আসামের ১৯ লাখ মানুষকে নাগরিকত্বহীন ঘোষণা করে ভারত সরকার আসামকে ‘সমস্যাহীন’ করার যে অপপ্রয়াস চালাচ্ছে, তা শুধু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলই নয়, উপমহাদেশের পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে অস্থির করে তুলেছে। প্রথমবার নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশকে সরাসরি কটাক্ষ করে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘পাঞ্জাবে ভারতের ভয়ে পাকিস্তান কাঁপে আর আসামে বাংলাদেশের ভয়ে কাঁপে ভারত।’
আসলে কথাটা ছিল- বাংলাদেশ থেকে লোক ভারতে যায় বলে কথাটা প্রতিষ্ঠিত করা। এখন ১৯ লাখ লোক আসামে ‘অবৈধ’ বলে তালিকা করে ভারত তার অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশনের বোঝাকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে না তো? কথাটা প্রমাণসাপেক্ষ এবং সময়সাপেক্ষ, তবে আশঙ্কা থেকে মুক্ত থাকা যায় না। ১৯ লাখের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের বেশি বাঙালি হিন্দু, বাকিরা মুসলমান। ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস (এনআরসি) তালিকায় আসামে যারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন, তাদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ২৪ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ বা পাকিস্তানি বর্বরতা শুরু হয়নি। সেদিন পর্যন্ত যারা ভারতে ছিল, তাদের তালিকাভুক্ত করা হবে। এই তালিকার বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে ১২০ দিনের মধ্যে। এর মধ্যে যারা আপিল করবে না, তাদের তৈরি থাকতে হবে ডিপোর্টেশনের জন্য। ভারতের, বিশেষ করে আসামের, ১৯ লাখ মানুষকে ‘স্টেটলেস’ ঘোষণা করা অর্থাৎ এই ১৯ লাখ মানুষ সম্পর্কে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে- তা অস্পষ্ট রাখা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বৈকি। কারণ, বলা হচ্ছে তালিকা-বর্হিভূতরা বাংলাদেশ থেকে আসা। তার মধ্যে মুসলমান অধিক হলেও হিন্দুর সংখ্যাও প্রায় কাছাকাছি। আর ভারত বলেছে অবৈধ বাংলাদেশি মাইগ্রেন্ট শনাক্ত করতে এ প্রক্রিয়ার প্রয়োজন।
প্রতি মুহূর্তেই দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানি। ইতিমধ্যে ভারত সরকার সেখানে হাজার হাজার বিদেশি সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে সাময়িক ক্যাম্পে রেখেছে রাজ্যের জেলখানায়। কিন্তু ভারত এখনো বলেনি যে তাদের ডিপোর্ট করা হবে। কারণ, সম্ভবত নরেন্দ্র মোদির যে ঘোষণা বিশ্বের হিন্দুদের অভয়ারণ্য হবে ভারত, তাই গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে যারা হিন্দু, তাদের ব্যাপারে সম্ভবত ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে মুসলমানদের ব্যাপারে নতুন করে ভাবা হবে। তারা ভারতীয় হলেও নিস্তার নেই, যেহেতু রেজিস্টারে নাম ওঠেনি। এই প্রক্রিয়া আসামের ‘এথনিক মাইনরিটি’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিভিন্ন রকম ণ্ডজব ছড়ানো হচ্ছে। ইতিপূর্বে ৪০ লাখ মানুষকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। আসামে অবশ্য এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মুসলমান।
নাগরিকদের রেজিস্ট্রি কী?
এই এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন অব সিটিজেনস) সৃষ্টি হয় ১৯৫১ সালে। এর উদ্দেশ্য আসামে কারা জন্ম নিয়েছিলেন আর জন্মের কারণে তারা ইন্ডিয়ান এবং কারা প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে মাইগ্রেশন করে সেখানে গিয়েছে তা নিরূপণ করা। সম্প্রতি এই রেজিস্টার নবায়ন করা হয়েছে। রাজ্যের মধ্যে পরিবারণ্ডলোর সেখানে বসবাসের পূর্বাপর দলিল দিতে হবে। যারা দলিল দিতে পারবে না, তারা অবৈধ বিদেশি বলে বিবেচিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বহুদিন ধরে ভারতে ‘অবৈধ ইমিগ্রেন্টদের’ বিরুদ্ধে চেঁচামেচি করছে। কিন্তু সম্প্রতি তারা এনআরসি নবায়নকে প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন বলে স্থির করেছে।
আসামে কেন রেজিস্ট্রি হচ্ছে?
