ দক্ষিণের বহিস্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ ও আরমান। তবে জি কে শামীমের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল না বলে জানান। বরং গণপূর্তে এককভাবে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তার সঙ্গে সম্রাটের বিরোধ ছিল।
১৮ সেপ্টেম্বর অভিযান শুরুর পরও সম্রাটের ধারণা ছিল, হয়তো তাকে গ্রেফতার করা হবে না। ভেবেছিলেন, অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা ও ভুল স্বীকার করে এই দফায় পার পেয়ে যাবেন তিনি। এই ধারণা থেকেই অভিযান শুরুর পরও প্রথম কয়েক দিন কাকরাইলের কার্যালয়ে অবস্থান করেন তিনি। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় তার ধারণা। এরপর তিনি পালানোর চিন্তা করেন। একপর্যায়ে উপায়ান্তর না দেখে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আরমানকে নিয়ে ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। সে কারণে আরমানকে নিয়ে ভারত সীমান্ত থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জশ্রীপুর গ্রামে পূর্বপরিচিত মনিরুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে ছক্কা মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন। সম্রাট জানান, পরিস্থিতি অনুকূলে নয় বুঝতে পেরেই একটি মাইক্রোবাসে আরমানকে নিয়ে কুমিল্লায় যান তিনি। তবে কুমিল্লায় যাওয়ার সময় সঙ্গে খুব বেশি টাকা-পয়সা নেননি।
জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট বলেছেন, ‘জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। টাকা-পয়সা যা কামিয়েছি তা কর্মীদের মধ্যে বিলি করেছি। এমন পরিণতি আসবে সেটা কল্পনায় ছিল না।’ কয়েক নেতার নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের কিছু হচ্ছে না কেন? এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের বেশ কয়েকজনের ব্যাপারে উষ্ফ্মা প্রকাশ করেন তিনি। সম্রাট জানান, একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার ‘এপিএস’ও ক্যাসিনোর বড় সুবিধাভোগী ছিলেন। এ ছাড়া দেশের বাইরে গিয়ে ক্যাসিনো খেলার কথা স্বীকার করেছেন তিনি। এ সময় তিনি কোটি কোটি টাকা খরচ করতেন। একাধিকবার সিঙ্গাপুরে জুয়া খেলতে যান তিনি। সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোয় পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ থেকেও আসেন জুয়াড়িরা। সেখানেও সম্রাট ভিআইপি জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রথম সারির জুয়াড়ি হওয়ায় সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও করা হতো। এয়ারপোর্ট থেকে মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনো পর্যন্ত তাকে নিয়ে যাওয়া হতো বিলাসবহুল লিমুজিন গাড়িতে।
সম্রাট এও জানান, ‘তার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। তার শরীরে পেসমেকার বসানো। হেঁটে সিঁড়ি ভাঙা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তাই দুই বছরের বেশি সময় ধরে দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরীর ডিওএইচএসের বাসায় যেতেন না। পরিবারের খরচের টাকা মাসে দু-একবার গিয়ে কাকরাইলের অফিসে নিয়ে আসতেন শারমিন। তবে শুধু শারীরিক অবস্থার কারণে সম্রাট তার দ্বিতীয় স্ত্রীর বাসায় যেতেন না এটা বিশ্বাস করতে নারাজ গোয়েন্দারা। ক্যাসিনো ছাড়াও বিদেশি এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কের জের ধরে শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে সম্রাটের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সম্রাটকে গ্রেফতারের পর এখন ক্যাসিনোর সুবিধাভোগীদের ব্যাপারে তথ্য নেওয়া হচ্ছে। দেশে-বিদেশে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব নিচ্ছেন গোয়েন্দারা। ‘গ্লাসবয় জাকির’ নামে একজনের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া শুরু হয়েছে। সম্রাটের কয়েক কোটি টাকা তার কাছে রয়েছে। যুবলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য বলে পরিচয় দিতেন জাকির। এক সময় কাকরাইলে হোটেল ম্যাডোনায় গ্লাস পরিস্কার করতেন তিনি। সেই থেকে তার নাম হয় ‘গ্লাসবয় জাকির’। খোঁজ নেওয়া হচ্ছে ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা মীর মাহবুব রনি ও আহাদ বাপ্পীর। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ- তারা মহানগর প্লাজা, সিটি প্লাজা ও নগর প্লাজা থেকে মাসে ২০ লাখ টাকার ওপর চাঁদা তুলতেন।
সূত্র আরও জানায়, সম্রাটের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্তভার র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আজকালের মধ্যে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়াও র্যাবের কাছে ন্যস্ত হতে পারে।