অস্ত্রোপচারের পর আবারও ফিরে এসেছে ক্যানসার। বুঝতে পারছেন আয়ু বড়জোর আর বছর পাঁচেক। তবুও দমে যাননি তিনি। নতুন নতুন অ্যাপল পণ্যের উদ্ভাবনে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। যাঁরা অ্যাপল সম্পর্কে জানেন তাঁদের কাছে এই স্টিভ জবস অচেনা নন। অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ছিলেন তিনি, মারা যান ২০১১ সালের ৫ অক্টোবর। তিনি স্টিভ জবস।
মারা যাওয়ার আগে স্টিভ জবসকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এমন কয়েকজন হচ্ছেন নিউজউইক-এর সাবেক সাংবাদিক স্টিভ লেভি, নিউইয়র্ক টাইমস-এর জন মার্কোফ এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ফরচুন-এর ব্রেন্ট স্লেনডার। এঁদের মধ্যে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে স্টিভ জবসকে কাছ থেকে দেখেছেন ব্রেন্ট স্লেনডার।
সাংবাদিক হিসেবে জবসের অনেক হাঁড়ির খবরও জোগাড় করেছিলেন ব্রেন্ট স্লেনডার। এবার পাঠকদের জন্য তুলে এনেছেন জবসকে নিয়ে অনেক স্মৃতিকথা। এর মধ্যে রয়েছে যেভাবে স্টিভ জবসকে বাঁচাতে নিজের যকৃতের অংশবিশেষ দিতে চেয়েছিলেন অ্যাপলের বর্তমান প্রধান নির্বাহী টিম কুক সেই কথা। এতে রয়েছে অ্যাপলের বর্তমান নকশা বিভাগের প্রধান জনি আইভের চাকরি যাওয়ার ভয়ে জবসের সামনে জড়োসড়ো হয়ে থাকার কথা। এমনকি এতে রয়েছে ওয়াল্ট ডিজনির প্রধান নির্বাহী বব ইগারের গোপনীয়তা রক্ষার গল্পও।
‘যে স্টিভ জবসকে আপনি জানেন না, যিনি ছিলেন দয়াবান, ধৈর্যশীল ও মানবিক গুণসম্পন্ন’। ফাস্ট কোম্পানির ওয়েবসাইটে স্টিভ জবসকে নিয়ে একটি প্রতিবেদনের এমনই শিরোনাম দেওয়া হয়েছে। আর এ প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছে স্টিভ জবসকে নিয়ে লেখা বায়োগ্রাফিটি সম্পর্কে আলোকপাত করতে। ২৪ মার্চ প্রকাশিত হচ্ছে এটি। এর নাম বিকামিং স্টিভ জবস: দ্য ইভল্যুশন অব আ রেকলেস আপস্টার্ট ইনটু আ ভিশনারি লিডার। একজন ভবিষৎ-দ্রষ্টা স্টিভ জবস কীভাবে বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ কোম্পানি অ্যাপলকে গড়ে তুলেছিলেন, সেখান থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন, আবার দেউলিয়াত্বের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন তার অজানা অনেক বিষয় উঠে এসেছে এতে।
বইটি লিখেছেন সাংবাদিক ব্রেন্ট স্লেনডার ও রিক টেটজেলি। জবসের জীবদ্দশায় অনেকবার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ব্রেন্ট। তিনি জবসের অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলেন। টেটজেলি ফাস্ট কোম্পানির নির্বাহী সম্পাদক। লেখকদের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, নতুন এই বইটিতে স্টিভ জবসকে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে।
স্টিভ জবসের বায়োগ্রাফি বলতে এখন মানুষ ওয়াল্টার আইজ্যাকসনের লেখা বায়োগ্রাফিকেই বোঝেন। কিন্তু অ্যাপলের বর্তমান প্রধান নির্বাহী টিম কুকের মতে, ‘আইজ্যাকসনের বায়োগ্রাফিতে জবসকে লোভী, আত্মকেন্দ্রিক একজন মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। যদিও তাঁকে সাধুপুরুষ বলতে চাই না, তবে তিনি যে চমত্কার মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, তা বলা যায়।’
ব্লুমবার্গ-এর প্রতিবেদনে জবসকে নিয়ে ওয়াল্ট ডিজনির প্রধান নির্বাহী বব ইগারের প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে। স্টিভ জবসের ক্যানসারের কথা আগে থেকেই জানতেন বব। কিন্তু তিনি ২০০৬ সালে জবসের পিক্সার স্টুডিও কিনে নেওয়ার সময় সে তথ্য চেপে যান। যখন ডিজনি পিক্সারকে কিনে নেওয়ার জন্য চুক্তি করেন, তার ঘণ্টা খানেক আগেই ক্যানসার শরীরে ফিরে এসেছে বলে স্টিভ জবস তাঁকে জানান। কিন্তু সেই কথা তিন বছর পর্যন্ত গোপন করে রেখেছিলেন বব ইগার। ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারে পিক্সারকে কিনে নেয় ওয়াল্ট ডিজনি। স্টিভ জবস সবচেয়ে বেশি শেয়ারের মালিক এবং এই এন্টারটেইনমেন্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদেও জায়গা পান। ইগার ভেবেছিলেন, তিনি পিক্সারের জন্য যে অর্থ পরিশোধ করছেন তাতে শুধু পিক্সারের মূল্য শোধ করা হচ্ছে, জবসের নয়। তাই এ ক্ষেত্রে জবসের শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনায় নেওয়ার দরকার নেই। এই চুক্তির সময় জবসের শারীরিক অবস্থার কথা প্রকাশ পেলে কী ধরনের প্রভাব পড়বে সে কথাও ভেবেছিলেন তিনি। তাই জবসের ক্যানসারের কথা চেপে যান তিনি।
ইগার জানান, ‘ডিজনি ও পিক্সারের মধ্যে চুক্তি হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে ক্যালিফোর্নিয়া ক্যাম্পাসে আমি ও জবস একসঙ্গে হাঁটছিলাম। ওই সময় জবস আমাকে বলেছিলেন, তাঁর ক্যানসার আবার ফেরত এসেছে। এমনকি পাঁচ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি।’ জবসের কথা শুনে ইগার বলেছিলেন, ‘আপনি আমাদের সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডার। কিন্তু তাতে এই বিষয়টির ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। আমাদের চুক্তিতে আপনি বিষয়বস্তু নন। আমরা পিক্সারকে কিনছি, আপনাকে নয়।’
২০০৩ সালে জটিল প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারের চিকিত্সা করান অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী স্টিভ জবস এবং ওই সময় তাঁর অস্ত্রোপচারও করা হয়। কিন্তু তিন বছরের মধ্যেই আবার টিউমার হয় এবং ২০০৯ সালে তাঁর যকৃত প্রতিস্থাপন করতে হয়।
২০১১ সালে জবসকে নিয়ে ওয়াল্টার আইজ্যাকসন একটি বায়োগ্রাফি লিখেছিলেন যার কয়েকটি অনুচ্ছেদে জবসের অগোছালো জীবন ও তেজস্বী মেজাজের কথা ফুটে উঠেছিল। নতুন এই বায়োগ্রাফিতে জবসের মানবিক দিকটি ফুটে উঠেছে বলেই ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।