লিখেছেন নাঈম আহমেদ
বিশ্বের নবীনতম দেশের নাম দক্ষিণ সুদান। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর ২০০৫ সালে স্বায়ত্বশাসন; অতঃপর ২০১১ সালের ৯ই জুলাই গণভোটের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অর্জন করে আফ্রিকার এই দেশটি। সুদান থেকে আলাদা হয়ে দেশটি তার প্রতিশ্রুত শান্তির পথে যাত্রা করছে ঠিকই, কিন্তু দেশভাগের ফলে উভয় দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যে যাত্রাভঙ্গ বা ছন্দপতন ঘটেছে তা অবর্ণনীয়। স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে উভয় দেশের জনগোষ্ঠীর বিপুল পরিমাণ রক্ত ঝরেছে। জাতিসংঘের হিসেব মতে, দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে উভয় দেশ থেকে প্রায় ২০ লাখ মানুষ স্থানচ্যুত ও প্রায় ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। যুদ্ধ ও দেশভাগের এই প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপরেও।
তবে এদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল দক্ষিণ সুদানের সেন্ট্রাল ইকুয়েটরিয়া অঞ্চলে বসবাসরত মুন্ডারি আদিবাসীরা। তারা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। তাদের সকল ভাবনা তাদের গৃহপালিত পশুদের নিয়ে। সুদানে যখন চূড়ান্ত পর্যায়ের গৃহযুদ্ধ ও দাঙ্গা চলে, তখনো তাদের তর্ক সীমাবদ্ধ ছিল ‘কারা তাদের পশুদের নিরাপত্তার জন্য ভালো হবে’ এই বিষয়ের মধ্যে। দেশভাগের ভৌগলিক বাস্তবতায় তারা আজ দক্ষিণ সুদানের অধিবাসী।
মুন্ডারি আদিবাসীদের প্রধান পরিচয় হলো তারা রাখাল সম্প্রদায়। গরু তাদের প্রধান সম্পদ। গরু লালন-পালনকে কেন্দ্র করেই তাদের জীবন আবর্তিত হয়। সুউচ্চ গরুদের পাহাড়ায় তাদের সর্বদা বন্দুক হাতে পাহারা দিতে দেখা যায়। তাদের আবাসভূমি পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্বণা করতে গিয়ে সিএনএন-এর বিশিষ্ট ফিচার সাংবাদিক থমাস লিখেছেন,
আমি তাদের দেখে প্রথমে বেশ অবাক হয়েছি। তারা রাখাল হিসেবে বিশ্বের অন্য সব আদিবাসীদের থেকে অধিক পরিশ্রমী। তারা রাজধানী জুবার উত্তরে নাইল নদীর তীরে বসবাস করে। তাদের জীবনচক্র গবাদি পশু লালন-পালনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।
তবে তাদের পালিত গরুর জাত অনেক উন্নত ও আর্থিক বিবেচনায় বেশ দামি। বিশেষত তারা ‘আনখল-ওয়াতুসি’ নামের এক প্রজাতির গরু লালন-পালন করে থাকেন, যাকে ‘গবাদি পশুর রাজা’ বলে অবিহিত করা হয়। এই গরু আট ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে; যা আমাদের দেশের গরুর বিবেচনায় বৃহদাকৃতির; গড়ে প্রতিটি গরুর মূল্য ৫০০ মার্কিন ডলার। আফ্রিকার কোনো অঞ্চলের গবাদি পশুর এই পরিসংখ্যান অনেকটা অবাক করার মতো। ফলে এই সম্পদ মুন্ডারিদের কাছে স্বর্ণের চেয়েও দামি সম্পদে রূপান্তরিত হয়েছে।
কিন্তু সম্পদের মূল্য যত বেশি হয়, মালিকদের ঝুঁকিও তত বাড়তে থাকে; আর সেটা যদি কোনো আদিবাসী সম্প্রদায়ের সম্পদ, তাহলে তো কথাই নেই- কেননা বিশ্বের অধিকাংশ আদিবাসী জনগোষ্ঠী পার্শ্ববর্তী সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের দ্বারা নির্মম বৈষম্যের স্বীকার হন; মুন্ডারিদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তাই রাত জেগে সম্পদ পাহারা দেয়া তাদের অভ্যাস কিংবা দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। আনাড়ি রাখালদের বন্দুক হাতে দিন-রাত গবাদিপশু পাহারা দিতে দেখা যায়। তবুও কখনো কখনো তাদের গবাদিপশু চুরি হয়ে যায়। স্থানীয় প্রভাবশালী দুষ্টচক্র এই কাজ করে থাকে। এ যেন এক দীর্ঘশ্বাসের গল্প; যার নেই কোনো বিচার, নেই কোনো সম্পদ ফিরে পাওয়ার কিংবা ক্ষতিপূরণের আশ্বাস।
