লিখেছেন সুদীপ্ত সালাম
ফটোগ্রাফি ফাইন আর্টের আধুনিকতম সংযোজন। কিন্তু শুরু দিকে ফটোগ্রাফি অনেক অবহেলার শিকার হয়েছে। অনেকেই এই মাধ্যমটিকে ফাইন আর্ট হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। অনেক আন্দোলন, অভিযান ও পরিশ্রমের পর আজ ফটোগ্রাফি স্বকীয়তা নিয়ে আর্টের আসনে আসীন। ফটোগ্রাফির আজকে অবস্থানের পেছনে বহু আলোকচিত্রীর পরিশ্রম ও মেধা জড়িয়ে আছে। সেই ধীমান মানুষগুলোর নাম আমাদের অনেকের কাছে অপরিচিত।
২৩ ডিসেম্বর আলোকচিত্রকলার তেমনি এক মহান শিল্পীর জন্মবার্ষিকী। তার নাম- ইউসুফ কার্শ। তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পোরট্রেট আলোকচিত্রী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফটোগ্রাফিক পোরট্রেচার যে কতটা শৈল্পিক হতে পারে তা ইউসুফ কার্শ প্রথম অনুধাবন করান। তার তোলা এক একটি পোরট্রেট আজ এক একটি শিল্পকর্ম। তার ছবির তোলার মুনশিয়ান এবং ছবির সাবজেক্ট আজো অনুপ্রেরণা যোগায়।
তুরস্কের (তৎকালীন আরমানি) মারদিন শহরে ১৯০৮ সালের তিনি এক ২৩ ডিসেম্বর খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আমসিহ্ কাশ্ল মার নাম বাহিয়া। বড় হয়েছেন যুদ্ধ ও হত্যাযজ্ঞের মধ্যে। তিনি লিখেছেন, ‘অল্প বয়সে আরমানি গণহত্যা দেখেছি, নিজের বোনকে না খেয়ে মরতে দেখেছি, স্বজনদের মরতে দেখেছি এবং গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেরিয়েছি।’ মাত্র ১৬ বছর বয়সে (১৯২৪) পরিবারের সঙ্গে প্রাণের ভয়ে সিরিয়ায় পাড়ি জমান। এর দুবছর পর তাকে তার কানাডা নিবাসী মামা জর্জ নাকাশের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মামা ছিলেন আলোকচিত্রী। পড়ালেখার পাশাপাশি স্টুডিওতে মামাকে সাহায্য করা শুরু হয়। মামা তাঁর মেধা ও প্রতিভা আঁচ করতে পারেন। ১৯২৮ সালে তিনি ইউসুফকে বোস্টনের বিখ্যাত পোরট্রেট আলোকচিত্রী জন গারোর কাছে ফটোগ্রাফি শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠান। দীক্ষা শেষে ৪ বছর পর ইউসুফ কানাডায় ফেরেন। ওন্টারিওতে নিজের একটি স্টুডিও দেন। কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ম্যাকেনজি কিং ইউসুফের কাজে এতোটাই আকৃষ্ট হন যে যারাই তার সঙ্গে দেখা করতেন ইউসুফকে তিনি তাদের ছবি তোলার সুযোগ করে দিতেন। ১৯৩৫ সালে তিনি কানাডার সরকারি আলোকচিত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। বড় বড় মানুষের ছবি তোলা ইউসুফ কার্শের নেশায় পরিণত হয়ে গেল। কিন্তু তার জীবনের প্রথম বড় সুযোগটি আসে ১৯৪১ সালের ৩০ ডিসেম্বর, কানাডা সফরে আসা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল পোরট্রেট তোলেন। চার্চিলের সে ছবি ইউসুফ কার্শকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। এটি ইতিহাসের অন্যতম বহুল ব্যবহৃত ফটোগ্রাফিক পোরট্রেট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। আলোকচিত্রী ইউসুফ কার্শের যাত্রাটা এভাবেই শুরু হয়। তার সম্পর্কে চার্চিল মজা করে বলেছিলেন , ‘ছবি তোলার জন্য তুমি একটি উত্তেজিত সিংহকেও শান্ত করতে পারবে।’ জন্মভূমি থেকে বিতারিত এই আলোকচিত্রী কানাডার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে ইউসুফ কার্শ রাষ্ট্রীয় সম্মানসূচক ‘অর্ডার অব কানাডা’ পান। ১৯৩৯ সালে বিয়ে করেছিলেন অভিনেত্রী গোটিয়া সলেন্জকে। ১৯৬১ সালে সলেন্জ ক্যান্সারে ভুগে মারা যান। ইউসুফ কার্শ ১৯৬২ সালে এস্ট্রেলিটা মারিয়া নাকবারকে বিয়ে করেন।