আসামে রয়েছে ভারতের বহু নৃগোষ্ঠীর উপস্থিতি। পরিচয় ও নাগরিকদের প্রশ্ন এখানে দীর্ঘদিনের। সেখানে বসবাসকারীদের মধ্যে রয়েছে বাঙালি ও আসামি ভাষাভাষী হিন্দু। তার সাথে রয়েছে বিভিন্ন উপজাতি।
আসামের এক-তৃতীয়াংশ অধিবাসী, প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ, মুসলিম। ভারতশাসিত কাশ্মীরের পর মুসলিম সংখ্যার দিক থেকে আসামই দ্বিতীয়। অনেকেই সেখানে ব্রিটিশ শাসনের সময় যারা বসতি গড়েছিল, তাদের প্রজন্ম।
কিন্তু বাংলাদেশের সাথে আসামের সীমান্ত হচ্ছে ৪ হাজার কিলোমিটার। আর এই দীর্ঘ সীমান্ত ভারতে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। ২০১৬ সালে সরকার বলেছিল, সেখানে ২০ মিলিয়ন বা ২ কোটি অবৈধ রয়েছে। আর পরিশেষে দেখা গেছে, ১৯ লাখ মাত্র রাজ্যহীন হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেও যারা মনে করেছে তাদের অন্যায়ভাবে রাজ্যহীন করা হয়েছে, তারা উচ্চ আদালতে যেতে পারেন। অনেকে সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারেন। তাতে ভারতের কোর্টে অনেক মামলার ভিড়ে আরো মামলা যুক্ত হবে। আর যেসব গরিব-দুঃখীকে তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে, তাদের দুর্গতির সীমা থাকবে না। তারা তাদের মামলা লড়ার জন্য অর্থ জোগাড়ে নামবে। যদি উচ্চ আদালতে কেউ মামলায় হেরে যায়, তারা দীর্ঘদিন কার্যকরভাবে আটক থাকতে পারে। ইতিপূর্বে ১ হাজার লোককে বিদেশি ঘোষণা করে তাদের ৬টি ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়েছে। তার কারণ-বিদেশি শনাক্তকরণ ট্রাইব্যুনালের কোনো জেল নেই। ‘আসাম দি একর্ড, দি ডিসকর্ড’-এর লেখক সঙ্গীতা বায়ারা পিসারনী বলেন, ‘যেসব মানুষের নাম তালিকায় নেই, তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ আদালতের বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। অনেকে মনে করেন, তাদেরকে এই অবিশ্বাসযোগ্য প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে।’
আদালত বিতর্কিত হওয়ার বিবিধ কারণ রয়েছে। বিশেষ আদালত সৃষ্টি হয় ১৯৬৪ সালে। তখন থেকে তারা ঘোষণা করে এক লাখেরও বেশি মানুষ বিদেশি। তারা নিয়মিত সন্দেহভাজন ভোটার শনাক্ত করেছে অথবা তারা তাদের বলে ‘অবৈধ বহিরাগত’। তাদের ‘বিদেশি’ হিসেবে ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু যখন বিদেশি ট্রাইব্যুনালে এসব মামলার শুনানি হয়, তখন ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। শুরু হয় বিতর্ক। আসামে এ রকম ২০০ বিতর্কিত কোর্ট রয়েছে। অক্টোবরের মধ্যে এসব কোর্টের সংখ্যা ১ হাজারে উন্নীত করা হবে। এসব ট্রাইব্যুনালের অধিকাংশ স্থাপন করা হয় ২০১৪ সালে, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর।
কোর্টকে বলা হয় তার একপেশে এবং তাদের রায় সংগতিপূর্ণ নয়। একবার এক রকম বলা হলে, আরেকবার ভিন্ন রকম। কিন্তু প্রমাণের দায়দায়িত্ব ভুক্তভোগীর। দ্বিতীয়ত, অনেক পরিবার কোনো ডকুমেন্ট দিতে পারে না। তারা বৈধতার দাবি করতে পারে না। অথচ বছরের পর বছর তারা আসামবাসী। বৈধতার দাবি উত্থাপনের জন্য কোনো খরচপাতি বহন করতেও তারা অক্ষম।
এমনকি ভারতীয়দের ‘বিদেশি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে তাদের নামের বানানে ভুলের জন্য, ভোটার তালিকার বয়সের জন্য এবং আইডেন্টিটি ডকুমেন্ট না থাকা বা তা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত নয় বলে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই কোর্টের কাজকে ‘যেমন তেমন’ (ঝযড়ফফু ধহফ খধপশধফধরংরপধষ) বলে বর্ণনা করেছে।
সাংবাদিক রোহিনী মোহন এসব কোর্টের ৫০০ বিচার ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, এক ডিস্ট্রিক্টের বিচারাধীন ৮২ শতাংশ মানুষকে বিদেশি ঘোষণা করা হয়। তার মধ্যে ৭৮ শতাংশের কোনো শুনানিই হয়নি। পুলিশ বলছে, তারা পলাতক। কিন্তু মিস মোহন দেখিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই গ্রামে বসবাস করছে। তারা জানেও না যে তাদের ‘বিদেশি’ ঘোষণা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বিদেশি ট্রাইব্যুনালকে অবশ্যই আরো স্বচ্ছ হতে হবে এবং তাদের জবাবদিহি থাকতে হবে।
একজন খ্যাতিমান ভারতীয় সৈনিক মোহাম্মদ সানাউল্লাহ ১১ দিন ডিটেনশনে কাটান গত জুন মাসে। তার গ্রেফতারে ভারতব্যাপী অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। মমতা ব্যানার্জি বলে প্রেসিডেন্ট ফখরুদ্দীনের আত্মীয়কেও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সিটিজেন রেজিস্টার ও ট্রাইব্যুনাল উভয়েই ভয়ের সঞ্চার করেছে আসামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে।
সংখ্যালঘুদের কি টার্গেট করা হয়েছে?
