যুবলীগের সাবেক দফতর সম্পাদক (বহিষ্কৃত) কাজী আনিস ও তার স্ত্রীর দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দেশে শত কোটি টাকার সম্পদ গড়ার পাশাপাশি ভারত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়ও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন কাজী আনিস। স্ত্রীসহ আত্মগোপনে থাকা কাজী আনিসের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা তদন্তে এমন তথ্য পেয়েছে দুদক। দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান মামলাটি তদন্ত করছেন। কাজী আনিসের প্রকৃত সম্পদের পরিপূর্ণ হিসাবে পেতে ৭৬ দফতরের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন জানান, কাজী আনিসের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। তদন্তে তার বিপুল পরিমাণ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক। ইতোমধ্যে তার যাবতীয় সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। বিদেশে থাকা সম্পদের বিষয়েও খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। খুব শীঘ্রই চার্জশিট দেয়া হবে।
দুদকের তদন্ত সংশিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, গার্মেন্টকর্মী থেকে যুবলীগের পদ পাওয়ার পর কাজী আনিসের উত্থান আলাদিনের চেরাগের মতো। ৫ বছরে দেশ-বিদেশে গড়েছেন বিপুল পরিমাণ সম্পদ। এসব সম্পদ অর্জনের বৈধ কোন উৎস খুঁজে পায়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব সম্পদের উৎস ক্যাসিনো পরিচালনা এবং চাঁদাবাজি। ইতোমধ্যে দুদক কাজী আনিসের দেশে যেসব সম্পদের খোঁজ পেয়েছে সেগুলো জব্দ করেছে। কাজী আনিস ও তার স্ত্রীর নামে দেশে শতাধিক ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করেছে। এসব ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুদক। দুদক ধারণা করছে ক্যাসিনো, চাঁদাবাজিসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কাজী আনিস যে অর্থ আয় করেছে তার সিংহভাগ ভারত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাচার করেছে। ইতোমধ্যে ভারত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে কাজী আনিসের বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করার তথ্য পেয়েছে দুদক।
দুদক সূত্র জানায়, গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার বাউলিয়া গ্রামে যুবলীগ নেতা কাজী আনিসুর রহমানের জন্ম। তার বাবা আর্মিতে চাকরি করতেন। ১৯৯২ সালে অবসরে যান। কাজী আনিসের শৈশব ও কৈশর বাউলিয়া গ্রামে কাটলেও অভাব অনটনের মধ্যে ছিলেন। কারণ অবসরে যাওয়ার পর কাজী আনিসের পরিবারে আয় করার মতো তেমন কেউ ছিল না। বাবা যে কয় টাকা পেনশন পান তা দিয়ে কষ্ট করে সংসার চালাতেন। এ সময় মেয়েদের বিয়ে দেন। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে কাজী আনিস ঢাকায় গামেন্টেসে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরি নেন। ২০১০ এর পর কাজী আনিসের ভাগ্যে রূপকথার জাদুর কাঠির ছোঁয়া লাগে। যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুকের ডানহাত হয়ে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। ক্যাসিনো কারবার, চাঁদাবাজিসহ নানা কায়দায় শত কোটি টাকা উপার্জন করেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে কাজী আনিসুর রহমানের নাম আসলে দুদক তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর কাজী আনিসের বিরুদ্ধে বার কোটি আশি লাখ ষাট হাজার নয়শ’ বিশ টাকার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদের জন্য দুদকের উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। যদিও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় দুদকের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের হওয়ায় সপরিবারে আত্মগোপনে চলে যায় কাজী আনিস।
দুদক সূত্র জানায়, কাজী আনিসের গ্রামের বাড়ি বাউলিয়াতে এবং মুকসুদপুরে ২৫টি দলিলে কয়েক কোটি টাকার দলিলমূলে জমি জব্দ করা হয়েছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য ২০ কোটি টাকার বেশি। যে আনিস মাত্র পাঁচ হাজার টাকা মাসিক বেতনে গামেন্টেসে চাকরি করতেন, সে আনিসই মাত্র চার বছর পর নিজ গ্রামে পুুকুর ভরাট করে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে দৃষ্টিনন্দন রাজকীয় ভবন নির্মাণ করেছেন। বাড়িটির কিছু অংশ পৈতৃক ভিটায় তৈরি করলেও তার বাবা নিজেই জানিয়েছেন তার কাছে বাড়ি করার মতো কোন টাকা পয়সা নেই। তার ছেলে কাজী আনিসই মূলত তার বাবা মো. ফায়েক কাজীর নামে মুকসুদপুরস্থ অগ্রণী ব্যাংকের শাখায় টাকা পাঠাতো এবং সে টাকা দিয়ে বাড়িটি তৈরি করেছেন। বাবার নামে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে মুকসুদপুরের দাসের হাটে পেট্রল পাম্প ক্রয় করেন। পেট্রল পাম্পটি প্রথমে ফায়েক কাজীর নামে কোটি টাকায় ক্রয় করেছিল এবং বছর দুয়েক পরে ফায়েক কাজী আবার কাজী আনিসকে হেবা করে দেন।