প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিক তারিক যায়িদি মুন্ডারিদের জীবনযাপন অবলোকন ও পর্যবেক্ষণ করতে তাদের সাথে দীর্ঘদিন বসবাস করেছেন। এ সময় তিনি মুন্ডারিদের অসাধারণ কিছু মুহূর্ত তার ক্যামেরায় ধারণ করেছেন। যায়িদি শুধু মুন্ডারি নয়- আফ্রিকার প্রায় ৩০টি আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের জীবনবোধ ও সংস্কৃতি তার ক্যামেরায় ধারণ করেছেন এবং তাদের নিয়ে গবেষণাপূর্ণ ডকুমেন্টারি তৈরি করেছেন। কিন্তু তিনি কখনো, কোথাও পশুদের সাথে মানুষের এমন ঘনিষ্ঠপূর্ণ সম্পর্ক অবলোকন করেননি; বিশেষত মুন্ডারি পুরুষদের সাথে তাদের পালিত গরুদের সম্পর্ক অবাক করার মতো। যায়িদি বলেন,
মুন্ডারি রাখালদের সাথে গবাদিপশুর সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর ও আত্মিক। তাদের কাছে গবাদিপশুর গুরুত্ব বলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এই পশুরাই তাদের জীবনের সবকিছু।
যায়িদি তার ধারণকৃত কিছু ছবির ব্যাখ্য দিতে গিয়ে বলেন-
প্রায় সকল পুরুষই আমাকে দেখে তাদের পছন্দের পশুর সাথে ছবি তুলতে চেয়েছে। এমনকি তাদের স্ত্রী ও শিশুরাও তাদের প্রিয় পশুর সাথে ছবি তুলতে চেয়েছে।
এর মধ্যে ‘আনখল-ওয়াতুসি’ প্রজাতির গরু মুন্ডারিদের কাছে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ গবাদি পশু। অনেক সময় এই প্রজাতির গরুরা তাদের উপাসনার লক্ষ্যবস্তুতেও পরিণত হয়। সাধারণত মাংস খাওয়ার জন্য তারা তাদের গরুদের হত্যা করে না। যদিও এর বাজারমূল্য অত্যন্ত চড়া হওয়ার কারণে অধিকাংশ মুন্ডারি সদস্যের কাছে গরুর মাংস খাওয়া বিলাসিতাপূর্ণ ব্যাপার মাত্র। তবে গরু তাদের হাঁটাচলার সঙ্গী; পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্য; একটি মহিমান্বিত সম্পদ; রোগ প্রতিষেধক; সর্বোপরি একজন উত্তম বন্ধু। ফলশ্রুতিতে গরু শুধুমাত্র তাদের সম্পদ নয়, জীবন পরিচালনার একটি পথও বটে।
যায়িদির বর্ণনামতে, মুন্ডারিরা আকৃতিতে লম্বা ও পেশীবহুল স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে থাকে। যায়িদি বলেন,
তাদেরকে দেখতে ‘বডিবিল্ডারের’ মতো মনে হয়। কিন্তু তাদের খাদ্যাভ্যাস খুব সাধারণ, তবে নিয়মতান্ত্রিক। তারা প্রচুর পরিমাণ দুধ ও দই খেয়ে থাকেন। এটাই তাদের সুস্বাস্থ্যের গোপন রহস্য।
তারা গরুর প্রস্রাবও পান করে থাকেন। গরু যখন প্রস্রাব করে, মুন্ডারি পুরুষরা তখন নুইয়ে পড়ে তা মুখে ধারণ করেন। তাদের ভাষ্যমতে, এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং এতে থাকা অ্যামোনিয়া তাদের চুলকে কমলা রঙে রাঙিয়ে তুলতে সাহায্য করে।
এছাড়া গরুর গোবর তারা রান্নার কাজে ব্যবহার করেন। এতে পীচ-রঙের সুন্দর ছাই উৎপাদন হয়। এই ছাইকে তারা জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। রোদের তীব্রতা থেকে ত্বক সুরক্ষিত রাখতে তারা এই ছাই ব্যবহার করে থাকেন।