দীর্ঘ ৬৫ বছর ছবি তুলেছেন। তার সময়কার বহু বিখ্যাত ব্যক্তির ছবি তুলেছেন। তার ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য নিজস্ব আলোক ব্যবস্থা। ইউসুফ কার্শকে স্টুডিও লাইটিং-এর মাস্টার বলা হতো। লার্জ ফরম্যাটের (৮X১২ ইঞ্চি) ভিউ ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন। আলো-আঁধারের নিপুন কাজ তার ছবিগুলোকে করেছে কালজয়ী। তিনি ছবিকে জীবন্ত করে তুলতেন। মানুষের চরিত্র বুঝতেন এবং সে চরিত্রকে অনবদ্যভাবে পোরট্রেচারে ফুটিয়ে তুলতেন। এ প্রসঙ্গে তার একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘মানুষের চরিত্র আলোকচিত্রের মতোই, যা অন্ধকারে গড়ে ওঠে।’ ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য সানডে টাইমস’ একবার লিখেছিল, ‘বিখ্যাত ব্যক্তিরা অমর হওয়ার আকাঙ্খা থেকে ইউসুফ কার্শকে ডাকতেন।’ সত্যিই তাই। তার তোলা ছবিতে বিখ্যাত ব্যক্তিরা নতুনভাবে ধরা পড়তেন। ‘কার্শ পোর্টফোলিও’ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক নর-নারীর মধ্যে কিছু গোপন বিষয় থাকে, সেই গোপনীয়তা বের করে আনার চেষ্টা করা আলোকচিত্রী হিসেবে আমার দায়িত্ব।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘যারা মনের দিক থেকে মহান, চিন্তার দিক থেকে মহান, চেতনার দিক থেকে মহান তাদের ছবি তুলতে পারায় আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই।’ বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি দিয়ে তার ঝুলি পরিপূর্ণ, যা ঈর্ষনীয়। উইনস্টন চার্চিল, লর্ড অ্যালানব্রুক, নেলসন মান্ডেলা, জনএফ কেনেডি, এডওয়ার্ড কেনেডি, জওহরলাল নেহরু, জুলফিকার আলি ভুট্টো, ডুইট আইজেনহাওয়ার, ইন্দিরা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং, ফিদেল কাস্ট্রো, কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী পিয়ের টুডো, চীনের ম্যাডাম চিয়াং কাই-শেক, মার্কিন জেনারেল পারশিং, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, মাদার তেরেসা, হেলেন কেলার, পরিবেশবাদী গ্রে আউল, লেখক জর্জ বার্নার্ড শ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, বার্ট্রান্ড রাসেল, কবি ডব্লিউএইচ অডেন, রবার্ট ফ্রস্ট, চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, এন্ডি ওয়ারহোল, চলচ্চিত্র নির্মাতা আলফ্রিড হিচকক, ওয়াল্ট ডিজনি, মুষ্ঠিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী, অভিনেত্রী সোফিয়া লরেন, অড্রি হেপবার্ন, রুথ ড্রেপার, গ্রেস কেলি, জোন ক্রোফোর্ড, সঙ্গীতশিল্পী জাঁ সিবেলিউস, মারিয়ান আন্ডারসন, জোন বিজ, পল রবসন, অভিনেতা হামফ্রি বোগার্ট, ক্লার্ক গ্যাবল, পিটার লোর, লরেন্স ওলিভার, ভাস্কর আলেকজেন্ডার কালডার, স্থপতি ফ্র্যাঙ্ক লয়েড রাইট, কার্টুনশিল্পী চাক জোন্স, মনোবিজ্ঞানী কার্ল ইয়ুং প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিত্বকে ক্যামেরাবন্দি করেছেন।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফটোগ্রাফার হিসেবেও তার খ্যাতি ছিল। মোটরগাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফোর্ড অব কানাডা লিমিটেড এবং অ্যাটলাস স্টিল লিমিটেডের মতো প্রতিষ্ঠানের কাজ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফটোগ্রাফির অধ্যাপক হিসেবেও অনেকদিন দায়িত্ব পালন (১৯৬৭-১৯৬৯) করেছেন। বোস্টনের এমারসন কলেজ-এর অতিথি অধ্যাপক ছিলেন (১৯৭৪ সাল পর্যন্ত)।
