বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যপট বদলায়নি। কিন্তু আচমকা বদলে গেল আওয়ামী লীগের দৃশ্যপট। কেন এটা ঘটলো তা পরিষ্কার নয়।
অনেক কিছুই ঘটছে। কিন্তু তাতে ঘোর কাটছে না। অনেকেই বোঝার চেষ্টা করছেন, বিনা মেঘে কেন বজ্রপাত? কারো আশঙ্কা মাঝপথে থেমে যাবে না তো?
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যদিও অভয় দিয়েছেন। গতকাল বলেছেন, ‘দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও মাদকের চক্রকে ভেঙে না দেয়া পর্যন্ত এই অভিযান চলবে। যে-ই অপরাধ করুক না কেন, ছাড় দেয়া হবে না।’ কিন্তু তা সত্ত্বেও সন্দেহ, সংশয় কাটছে না। কারণ ‘মাদক যুদ্ধে’ চারশ’রও বেশি মানুষের প্রাণ খোয়া যাওয়ার পরেও প্রশ্ন ছিল, এখনো আছে। এর উত্তর নেই। এখন কিছু কথা বললেই মানুষ কেন বিশ্বাস করবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ‘মাদক চক্র’ ভাঙে না। সেই চক্র পুলিশি গ্রেপ্তারে ভীত হবে কেন? ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন, একটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার বিষয়ে তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে মাত্র দুই মাস আগে জানিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কোনো প্রতিকার পাননি। সারা দেশে এরকম কাহিনী ভূরি ভূরি।
তাই সার্বিক বিবেচনায় যারা আওয়ামী লীগ করেন, তাদের অনেকেই হতভম্ব। যুবলীগ চেয়ারম্যান এক দুর্দান্ত ‘আঙ্গুল চোষা’ থিওরি দেয়ার পরে প্রকারান্তরে তাকেই সমর্থন করেছেন সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী। তিনি কার্যত প্রশাসন কেন এমনটা করছে, সেই বিষয়েই বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সুতরাং দুটি ধারা।
হুইপ বলেন, ‘ক্লাবের তাস খেলা বন্ধ করে কোনো লাভ হবে না। তাস খেলা বন্ধ করলে ছেলেরা রাস্তায় ছিনতাই করবে।’ তার এ কথার কোনো প্রতিবাদ হয়নি। বাংলাদেশের আইনে তাসের জুয়াও নিষিদ্ধ। অথচ হুইপ বলেছেন, ক্যাসিনো ধরেন, কিন্তু তাস খেলা হয় এ রকম ক্লাব ধরবেন না।
তার কথায়, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী ক্যাসিনো এবং মদের ব্যবসা যারা করেন, তাদের ধরতে বলেছেন।’ প্রশ্ন উঠবে, প্রধানমন্ত্রী কি সত্যিই দুর্নীতিবিরোধী একটি স্থায়ী ও টেকসই অভিযান যা সবসময়, সকল পরিস্থিতিতে চলমান থাকবে, সেরকম নির্দেশ দেননি? শুধুই ক্যাসিনো ও মাদকবিরোধী অভিযান এটা?
ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অপসারণ সারা দেশের ছাত্রনেতাদের প্রতি বার্তা কিনা, সেই প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, গত কয়েকদিনে সংবাদ মাধ্যমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সম্পর্কে যে খবর বেরিয়েছে, তাতে তার স্বপদে থাকার কথা নয়। সুতরাং একটা ‘পিক অ্যান্ড চুজ’-এর বিষয় আছে বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ দৃশ্যত কেউ ছাড় পাচ্ছে, সেটা বাস্তবতা। ঘুষ কে খান জানতে চাইলে ওই হুইপ বলেন, ‘আপনি খান। আমি খাই। সবাই ঘুষ খান।’ ঘুষ কে দেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আপনি দেন। আমি দেই। সবাই দেন। তাদের ধরেন।’ তার কথায় দেশে ঘুষদাতা ও ঘুষখোরদের একটা উল্লাসের নৃত্য কল্পনা করা চলে। এমন সব উক্তি আওয়ামী লীগের ফোরাম থেকে আসতে পারে, সেটা কিছুদিন আগেও কেউ কল্পনা করতে পারেননি। এতদিন বিএনপি পাঁচবারের দুর্নীতি চ্যাম্পিয়ন- এই গান চলেছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দেশের নয়, আচমকা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে আংশিক দৃশ্যপট বদলেছে। নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীরের ভাষায়, ‘যখন সরকারের ইমেজ ভয়াবহভাবে তলানিতে এসেছিল। তখন এটা শুরু হলো। কেউ কেউ বলেন, এই তলানির কোনো দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করা কঠিন। তবে যেটা সহজ সেটা হলো, কতিপয়ের ক্ষেত্রে হঠাৎ যেন আইনের শাসন নাজিল হয়েছে।
আওয়ামী লীগ বিএনপির দুর্নীতির বিরুদ্ধে এখনো কড়াসুরে কথা বলছে। অথচ আওয়ামী লীগেই এখন প্রশ্ন উঠেছে, এই শুদ্ধি অভিযান কার বিরুদ্ধে? এটা কতদিন চলবে? এটা নীতিগত বিষয় হতে পারে কিনা। এটা আওয়ামী লীগের নতুন নীতিগত অবস্থান কিনা? নাকি কোনো অজানা কারণে কতিপয় নেতার বিরুদ্ধে হঠাৎ পরিচালিত অবস্থান? এটা হঠাৎ এসেছে। হঠাৎ যাবে। টর্নেডো মাত্র।
ইতিমধ্যে যারা প্রশ্ন তুলেছেন, তারা বলছেন, এটা আওয়ামী লীগকে সামাল দেয়ার বা বাঁচানোর একটা সাময়িক প্রচেষ্টা বা কৌশল হতে পারে। সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান যেমনটা বলেছেন। তার মতে সংস্কার না করে এবং দুর্নীতিবিরোধী একটি অবস্থান নীতিগতভাবে গ্রহণ না করে এই অভিযান আসলে কার্যকারিতা দেবে না। এবং এটাকে বেশিদিন চালিয়ে নেয়াও সম্ভব হবে না।
তবে এই সরকারের অনেকেই ১/১১তে প্রকারান্তরে বলেছিলেন, দুর্নীতির প্রয়োজন রয়েছে। উন্নয়ন বেশি হলে বেশি দুর্নীতি হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করাকে বি-রাজনীতিকরণ বলা হয়েছে। বিএনপিও তাই বলেছিল। এখনো যুবলীগ চেয়ারম্যান সেদিকেই ইঙ্গিত দিলেন। অনেকেই পাবলিক কেনাকাটায় দুর্নীতি দমনকে উন্নয়নবিরোধী চেষ্টা হিসেবে গণ্য করে থাকেন।
বিষয়টি কারো মতে, এমন নয় যে, গত এক দশকে এই প্রথম একটা ভয়াবহ দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সেটা আকস্মিক জেনে, ধরপাকড় শুরু হয়ে গেছে। ক্যাসিনোর বড় বড় বোর্ডণ্ডলো লুকিয়ে আমদানি করা সহজ ছিল না। ইয়ংম্যানসের সভাপতি সাবেক মন্ত্রী ছিলেন। তাই সচেতন মানুষের মধ্যে উত্তর পাওয়ার স্বস্তির চেয়ে উদ্বেগ বেশি। তবে সাধারণ মানুষ নিশ্চয় খুশি। তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে, এমন কঠোর পদক্ষেপই চাইছেন। তারা দোয়া করছেন, এই ধারা যেন থেমে না যায়। এটাই যেন দেশে আইনের শাসন, এটাই সুশাসনের সূত্রপাত ঘটায়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে একটা বৈপরীত্য ঠিকরে বেরিয়ে পড়েছে।