যায়িদি জানান, তাদের পালিত ‘আনখল-ওয়াতুসি’ বিশ্বের সবচেয়ে আদুরে স্বভাবের গরু হিসেবে পরিচিত। ফলে তাদের সেবা-যত্ন অনেক বেশি করতে হয়। মুন্ডারি রাখালরা প্রতিদিন দুবার করে তাদের শরীর মালিশ করে দেন। গোবরের ছাই টেলকম পাউডারের মতো তাদের দেহে মাখিয়ে দেন, যা তাদের ক্ষতিকর জীবাণু থেকে সুরক্ষিত রাখে। তাদের ত্বক পরিস্কার করতে এবং থাকার ঘরেও এই ছাই বিছিয়ে দেয়া হয়। মশাদের হাত থেকে রক্ষা করতে তাদের ঘরের চারিধারে নান্দনিক উপায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া মুন্ডারিরা গবাদি পশুর সাথেই ঘুমান। যায়িদি বলেন,
আক্ষরিক অর্থে তারা তাদের পশুদের থেকে মাত্র দুই ফুট দূরে রাত্রিযাপন করেন এবং তাদের মধ্য থেকে একজন সেখানে বন্দুক হাতে গবাদি পশুর পাহারা দেন। অকারণে তারা পশুর এত নিকটে রাত্রিযাপন করেন না; পশুর ডাক ও খচমচ আওয়াজ তাদের জন্য একটি বড় ব্যাপার। যেন এই আওয়াজ ছাড়া তারা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন না।
গবাদি পশু মুন্ডারিদের কাছে অর্থ-সম্পদ ও মর্যাদার প্রতীকও বটে। তাদের পারিবারিক প্রথায় যৌতুক হিসেবে গবাদি পশুর গুরুত্ব সর্বাধিক। গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলে হাজার হাজার পুরুষ নববধূর সন্ধানে দক্ষিণ সুদানে ফিরে আসে। তখন একটি জটিলতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যাদের অধিক গবাদি পশু আছে, তারা এর বিনিময়ে ‘নববধূ ক্রয়ের’ মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা ও উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। একপর্যায়ে তা ভয়ানক দাঙ্গার সৃষ্টি করে।
এই দাঙ্গা ছিল মুন্ডারিদের জন্য আত্মঘাতি। যুদ্ধের রেশ শেষ হতে না হতেই এই ধাক্কা ছিল নির্মম ও পীড়াদায়ক। যদিও দাঙ্গার চেয়ে গৃহযুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব ছিল বহুমুখী ও ব্যাপক; এতে তাদের গবাদি পশুর চারণভূমি পরিণত হয়েছিল ভয়ানক এক জুয়ার আসরে। এ কারণে মুন্ডারিরা বাধ্য হয়ে তখন নাইল নদীর বুকে গড়ে ওঠা ছোট একটি দ্বীপে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এখন সেখানেই তারা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এটি তাদের জন্য এক দ্বিমুখী সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে। যায়িদি বলেন,
যুদ্ধ মুন্ডারি জনগোষ্ঠীকে বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। তারা নিরাপত্তার ভয়ে শহরে আসতে পারছেন না। তাদের বর্তমান আবাসস্থলের অবস্থা খুবই নাজুক। ফলে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও প্রচণ্ডভাবে ব্যহত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন,
যুদ্ধ থেকে মুন্ডারিদের বিশেষ কোনো অর্জন নেই। যুদ্ধে তাদের কোনো অংশগ্রহণও ছিল না। তাদের বন্দুক কাউকে হত্যা করে না, কিন্তু তাদের পালিত পশুদের নিরাপত্তা প্রদান করে।
সর্বোপরি, মুন্ডারিরা তাদের পালিত পশুদের অত্যন্ত সুন্দরভাবে সেবা-যত্ন করে থাকেন এবং জীবনের বিনিময় হলেও তা তারা রক্ষা করতে চান। বাণিজ্যিক দিক বাদ দিলেও পশুদের প্রতি তাদের গভীর প্রেম বিশ্বের অন্যান্য রাখালশ্রেণীর তুলনায় অনেক উচ্চাঙ্গে। তাই পৃথিবীও এই রাখালদের গভীর প্রেমে আবদ্ধ করুক- এটাই আমাদের কামনা।