লিখেছেন গোপেন দেব
ফ্লোরিডা থেকে এসেছিলেন মাইনুল খান নীরু – সপরিবারে। একঝাঁক পুরোনো বন্ধুকে পেয়ে আবেগ আটকে রাখতে পারেন নি তিনি।সজল হয়ে ওঠে চোখ তাঁর।একের পর এক শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখছিলেন বন্ধুদের।বললেন, আমি এজীবনে আবার একসাথে তোমাদের সাথে মিলবো ভাবতে পারিনি। যখন জানলাম এই মিলনোৎসবের কথা ছুটে এলাম সুদূর আমেরিকা থেকে।এরপর পরিবারের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন সবার সাথে।শিল্পী রনি প্রেন্টিস এসেছিলেন টরন্টো থেকে স্ত্রী ব্যারিস্টার চয়নিকা দত্তকে নিয়ে।বললেন, চেয়ে চেয়ে দেখছি সেই পুরোনো মুখগুলো আর ভাবছি কোথায় নিয়ে গেল সময় আমাদের।গানের কলি গুনগুন করে তিনি বলেন “…স্মৃতিটুকু আছে জেগে বেদনা দিতে,আশার বকুল সেথা পথে ঝরিতে”।এরকম আবেগ তাড়নার অনুপম এক স্মৃতি কাতরতায় নিমজ্জিত ছিলেন একটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে প্রায় আড়াই শতাধিক প্রবাসী। নাচ গান, হৈ হুল্লোড়, আড্ডাবাজি আর স্মৃতির ভেলায় চড়ে বিরামহীন আনন্দ যজ্ঞে মশগুল ছিলেন তারা। গত দুটি দিন কানাডার পুরোনো বাংলাদেশি অভিবাসীরা অভূতপূর্ব এক মিলনমেলায় সমবেত হয়েছিলেন। ‘ফিরে দেখা’ নামে আয়োজিত এই মিলনমেলাটি মূলত ১৯৮২- ৮৩ সালে মন্ট্রিয়লে আগত বাংলাদেশিদের একটি পুনর্মিলনী উৎসব।গত শুক্র ও শনিবার ( ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর ) এটি অনুষ্ঠিত হয় মন্ট্রিয়লের পাঁচ তারকা হোটেল ম্যারিয়টে।মন্ট্রিয়ল ছাড়াও কানাডা ও আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে প্রবাসীরা সপরিবারে আসেন উৎসবে যোগ দিতে।শুক্রবার বিকেল থেকে শুরু হয় অনুষ্ঠান,শনিবার গভীর রাত পর্যন্ত চলে প্রায় একটানা।ছত্রিশ বছর আগে স্বদেশ ছেড়ে আসা যুবকরা এখন অনেকেই দাদা-নানা হয়েছেন।মন্ট্রিয়লেই তারা কাটিয়েছেন জীবনের প্রথম প্রবাস কাল।এরপর অনেকেই কানাডা,আমেরিকার বিভিন্ন শহরে আবাস গড়েন।কিন্তু প্রবাসে জীবনের প্রথম পা রাখা মাটির কথা,বন্ধুদের কথা এখনো সমান অনুভবে তাড়িত করে তাদের।তাইতো তারা ছুটে এসেছিলেন স্মৃতির শহর মন্ট্রিয়লে পুরোনো সাথীদের নিয়ে একসাথে গল্প আড্ডায় মিলিত হতে।মিলনমেলায় সবাই আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছিলেন।পুরোনো স্মৃতির ডালা মেলে ধরে আড্ডা হয় অফুরন্ত।
শুক্রবার বিকেলে হোটেলের একটি কনফারেন্স হলে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় উৎসবের। প্রথমে স্বাগত বক্তব্য দেন কনভেনর ব্যবসায়ী শামীমুল হাসান।তিনি উৎসবকে সফল করে তোলার জন্যে সহযোগিতাকারী সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।তিনি বলেন, এরকম একটি অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে দীর্ঘদিন থেকে তাগিদ দিচ্ছিলেন মাসুম রহমান। অবশেষে সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এটি সফল হলো। এই অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে আমাদের নতুন প্র্রজন্মের মধ্যেও পারষ্পাারিক সৌহাদ্য গড়ে উঠবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।