অনেকে বলেন, এ তালিকায় ধর্মীয় কোনো প্রভাব নেই। কিন্তু সমাজকর্মীরা মনে করেন, তাতে ‘বাঙালিদের’ টার্গেট করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই মুসলমান। তারা বাংলাদেশে রোহিঙ্গা মুসলমানদেরও টার্গেট করেছে।
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাভাষী হিন্দুকেও তালিকা-বহিভূর্ত রাখা হয়েছে। তাতে বোঝা যায়, রাজ্যে সাম্প্রদায়িক ও নৃগোষ্ঠী টেনশনে রয়েছে।
মিস বারোহা পিসারোটি বলেন, ‘কমিউনিটির মধ্যে একটি কমিউনিটি সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থায় পড়েছে, তারা হলেন- বাঙালি হিন্দু। তাদের অনেকেই মুসলমানদের মতো ডিটেনশন ক্যাম্পে। আর এ কারণে এনআরসি প্রকাশের কয়েক দিন আগে বিজেপি তাদের সুর পাল্টেছে। তারা বলেছে, এ তালিকায় ভুলভ্রান্তি রয়েছে। তারা তা বলেছে, কারণ বাঙালি হিন্দুরা বিজেপির ভোটের শক্ত ঘাঁটি।’
মানবিক ট্র্যাজেডি!
আসামে বাঙালি নিধন এক মানবিক দুর্যোগ। মানবসৃষ্ট এই মানবিক দুর্যোগের দৈত্য হচ্ছে বিজেপি। সমাজকর্মীরা বলছেন, ২০১৫ সালে এই তালিকা তৈরি শুরু হওয়ার পর সম্ভাব্য নাগরিকত্ব হারানো এবং ডিটেনশনে যাওয়ার ভয়ে কয়েক ডজন বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্পের হৃদয়হীন নীতির মতো পরিবার ভাঙার অমানবিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আসামেও। আটক যারা আছেন, তাদের খারাপ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। ডিটেনশন সেন্টারে চলছে গাদাগাদি মানুষের স্তূপ।
এক আটককৃত ব্যক্তি ছাড়া পাওয়ার পর বলেছেন, ৪০ জনের একটি কক্ষে তারা ছিলেন ১২০ জন। অনেক বিদেশি বলে ঘোষিত ব্যক্তি ডিপ্রেশনে ভুগছেন। শিশুদেরও তাদের পিতা-মাতার সাথে বন্দী রাখা হয়েছে।
হর্ষমন্দর নামের এক সমাজকর্মী বিবিসিকে বলেন, সমস্যা অত্যন্ত সঙিন। মানুষের অমানবিক দিনাতিপাত।
যাদের বিদেশি ঘোষণা করা হয়েছে তাদের কী হবে?
বিজেপি আগে বলেছিল, অবৈধ মুসলিম ইমিগ্রেন্টদের ডিপোর্ট করা হবে। কিন্তু প্রতিবেশী বাংলাদেশ কখনো এ ধরনের অনুরোধের ঢেঁকি গিলবে না।
অনেকে মনে করেন, ভারত অবশেষে রাজ্যবিহীন মানুষদের নিয়ে নতুন সমস্যা সৃষ্টি করবে। আর তা সৃষ্টি করবে ভারতের জন্য সমস্যা। তাতে সৃষ্টি হবে রোহিঙ্গার মতো আরেক ক্যাম্পের। যেমন করে তারা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে।
এখনো পরিষ্কার নয় যাদের সিটিজেনশিপ থেকে বঞ্চিত করা হবে, তারা কোনো কল্যাণ ভাতা পাবে কি না? অথবা তাদের যা সম্পদ আছে, তা তারা ব্যবহার করতে পারবে কি না?
একটা সম্ভাবনা এই যে, একবার তারা মুক্ত হলে তাদের ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া হবে। কিছু মৌলিক অধিকার দেওয়া হবে। কিন্তু ভোটাধিকার দেওয়া হবে না।