এ ব্যাপারে ফায়েক কাজীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, টাকাতো আনিসেরই ছিল তাই তাকে হেবা দিয়েছি, দোষ কোথায়। কেরানীগঞ্জে ৭/৮ দলিলে জমি ক্রয়ের রেকর্ড পাওয়ার পর তদন্তকারী কর্মকর্তা জব্দ করেছে যার বর্তমান বাজারমূল্য ১২/১৩ কোটি টাকা। এছাড়া কয়েক কোটি টাকায় ধানমন্ডি ১০/এ তে ৪০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটসহ তিনটি গ্যারেজ ক্রয় করেন। ওয়ারীতে কয়েকটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেন, যার রেজি. মূল্য থেকে প্রকৃত মূল্য অনেক বেশি, যা তদন্তকালে প্রমাণিত হয়েছে। নিউ এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে তিনটি দোকান এবং সামনের অংশে ১৩০০ বর্গফুটের জায়গা ক্রয় করেন, যার বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা। গুলশান থানার গুলশান উত্তর বাণিজ্যিক এলাকাস্থিত হোল্ডিং নং-২৮ ল্যান্ডভিউ কর্মাশিয়াল সেন্টার ভবনের দ্বিতীয় তলায় দুটি সুপরিসর দোকান ক্রয় করেন যার বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা। এছাড়া তার স্ত্রী মোছা. সুমি রহমানের নামে শুক্রাবাদে বিলাসবহুল অট্টালিকা ক্রয় করেন, যার বাজারমূল্য ৫ কোটির অধিক হবে।
তদন্তকালে কাজী আনিসুর রহমানের অর্ধশত ব্যাংক হিসাব পাওয়া গেছে যেগুলোতে কোটি কোটি টাকার ট্রাঞ্জেকশন পাওয়া যায়। এসব হিসাবে বর্তমানে জমা রয়েছে ৬ কোটি টাকার মতো যেগুলো আদালতের আদেশে ফ্রিজ করা হয়েছে। তার স্ত্রী শিমু রহমানের ২০টির বেশি হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তদন্তকালে কাজী আনিসুর রহমানের সম্পদের তথ্য পেতে ৭৬ জায়গায় পত্র দেয়া হয়েছে। সেগুলো প্রাপ্তি সাপেক্ষে তার সহায়-সম্পদ সবকিছু জব্দ করা হয়েছে। কাজী আনিস এবং সুমি রহমানের আয়কর নথিসমূহ জব্দ করা হয়েছে। কাজী আনিস ও তার স্ত্রী সুমি রহমান বর্তমানে বিদেশে পলাতক রয়েছেন।
কাজী আনিস কেন্দ্রীয় যুবলীগের কার্যালয়ে পিয়ন হিসেবে যোগ দেন ২০০৫ সালে। বেতন ছিল মাসে পাঁচ হাজার টাকা। সাত বছর পর বনে যান কেন্দ্রীয় যুবলীগের দফতর সম্পাদক। যুবলীগের সর্বশেষ কমিটিতে তাকে এ গুরুত্বপূর্ণ পদ দেন সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। আনিস যুবলীগ থেকে অব্যাহতি পাওয়া সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক ছাড়া কাউকে পরোয়া করতেন না। তার বেপরোয়া মনোভাবে যুবলীগ নেতাদের অনেকেই কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কোণঠাসা। ২০০৫ সালে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যখন আনিসের চাকরি হয়, তখন তিনি নেতাদের ফরমায়েশ শোনার পাশাপাশি কম্পিউটার অপারেটরের কাজও করতেন। এ সুবাদে কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি কার্যালয়ে আসা তৃণমূল নেতাদের সঙ্গেও সখ্য হয় তার। কেন্দ্রীয় যুবলীগ সারাদেশে যেসব কমিটি দিত, সেগুলো কম্পিউটারে টাইপ করে দিতেন আনিস। টাইপ করতে গিয়ে কোন জেলায় কে সভাপতি কে সম্পাদক তা নখদর্পণে চলে আসে আনিসের। মুখস্থ বলে দিতে পারতেন যেকোন কমিটির নেতার নাম। এসব কারণেই চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ হয়ে যান তিনি। আবার জেলা পর্যায়ের নেতারাও কমিটির বিষয়ে কেন্দ্রের তথ্য বা সিদ্ধান্ত জানতে তাকে ফোন করতেন। এভাবে জেলা নেতাদের সঙ্গেও তার সখ্য হয়ে যায়।
২০১২ সালে যুবলীগের কমিটি হলে আনিস পেয়ে যান উপ-দফতর সম্পাদকের পদ। শীর্ষ নেতার আশীর্বাদ থাকায় ছয় মাস পর খালি থাকা দফতর সম্পাদক পদে পদোন্নতি পেয়ে যান আনিস। আনিসকে সবাই ‘ক্যাশিয়ার’ বলেই চেনে। যুবলীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে যারা ক্যাসিনো থেকে ভাগ পেতেন তাদের ভাগের টাকা তুলতেন কাজী আনিস। এছাড়া টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে আসা টাকার ভাগ কয়েকজন শীর্ষ নেতাদের পক্ষে কাজী আনিস তুলে পৌঁছে দিতেন। এভাবে তিনি নিজেও ক্যাসিনোসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে ক্যাডার বাহিনীসহ অস্ত্রধারী একটি গ্রুপককেও তিনি সেল্টার দেন। তাদের দিয়ে নানা অপকর্ম করাতেন। এভাবে পিওন থেকে মাফিয়া হয়ে উঠেন কাজী আনিস।
দুদক পরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে কাজী আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রী সুমি রহমানের বিরুদ্ধে গত বছর ৬ নভেম্বর দুটি আলাদা মামলা করা হয়েছে। মামলায় আনিসের বিরুদ্ধে ১২ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং সুমি রহমানের ১ কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার পর দুজনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক।’
এদিকে বিদেশে আত্মগোপনে থাকা কাজী আনিস ও সুমি রহমান দেশে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করে বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার এড়াতে ও হয়রানি ছাড়াই নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের জন্য নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। তবে আদালত গত ২০ ফেব্রুয়ারি এ রিট উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেয়।
পূর্বপশ্চিমবিডি