ইউক্রেন থেকে ফ্রান্স যাওয়ার পথে নিখোঁজ সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার কারিকোনা গ্রামের সমশাদ আলীর পুত্র ও ইস্টার্ন ব্যাংক বিশ্বনাথ শাখার সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন আহমদের (৩৫) লাশ স্লোভাকিয়ার একটি জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর স্লোভাকিয়ার স্টারিনা জঙ্গল (দুর্গম পাহাড়ি এলাকা) থেকে ফরিদের মরহেদ উদ্ধার করে সেদেশের পুলিশ। তিনি গত ২ সেপ্টেম্বর দালাল ও ৫ সঙ্গীর সাথে ইউক্রেন থেকে ফ্রান্স যাওয়ার পথিমধ্যে স্লোভাকিয়ার জঙ্গলে নিখোঁজ হন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ফরিদ উদ্দিন আহমদের ফুফাতো ভাই যুক্তরাজ্য প্রবাসী আবু বক্কর স্থানীয় সাংবাদিকদের মোবাইল ফোনে জানান, গত ৯ সেপ্টেম্বর স্লোভাকিয়ার ‘জওজে টিভি’র বরাত দিয়ে সেদেশের ‘নোভেনি ডট এসকে’ নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংবাদটি প্রচার করে। প্রকাশিত ওই সংবাদে উল্লেখ করা হয়, ‘আনুমানিক ৩০ বছর বয়সী ইউরোপিয়ান নাগরিক নন, এমন একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে স্লোওভাকিয়ার স্টারিনা জঙ্গলে একজন পর্যটক দেখতে পান। তাৎক্ষণিক তিনি উদ্ধারকারী ও পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেন। এরপর পুলিশ ও উদ্ধারকারী দল লাশ উদ্ধার করে।’
ওই সংবাদটি নিখোঁজ ফরিদ উদ্দিনের ব্রিটেনে থাকা স্বজনরা দেখতে পান। তখন স্লোভাকিয়ার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তারা যোগাযোগ করেন এবং ই-মেইলে ফরিদের তথ্য পুলিশকে প্রদান করেন। উদ্ধারকৃত মরদেহটি নিখোঁজ ফরিদের হিসেবে পুলিশ প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয় এবং স্লোভাকিয়া গিয়ে লাশ শনাক্তের জন্য ফরিদের স্বজনদের বলে পুলিশ। এরপর ফরিদের চাচা আলকাছ আলী (আওলাদ) বৃটিশ সরকারের অনুমতি নিয়ে বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুজন ব্রিটিশ নাগরিককে সঙ্গে করে যুক্তরাজ্য থেকে স্লোভাকিয়ায় যান। তারা সেখানে পৌঁছে কৌচি শহরের একটি মর্গে গিয়ে ফরিদ উদ্দিন আহমদের লাশ শনাক্ত করেন। লাশ বাংলাদেশে আনার জন্য প্রস্তুতি চলছে বলে জানান আবু বক্কর। তবে কীভাবে ফরিদ উদ্দিন আহমদের মৃত্যু হয়েছে এর সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি।
শুক্রবার সকালে সরেজমিন নিহত ফরিদ উদ্দিন আহমদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিখোঁজ ফরিদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর থেকে পরিবারের সদস্যদের মাঝে বিরাজ করছে আহাজারীতে। সকলের কান্নাকাটিতে ভারি হয়ে উঠেছে আশপাশ পরিবেশ। পরিবারের সদস্যদেরকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনরা। মৃত্যুর সংবাদটি এলাকার বিভিন্ন মসজিদের মাইকে ঘোষণা করা হলে লোকজন ভিড় করেন ফরিদের বাড়িতে। ৬ ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় ফরিদ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী সেলিনা সুলতানা উপজেলার রামধানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত আছেন। ফরিদ-সেলিনা দম্পতির দাম্পত্য জীবনে ইরা তাসফিয়া নামে ৩ বছর বয়সী এক কন্যা সন্তান রয়েছে। সে বাবার সাথে মোবাইলে কথা বলার জন্য মাকে বার বার বায়না করছে।
ফরিদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে রাশিয়া যান ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। খেলা শেষ হওয়ার মাস খানেক পর তিনি রাশিয়া থেকে ইউক্রেন যান এবং সেখানে দীর্ঘ কয়েক মাস অবস্থান করেন। সম্প্রতি ইউক্রেন থেকে ফ্রান্স যাওয়ার জন্য রাসিয়ায় অবস্থানরত দাদা নামে পরিচিত দালাল লিটন বড়ুয়ার সাথে চুক্তি করেন ফরিদ। দালাল লিটন বড়ুয়ার বাড়ি চট্টগ্রাম জেলায়। সেই চুক্তি অনুযায়ী দালাল লিটন বড়ুয়ার এজেন্ট বাংলাদেশে থাকা সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার কামাল নামের এক দালালের কাছে ৭ লাখ টাকা জমা রাখেন ফরিদের পরিবার। চুক্তি অনুযায়ী কথা ছিল মাত্র ২ ঘণ্টা পায়ে হেঁটে এবং বাকি রাস্তা বৈধভাবে গাড়িতে করে ফরিদকে ফ্রান্স পৌঁছানোর পর জমাকৃত ৭ লাখ টাকা হস্তান্তর করা হবে দালালের কাছে। চুক্তি সম্পাদনের পর ইউক্রেনস্থ দালালের শিবিরে গিয়ে প্রায় একমাস সেখানে অবস্থান করেন ফরিদ। সর্বশেষ গত ২৭ আগস্ট পরিবারের সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলেন ফরিদ। এসময় তিনি জানান, পরদিন ফ্রান্সের উদ্দেশে সঙ্গীদের সাথে যাত্রা করবেন ফরিদ। এই কথা বলার পর থেকে পরিবারের সাথে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি তার।
এরপর সোমবার ফরিদের ফ্রান্স যাত্রাপথের এক সঙ্গী ফোন করে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত তার (ফরিদ) ভাই কাওছার আলীকে ফোন করে জানান, গত বুধবার একজন দালালের সঙ্গে ফরিদ উদ্দিনসহ তারা ৬ জন ইউক্রেন থেকে ফ্রান্সের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। পায়ে হেঁটে ফ্রান্স পৌঁছতে তাদের ৫ দিন সময় লাগে। কিন্তু তাদের সাথে খাবার ছিল মাত্র দু’দিনের। তাই সাথে থাকা খাবার শেষ হয়ে গেলে তাদেরকে শুকরের মাংস খেতে দেয় দালাল। কিন্তু এই খাবার খেতে অপারগতা জানান ফরিদ। তাই তিনি সাথে থাকা খেজুর খেয়ে আরো একদিন কাটান। দুই দিন পায়ে হেঁটে তারা পৌঁছেন স্লোভাকিয়ার একটি জঙ্গলে। সেখানে পৌঁছার পর সাথে থাকা খেজুরও শেষ হয়ে গেলে শুকরের মাংস খেতে বাধ্য হন ফরিদ। এই খাবার খাওয়ার সাথে সাথেই অসুস্থ হয়ে পড়েন ফরিদ। নাক ও মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে এবং বমি আর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে একেবারেই দুর্বল হয়ে যান তিনি। ওই জঙ্গলে সেদিন রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে একটি বিকট শব্দ পেয়ে সবার ঘুম ভেঙে যায়। এসময় ঘুম থেকে উঠে ফরিদকে তাদের (সঙ্গীদের) সাথে দেখতে না পেরে রাঁতের অন্ধকারেই খুঁজতে শুরু করেন তারা। কিন্তু কোথাও ফরিদকে খুঁজে না পেয়ে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই তাকে ছাড়াই ফ্রান্সের উদ্দেশে যাত্রা করে দালাল ও ফরিদের সঙ্গীয় অন্য ৫ জন এবং ২ সেপ্টেম্বর তারা ফ্রান্স পৌঁছান। তাদের মধ্যে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার নাজির, হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার সোহাগ এবং দিলদার ও বুরহান নামের আরো ২ জন ছিলেন।
নিখোঁজ ফরিদ উদ্দিন আহমদের ভাই আলা উদ্দিন ও গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি আমার ভাইকে স্লোভাকিয়ার ওই জঙ্গলে হত্যা করে সেখানেই ফেলে রেখে দালাল ও তার সঙ্গীরা ফ্রান্সে চলে যায়। নিখোঁজের পর থেকে তারা (দালাল ও ফ্রান্স যাত্রাপথের ফরিদের সঙ্গীরা) আমাদেরকে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ভাই (ফরিদ) এখনো জীবিত রয়েছেন বলে আমাদেরকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আসছে।’
তারা বলেন, মাত্র ২ ঘণ্টা পায়ে হেঁটে এবং বাকি রাস্তা বৈধভাবে গাড়িতে করে ফ্রান্স পৌঁছানোর কথা বলে দালালেরা আমাদের ভাইয়ের সাথে প্রতারণা করেছে ও হত্যা করেছে। আমরা এর বিচার চাই।