সচেতন মহল থেকে মনে করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগে যে শুদ্ধিকরণ অভিযান চলছে, সেই অভিযান একতরফাভাবে বেশিদিন চলবে কিনা? যারা ধরা পড়ছেন, তাদের বিচার হবে কিনা, সেটা আরেক মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ছিলেন চট্টগ্রামে। এদিনই হুইপ প্রশ্ন তুললেন, প্রশাসন কি খেলোয়াড়দের পাঁচ টাকা বেতন দেয়? ওরা কীভাবে খেলে? টাকা কোন জায়গা থেকে আসে? সরকার টাকা দেয় না। ওয়াকিবহাল মহল বলেছেন, এরকম ক্লাব কেন, বহু জায়গায় বহু খরচ হয়, কেউ জানে না, টাকার উৎস কি, আর এতদিন পরে এটা যে আদৌ কোনো প্রশ্ন, সেটাই অনেকে ভুলতে বসেছিলেন। কেউ বিএনপির প্রতিক্রিয়া দেখে পুলক অনুভব করছেন। কেউ বলছেন, তাদের মুখ বন্ধ থাকলে ভালো। কথা কম বলা হিতকর।
আইনের শাসনের বাস্তবতা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে দেশে সর্বোতভাবে দুর্নীতি দমন অভিযান শুরু হবে কিনা? দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক নাচতে নামবে কবে। তারা জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদের শুমারিতে নামবে কিনা? যেটা এক-এগারোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। সেখানে কিছুদিন সমস্ত প্রভাবশালীদের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। কারণ সেখানে সম্পদের বিবরণীর নোটিশ দেয়া হয়েছিল। সেই নোটিশ যাদের প্রাপ্য, তেমন ঘরানার লোকদের কাছে গত প্রায় এক দশক ধরে নোটিশ দেয়া একপ্রকার বন্ধ বলেই দুর্মুখরা দাবি করছেন।
যদি আজ কোনো কোনো দলের প্রথম সারির নেতানেত্রীর কাছে হিসাব চেয়ে নোটিশ দেয়া হয়, তাহলে তার সম্ভাব্য জবাব কি হতে পারে, সম্ভাব্য চিত্র কি হতে পারে, সেটা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
এদেশে প্রায়শ সব অনিয়ম সবার নাকের ডগার উপর দিয়ে চলে। যখন পারমাণবিক বালিশের ঘটনা এসেছে, যখন পর্দা এসেছে, তখনও এমন ক্রাকডাউন হয়নি। তাহলে ঘুরেফিরে প্রশ্ন উঠছে যে, সবকিছুই যখন এতদিন সবারই নাকের ডগার উপরে বসে চলছিল, তাহলে কেন এখন আইনকে নিজের আপন গতিতে চলতে দেয়া হচ্ছে বা হবে?
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থায় দ্রুত বিচার প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ বাদে। কোনো অপরাধ হলে, কোনো দুর্নীতি হলে, সেখানে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতরতা থাকলে, কোনোভাবেই সেখানে বিচারের গতি আনা সম্ভব হচ্ছে না। যারা দুর্নীতি করছেন, তারা যেকোনো পরিস্থিতিতে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন।
দেখা যায়, কখনো সরকার যদি চায়, তখন তাদের কেউ ধরা পড়ে। যাদেরটা তারা চান না, তারা ধরা পড়েন না। বা ততোদিন ধরা পড়েন না। তাই সমালোচকদের অনেকেই বলছেন, আইনের শাসনের যে ঘাটতি প্রকটভাবে চলছিল, সেটাই এই অভিযানের মধ্য দিয়ে প্রকট হয়েছে। একটি দুটি নয়, ৫ ডজন ক্যাসিনোতে ১২০ কোটি টাকা প্রতি রাতে খেলা হয়েছে। এখন পুলিশ বলছে, তারা এতদিন জানতেই পারেনি !
অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে গ্রেপ্তার জি কে শামীম দাবি করেছেন, টাকা দিয়ে তিনি গণপূর্ত বিভাগের কাজ কিনেছেন। কোটি কোটি টাকা সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছেন। প্রতিটি কাজে ১০ ভাগ হারে কমিশন দেয়ার কথাও স্বীকার করেছেন। দেশের ‘উন্নয়নের’ অধিকাংশক্ষেত্রে এমনটাই তো নিয়ম বলেই ণ্ডজব আছে। তাহলে যারা কমিশন নিলো, নিচ্ছে, তারা ধরা পড়বেন নাকি পড়বেন না। পরের দৃশ্যপটে কি আছে?
এক যে দেশে কিছু দুষ্ট গরু ছিল, তাদেরকে গোয়ালমুক্ত করা হয়ে গেছে, এমন দাবি করার মতো চমক আসবে না তো?