লিখেছেন মোতাসেম এ দাল্লোউল
মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরব গত সপ্তাহান্তে ঘোষণা করেছিল যে তার আরামকো তেল কোম্পানির আবাকাইক পেট্রোলিয়াম প্রক্রিয়াকরণ স্থাপনাগুলোতে এবং খুরাইস তেলক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট হামলা চালানো হয়েছে। ফলে তাদের দৈনিক তেলের উৎপাদন ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
সৌদি তেলের প্রধান আমদানিকারক হলো যুক্তরাষ্ট্র, যে দেশটি কিনা বিশ্ব জ্বালানি বাজারের স্বনিযুক্ত অভিভাবক। যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের প্রকৃত শাসক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের অধীনে সে দেশের বিপর্যয়কর মানবাধিকার রেকর্ডের প্রতি যে পক্ষপাতমূলক দৃষ্টি দিয়েছেন, তা গোটা বিশ্ব দেখেছে। মোহাম্মদ বিন সালমানের অপরাধের তালিকায় প্রায় এক বছর আগে ওয়াশিংটনভিত্তিক সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার ঘটনাটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাই তেলের প্রবাহ বজায় রাখতে, জ্বালানি বাজার রক্ষা করতে এবং রিয়াদকে পাশে ও শক্তিশালী রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রে হামলার জবাব দেবে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। হামলার পরপরই ট্রাম্প বলেছিলেন, রিয়াদে সরকারের দায়িত্বে রয়েছেন যাঁরা, তাঁরা হামলাকারীদের শনাক্ত করবেন, তিনি সেই অপেক্ষায় রয়েছেন। তিনি টুইট করেছেন, ‘এই হামলার কারণ কী এবং কারা এর পেছনে রয়েছে বলে সৌদি আরব মনে করে, তা আমরা তাদের কাছ থেকে শুনতে চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘এরপর আমরা কী শর্তে এগিয়ে যাব, সেটাও আমরা সৌদি আরবের কাছ থেকে শুনতে চাই।’
এত কিছুর পরও ট্রাম্প খুব একটা সরব হচ্ছেন না। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, তিনি ইরানের বিরুদ্ধে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন না। তাঁকে যখন ইরানে সম্ভাব্য সামরিক হামলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি তখন বলেছেন, ‘কাপুরুষোচিত কাজ করার জন্য প্রচুর সময় রয়েছে। এটি শুরু করা খুব সহজ এবং যা ঘটবে আমরা তা দেখব।’ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের আর সৌদি তেলের প্রয়োজন নেই। ট্রাম্প এটা স্পষ্ট করেছিলেন যখন তিনি এক টুইটে বলেছিলেন, ‘আমরা কয়েক বছর ধরে জ্বালানি উৎপাদন করছি, আমরা এখন জ্বালানি আমদানিকারক এবং এখন বিশ্বের ১ নম্বর জ্বালানি উৎপাদনকারীও। আমাদের মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও গ্যাসের প্রয়োজন নেই।’ সরকারি তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদিন অপরিশোধিত তেলের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৯৬ লাখ ব্যারেল।
ট্রাম্পের হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা না করার আরেকটি কারণ হলো মার্কিন অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের কাছে সৌদি আরব আর আগের মতো আকর্ষণীয় নয়। ইয়েমেনে ক্রমবর্ধমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে এবং সৌদি আরবে ইয়েমেনের নাগরিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের ক্রমবর্ধমান আহ্বানের কারণে সৌদি আরব আর সেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র কিনছে না। ফলে জৌলুশ হারিয়ে ফেলা একটি দেশকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধে নামা ওয়াশিংটনের পক্ষে লাভজনক কোনো বিকল্প নয়।
মনে হচ্ছে, ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এবং প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে সাক্ষাতের পরিকল্পনাগুলো নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে এর পেছনের কারণ এই নয় যে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আর বেশি দিন ক্ষমতায় থাকছেন না। ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার একটি বড় কারণ হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরান এখন সৌদি আরবের চেয়েও শক্তিশালী। কাজেই এই অঞ্চলে ভবিষ্যতে দুর্বল সৌদি আরবের চেয়ে ইরানের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপনই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লাভজনক হবে।
আর এ কারণেই ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর পরিবর্তে কেবল নিষেধাজ্ঞা বাড়িয়েছেন। তেল স্থাপনাগুলোর ওপর হামলার জবাব কীভাবে দেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা করতে রিয়াদে সৌদি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর পম্পেও বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং তাদের নিজেকে রক্ষা করার অধিকারকে সমর্থন করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সৌদি আরবে আরও কিছু করার সম্ভাবনা কম।
মোহাম্মদ বিন সালমান মনে হয় বার্তাটি পেয়েছেন, তাই তিনি বিকল্প সমর্থন খুঁজছেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি সৌদি আরবের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করতে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে সাহায্য চেয়েছেন। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সৌদি আরবের জৌলুশ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরব তার তেল ছাড়া কিছুই নয়। যদি যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাশে না থাকে, তাহলে কে আর থাকবে?
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
মোতাসেম এ দাল্লোউল ফিলিস্তিনের গাজাভিত্তিক সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ের বিশেষজ্ঞ