ঐদিনই স্যুভেনিরের মোড়ক উম্মোচন করা হয়।স্যুভেনির সম্পাদক রুমু ইসলামকে সাথে নিয়ে এটি উম্মোচন করেন কনভেনর শামীমুল হাসান।সাংষ্কৃতিক পর্বে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী তপন চৌধুরী।মধ্যরাত পর্যন্ত চলে এই অনুষ্ঠান।
দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচিতে ছিল,স্মৃতি রোমন্তনে অপেন-ডিসকাস পর্ব, ফটোসেশন, সিটিং ডিনার, স্লাইড শো, সঙ্গীতানুষ্ঠান ও সবশেষে আনন্দ-নৃত্য। হোটেলের আলো ঝলমল বলরুমে আয়োজন করা হয় মূল অনুষ্ঠান।স্মৃতিচারন পর্বে সবাই পুরোনো দিনের আনন্দ-বেদনার কথা প্রাণ খোলে বন্ধুদের শোনান।এপর্বে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েও তাদের এখনকার অনুভূতি ব্যক্ত করেন।এই পর্বটির মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন মাসুম রহমান।স্মৃতিচারন ছাড়াও উৎসব আয়োজনের বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেকেই আলোচনা করেন।তাঁদের মধ্যে উৎসবের অন্যতম উদ্যোক্তা মাসুম রহমান, ফয়সল আহমেদ চৌধুরী,সাংষ্কৃতিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজী শহীদ, স্যুভেনিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত রুমু ইসলাম, আলী হোসেন খান, রেজাউল করিম তালুকদার, ব্যারিস্টার চয়নিকা দত্ত, সবুর শিকদার,আলম মোড়ল,রশীদ খান,হায়দরী বাবু, জাফর ইমাম খান সিজার, মোস্তাক আহমেদ,নীরু খান প্রমুখ।উৎসবের আয়-ব্যয়ের হিসাব সংক্রান্ত বক্তব্য দেন এর দায়িত্বে থাকা বিজন সাহা। অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী তনিমা হাদি, শাহ মাহবুব,রনি প্রেন্টিস,অনুজা দত্ত প্রমুখ।শিল্পীদের সাথে সুর মিলিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলে নেচে-গেয়ে পুরো হল মাতিয়ে রাখেন।দুদিনের অনুষ্ঠানেরই প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় ছিলেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও সাবরিনা উল্লা।
উৎসবে সম্মিলিত প্রাত:রাশ সহ স্ন্যাকস, মধ্যাহ্নভোজ, নৈশভোজে ছিল গল্প আড্ডা আর সীমাহীন হাসি তামাসা।শনিবার দিবাগত ভোররাতে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয় সকল অনুষ্ঠান। রোববার সকালে প্রাত:রাশ শেষে সবাই যখন ফিরে যাচ্ছিলেন আপন গন্তব্যে তখন আবার আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন সবাই।এই দুদিন এক পরিবারের সদস্যের মতো একত্রে থাকা পরবাসী এই মানুষদের কেউ কেউ আক্ষেপ করেন, এত তাড়াতড়ি শেষ হয় গেলো দুটি দিন।দুদিন আনন্দ-কোলাহলের আবেশে আচ্ছন্নের পর মিলনমেলা যখন ভাঙ্গলো যেন বেদনার সুর বেজে উঠলো প্রতিটি প্রাণে।অনেকটাই নীরবে পরষ্পরের কুশল কামনা করে আবার কখনো দেখা হওয়ার প্রত্যাশায় হোটেল ত্যাগ করেন তাঁরা।
ছবি কৃতজ্ঞতা : সিবিএনএ