লিখেছেন মঈনুদ্দীন নাসের
আগস্ট মাসে আমেরিকায় উদ্বেগজনক হারে চাকরির সংস্থান কমে গেছে। জার্মান ফ্যাক্টরিতে চাকরির অধোগতির কারণে নতুন করে পণ্য তৈরির কারখানাগুলোকে সচল করার লক্ষ্যে ফের স্টিমুলাস বা প্রণোদনা চালুর জন্য অর্থনৈতিক পুঁজি বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে ক্রমাগত। চলতি মাসে ইউরোপীয় ব্যাংকগুলো ও আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক নতুন করে এ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। এতে বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত। তারা শঙ্কিত যেমন উন্নত বিশ্বে বিনিয়োগ নিয়ে, তেমনি অনুন্নত বিশ্বের বিনিয়োগ নিয়েও। কারণ অনুন্নত বিশ্বে রেমিট্যান্স একটি প্রধান আয়ের উৎস। কিন্তু উন্নত বিশ্বে চাকরি সংস্থানে টান পড়লে এই রেমিট্যান্স ঘাটতি ভবিষ্যতে অনুন্নত দেশসমূহে বিনিয়োগ বিমুখতা দেখা দেবে। এশিয়াও এই শঙ্কার বাইরে নয়। সব মিলিয়ে এশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে এক মহামন্দার পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
বিনিয়োগকারীরা ইউরোজোন ও আমেরিকার মুদ্রানীতি আরো সহজ করার ওপর জোর দিয়েছে। চীনও আগেভাগে তার নিজস্ব কায়দার স্টিমুলাস বা প্রণোদনা অর্থ সংকুলান করতে ঋণ প্রদানে ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছে। চীন বলেছে, তারা আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত।
জুলাই মাসে ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড (আইএমএফ) বলেছে, এ বছর বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বছরের শুরুতে যা করা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক কম হবে। ২০১৯ সালে ৩ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বেশি হবে না। তবে আইএমএফ বলেছে, ২০২০ সালে এ প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। আইএমএফ বলেছে, এ ধরনের রিকভারি অত্যন্ত দুর্বল, কারণ তা উঠতি বাজার ও বাণিজ্য সংঘাত স্থিতিশীল করার ওপর নির্ভর করে।
আমেরিকা ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে আরো অনেক দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাণিজ্য সংঘাত বেড়ে চলছে। তাদের মধ্যে নতুন করে করারোপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে ল্যাটিন আমেরিকার আর্জেটিনায় এ কারণে নতুন করে মুদ্রাসংকট দেখা দিয়েছে। এ সপ্তাহে আমেরিকা ও চীনা কর্মকর্তারা বলেছে, অক্টোবরের দিকে তারা মুখোমুখি হয়ে বাণিজ্য সংঘর্ষ এড়ানোর চেষ্টা করবে।
হোয়াইট হাউসের ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিলের পরিচালক ল্যারি কুডলো সিএনবিসিকে বলেছেন, ‘যারা উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল, তারা এখন শান্ত।’
তবু আলোচনায় কোনো রকম সমাধান সহজ নয়। শেষাবধি স্থায়ী বাণিজ্যিক শান্তি স্থাপন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রতিপক্ষ শি জিন পিং কতটুকু এগোবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
আমেরিকায় পরপর তিন মাস নিয়ে আগস্টে চাকরি সংস্থান আশানুরূপ নয়। মার্কিন দূতাবাস থেকে ইমিগ্রেশন ভিসা প্রদান কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাতিল করা হচ্ছে ইমিগ্রেশন আবেদন। আদমশুমারির ওয়ার্কার হিসেবে অনেককে চাকরিতে নিয়োগ করা সত্ত্বেও চাকরির সংস্থান কম। অকৃষি খাতে গত মাসে চাকরি বেড়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার। যদিও আশা ছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার। এ তথ্য থমসন রয়টার সার্ভে অব ইকোনমিস্টের দেওয়া।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ব অর্থনীতি বেশ খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে। চীন থেকে আমদানিতে আমেরিকার ক্রয় বৃদ্ধি, আমেরিকার জন্য উৎপাদনে সংকট ঘনীভ‚ত হওয়ার কারণে বিশ্বের এই অর্থনৈতিক শক্তিশালী রাষ্ট্রের মধ্যে উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। পণ্য উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিলেও বিশ্বে সার্ভিস সেন্টারে ক্রমাগত তেজিভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমেরিকা-চীনের বাণিজ্য সংলাপ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে এখনো কোনো উদ্বেগ নেই। তবে চীনের বিনিয়োগে নতুন শর্ত আরোপ চলছে। রাজনৈতিক শর্ত আরোপের সঙ্গে অর্থনৈতিক শর্ত আরোপ বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ পরিকল্পনা ৬৩ বিলিয়ন ডলারের। এই অর্থ প্রদান চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা মন্দা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ভরবেগ আরো গতিশীল হওয়ার আগে বর্তমানে তা ক্রমাগত গতিহীন হচ্ছে। ভালো হওয়ার আগে এ যেন নামছে খারাপের শেষ স্তরে! এই কম প্রবৃদ্ধিতে আমেরিকার ডলারের তেজিভাব এবং কম আস্থার পরিবেশে আমেরিকার ডলার দুর্বল করলে বাজারে ক্ষোভ সৃষ্টি হবে, তা প্রচ্ছন্নভাবে আরো উদ্বেগজনক পরিবেশের সৃষ্টি করবে।