তার তোলা ছবি বিশ্বের বহু জাদুঘর ও গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে, তন্মধ্যে- ন্যাশনাল গ্যালারি অব কানাডা, নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, জর্জ ইস্টম্যান হাউস ইন্টারন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ফটোগ্রাফি অ্যান্ড ফিল্ম, ন্যাশনাল লাইবেরি অব ফ্রান্স, লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল পোরট্রেট গ্যালারি, ন্যাশনাল পোরট্রেট গ্যালারি অব অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। লাইব্রেরি অ্যান্ড আর্কাইভস কানাডা-এ ইউসুফ কার্শের তোলা সকল ছবি, নেগেটিভ ও ডকুমেন্ট সংরক্ষিত আছে। তার ছবি তোলার সরঞ্জামগুলো কানাডা সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মিউজিয়াম-এ দান করে দেয়া হয়েছে। তার তোলা ছবি নিয়ে মোট ১৫টি অ্যালবাম প্রকাশিত। তন্মধ্যে ফেসেস অব ডেসটিনি (১৯৪৬), কার্শ পোর্টফোলিও (১৯৬৭), ফেসেস অব আওয়ার টাইম (১৯৭১), কার্শ: পোরট্রেটস (১৯৭৬), কার্শ: কানাডিয়ানস্ (১৯৭৮), কার্শ: আমেরিকান লেজেন্ডস্ (১৯৯২) ইত্যাদি বিশিষ্ট। আত্মজীবনী- ইন সার্চ অব গ্রেটনেস(১৯৬২)।
বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত (বিংশ শতাব্দীর) ১শ ব্যক্তির ছবি সম্বলিত গ্রন্থ ‘ইন্টারন্যাশনাল হু’স হু ২০০০’ প্রকাশিত হয়। তার ৫১টি ছবি ইউসুফ কার্শের তোলা। তার ছবি ‘লাইফ’ ও ‘টাইম’ মতো ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ হয়েছে। ২০০৯ সালে কানাডা ‘কার্শ উৎসব’ পালন করেছে। তার শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কানাডার ডাক বিভাগ তার নিজের এবং তার তোলা ছবি নিয়ে ৩টি ডাক টিকেট অবমুক্ত করে।২০০৫ সাল থেকে তার নামে ‘কার্শ প্রাইজ’ শীর্ষক ফটোগ্রাফিবিষয়ক পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। শতাব্দীর এই মহান আলোকচিত্রীকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন জোসেফ হিলেল (কার্শ ইজ হিস্টরি)।
নব্বইয়ের দশকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে যান। ২০০২ সালের ১৩ জুলাই সেখানেই এই কিংবদন্তি আলোকচিত্রী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কানাডার নটর ডেম সমাধিক্ষেত্রে তাকে সমাহিত করা হয়।
বিখ্যাত ও আলোচিত ব্যক্তিদের ছবি অনেকেই তুলেছেন, কিন্তু তার প্রায় প্রতিটি ছবি বিশ্বজুড়ে যে পর্যায়ে প্রশংসিত ও ব্যবহৃত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে সে পর্যায়ে কারো ছবি পৌছাতে পারেনি। বলা হয়ে থাকে যে, তার তোলা সাদা-কালো পোরট্রেচারগুলো বিংশ শতাব্দীর পরিচয় বহন করে। বিখ্যাত মানুষের ছবি তুলে নিজেও বিখ্যাত মানুষ হয়ে ওঠার কাহিনী বিরল, আর ইউসুফ কার্শ সে ক্ষেত্রে অদ্বিতীয়। তার ছবি তোলার ধরনই ছিল ভিন্ন, তিনি বলতেন, ‘ক্যামেরার শাটার খোলার আগে দেখুন, ভাবুন। কেননা আপনার মন ও মস্তিষ্কই ক্যামেরার আসল লেন্স।’ এই বিশ্বাসই তার ছবিগুলোকে করেছে অনন্য।