লিখেছেন মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
আশুরা’ শব্দটি আরবি। ‘আশারা’ শব্দমূল থেকে নির্গত। অর্থ দশ। শরিয়তের পরিভাষায় মহররমের দশম দিবসকে ‘আশুরা’ বলে অভিহিত করা হয়। হিজরি বর্ষের সূচনা হয় এই মহররম মাসের মাধ্যমে। ‘মহররম’ শব্দের অর্থ পবিত্রতম ও মর্যাদাপূর্ণ। ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগে এ মাসকে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের চোখে দেখা হতো। এর পবিত্রতা ও মর্যাদার কথা বিবেচনা করেই যুদ্ধপ্রিয় আরবরা এ মাসে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকত। তাই এ মাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘মহররম’ বা ‘মর্যাদাপূর্ণ’ বলে। এ মাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, হাদিস শরিফে এ মাসকে ‘আল্লাহর মাস’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এ মাস সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২টি। এর মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ ও সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এসব মাসে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার কোরো না।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৬)
হাদিস শরিফে এসেছে, এ চারটি মাস হলো—জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। কাজেই সৃষ্টির সূচনা থেকেই এ মাসটি বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে আসছে। তাইতো আমরা দেখতে পাই, পৃথিবীর ইতিহাসের অসংখ্য কালজয়ী ঘটনার জ্বলন্ত সাক্ষী পুণ্যময় এ মাস। কারবালার ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডিও আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। রচিত হয়েছে শোকাভিভূত এক নতুন অধ্যায়।
আশুরা দিবসকে কেন্দ্র করে রচিত ও সংকলিত হয়েছে ইতিহাসের নানা তথ্য-উপাত্ত ও ঘটনাপ্রবাহ। নবী-রাসুলদের সঙ্গে সম্পৃক্ত আশুরার মর্যাদাবাহী অসংখ্য ঘটনা-উপাখ্যান-বিবরণ ইতিহাসের গ্রন্থগুলোয় খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন আশুরার দিন আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা, ওই দিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো, একই দিনে তাঁর তওবা কবুল হওয়া, এই দিনেই ইবরাহিম (আ.)-এর জন্মগ্রহণ ও নমরুদের প্রজ্বলিত আগুন থেকে মুক্তি লাভ, আইয়ুব (আ.)-এর আরোগ্য লাভ, ইউনুস (আ.)-এর মাছের পেট থেকে মুক্তি পাওয়াসহ অসংখ্য ঘটনার বিবরণ ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। নিছকই ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সেসব ঘটনার বিশেষ আবেদনও রয়েছে বৈকি!
তবে হাদিস শরিফে আশুরার ইতিহাস সম্পর্কে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) যখন হিজরত করে মদিনায় পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিন রোজা পালন করছে। নবীজি (সা.) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, আশুরার দিন তোমরা রোজা রাখো কেন? তারা উত্তর দিল, এটি একটি মহান দিন—এ দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মুসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। রাসুল (সা.) বলেন, মুসা (আ.)-কে অনুসরণের ব্যাপারে আমরা তাদের চেয়ে বেশি হকদার। এর পর থেকে তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৩৯৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৩৯)। অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘এটি সেদিন, যেদিন নুহ (আ.)-এর কিশতি ‘জুদি’ পর্বতে স্থির হয়েছিল। তাই নুহ (আ.) আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ সেদিন রোজা রেখেছিলেন।’ (মুসনাদে আহমাদ : ২/৩৫৯)
৬০ হিজরির ১০ মহররম সংঘটিত হয় কারবালার হৃদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী, বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। সেদিন পাপিষ্ঠরা যে নির্মমতা ও নির্দয়তার পরিচয় দিয়েছে, তা পাথরসম যেকোনো হৃদয়েই সমবেদনা জাগিয়ে তুলবে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শাহাদাতের পর হুসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর দেহ মোবারকে মোট ৩৩টি বর্শার এবং ৩৪টি তরবারির আঘাত ছাড়াও অসংখ্য তীরের জখমের চিহ্ন বিদ্যমান ছিল।