প্রকাশিত পণ্য উৎপাদন জরিপ এই দুর্বলতার বিষয়টি পরিষ্কার করে। জেপি মরগ্যান বিশ্ব সূচকে চতুর্থ মাসের মতো সংকোচন দেখা দিয়েছে।
২০১২ সালের পর এই সংকোচন সর্বাধিক। সংকোচনের পরিমাণ অনেক বেশি। ৩০টি দেশেরও অধিক দেশে পণ্য উৎপাদন খাতে সংকোচন দেখা দিয়েছে। শিল্পসমৃদ্ধ জার্মানির অবস্থা সঙিন হওয়ায় ইউরোপ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এশিয়ায় রপ্তানিমুখী অর্থনীতির পতনও দ্রুত দেখা যাচ্ছে।
আমেরিকার পণ্য উৎপাদনকারী খাত, যা বাণিজ্যের ওপর কম নির্ভরশীল, তারও সংকোচন হচ্ছে। গত তিন বছরের মধ্যে গত আগস্ট মাসে ইনস্টিটিউট অব সাপ্লাই ম্যানেজমেন্টের সরকারি আমেরিকান সূচক সংকোচন হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। নতুন কার্যাদেশের ভবিষ্যৎ কমপোনেন্টস এই সংকোচন সৃষ্টি করেছে। এই সংকোচন খুব তাড়াতাড়ি দূর হবে না।
গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন কর বসানো হয়েছে চীনা পণ্যের ওপর। তা সমস্যাকে আরো জটিল করবে বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা। এসব ডাটার মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চীনা পণ্যের ওপর ৩০ ভাগ করের পরও ১৫ ভাগ কর, যা পূর্বে বসানো হয়েছিল, তা এখনো সংকোচনের ডাটাতে যুক্ত হয়নি। ডিসেম্বরে পুরো আরোপিত কর বাস্তবায়িত হলে ১২ শতাংশের ওপর কর ২৪ শতাংশে উন্নীত হবে আগামী বছরের শুরুতে। ২০১৮ সালে ট্রাম্পের করারোপের পূর্বে তা ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। ভোগ্যপণ্য থেকে লাক্সারি পণ্য, সবকিছুতেই ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাতে। চার-পঞ্চমাংশ কর বেড়েছে আমেরিকায়, যা আমেরিকানদের চীনের সামগ্রী আনতে গত জুলাই মাস থেকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এই বর্ধিত করের বোঝা আমেরিকার ভোক্তারা এখন থেকে টের পাবে। ২০১২ সালের পর করের কারণে পণ্যের ওপর ভোক্তার আগ্রহ গত আগস্ট মাস থেকে কমেছে, তা ব্যয় সংকোচনে প্রতীয়মান হয়েছে। আমেরিকায় চীনের পণ্যের চাহিদা করের কারণে কমলে তা বিশ্ব অর্থনীতিতে সাপ্লাই চেইনে অনুরণন তুলবে। তা বাংলাদেশেও অনুভ‚ত হতে পারে, যখন চীনের অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হবে। তারপর আফ্রিকা ও অন্যান্য চীনানির্ভর অর্থনীতিতেও এর প্রভাব অনিবার্য। এখন সতর্ক করার সময় নয় বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। তারা ভাবেন, সেন্ট্রাল ব্যাংকসমূহ সঠিকভাবে সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট। আর সে কারণে ট্রাম্পের বিরাগভাজন হয়েছেন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তার পরও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক এ মাসে আবার সুদের হার কমাবে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকসমূহ ২০১৬ সালের পর, আগামী সপ্তাহ থেকে, এবার প্রথম সুদের হার কমাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ঋণ গ্রহণের খরচ কমালে, অর্থাৎ সুদ কমালে, তা চাহিদা বাড়াতে পারে। কিন্তু তা পুরোপুরি সরবরাহ চেইনে যে বিভ্রাট ঘটেছে, বাণিজ্য সংঘর্ষে তা কাটবে না। সরকারকেও আর্থিক সুবিধা দিতে হবে। এই আইডিয়া ইউরোপে কিছুটা চাঙা হাওয়া দিতে শুরু করেছে।
বিশেষ করে যখন জার্মানিতে মন্দা শুরু হয়েছে, ইউরোপে এখন সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছে স্টিমুলাস প্যাকেজ চালু করার কথা। ইউরোপীয় কমিশন আওয়াজ তুলেছে, কিন্তু করের বোঝা বাড়ার সমস্যাকে সামনে রেখে এ ধরনের সাপোর্ট দ্রুত কাজে আসবে না।
যেমন এশিয়ার অন্যান্য দেশের হিসাব না করলেও বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ হোঁচট খেতে পারে। কারণ, বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পে পুনর্ভরণযোগ্য অর্থ জোগান সহজ নাও হতে পারে।