বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান পুলিশের এক সাহসী অফিসার কল্লোল

জন্ম বেড়ে উঠা দুটোই হাওর অধ্যুষিত জেলা সুনামগঞ্জে হলেও তার সাহসিকতার গল্প লিখা আমেরিকার নিউইয়র্কের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (এনআইপিডি)-তে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এ অফিসারের নাম নিয়ন চৌধুরী কল্লোল। করোনাকালে যখন আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছিল, তখন মনোবল না হারিয়ে সাহস ও দক্ষতার সাথে মানুষের পাশে দাঁড়ান এই অফিসার। এ জন্য তিনি কর্মস্থল থেকে পেয়েছেন সম্মান, সেই সাথে মন জয় করে নেন স্থানীয় বাসিন্দাদের।

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের হাসননগর এলাকায় বেড়ে উঠা নিয়ন চৌধুরী কল্লোল সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও স্নাতক শেষ করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দিয়েছিলেন ২০০১ সালে ইউরোপের আয়ারল্যান্ডে। সেখানে এমবিএ শেষ করার পর চলে যান আমেরিকায়। সেখান থেকেই ২০১১ সালে যোগ দেন আমেরিকার একমাত্র প্যারামিলিটারি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশ বাহিনী নিউইয়র্কের পুলিশ ডিপার্টমেন্টে (এনআইপিডি)। সেখান থেকেই শুরু হয় পুলিশ অফিসার নিয়ন চৌধুরী কল্লোলের যাত্রা। দীর্ঘ চার বছর নিউইয়র্কের ফিল্ড অফিসার হিসেবে কাজ করার পর তাকে প্রমোশন দিয়ে করা হয় এনআইপিডি’র অ্যান্টি ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের আন্ডারকভার এজেন্ট হিসেবে। একজন গোয়েন্দা অফিসার হওয়ার যেতে হয়েছে কঠিন পরিস্থিতিতে। এছাড়া তাকে যে  দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সেই এলাকার নাম ব্রস্কস ট্রানজিট। এলাকাটি নিউইয়র্কের অপরাধপ্রবণ এলাকাও হিসেবে পরিচিত। সেখানে সাহসের সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন ৬ বছর।

২০২০ সালে করোনায় যখন সারা বিশ্ব থেমে গিয়েছিল তখন রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছাড়া কেউ বের হওয়ার সুযোগ ছিল না। সেই সময় ব্রস্কস ট্রানজিট শহরের জনপ্রিয় একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন নিয়ন চৌধুরী কল্লোল। বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেয়া থেকে শুরু করে ওষুধপত্র কিনে দেয়া ছাড়াও যেকোনো ধরনের সহায়তায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তার এরকম কার্যক্রমে পেয়েছেন ব্যাপক প্রশংসা। বর্তমানে নিয়ন চৌধুরী কল্লোল ব্রস্কস ট্রানজিট থেকে বদলি হয়ে আবারও পোশাক পরে পুলিশ অফিসার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন দক্ষিণ ব্রস্কস এলাকায়।

সুনামগঞ্জের কৃতী সন্তান নিয়ন চৌধুরী কল্লোল বলেন, আমি আমেরিকার নাগরিক হলেও বাংলাদেশি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। যেহেতু আমি একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কাজ করছি সেখান থেকে আমার দায়িত্ব পালন করাটা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমি পুলিশে চাকরির পর থেকে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি। অনেক সন্ত্রাসী, অনেক ড্রাগ মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। তবে আমি ব্রস্কস ট্রানজিটে যখন ছিলাম সেখানে পরিবেশটাই ছিল অন্যরকম। বাইরে চাকচিক্য দেখে বুঝার উপায় নেই, এখানেই অপরাধ হচ্ছে গুরুতর। আমরা যখন ইমারজেন্সি কল পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই, গিয়ে দেখে আলিশান বাড়ির ভিতরে পড়ে আছে রক্তাক্ত লাশ। এ পেশায় নিজের জীবনের নিরাপত্তা থেকেও বেশি ভাবতে হয় মানুষের জন্য। তাই আমি বাসা থেকে বের হয়ে আসলেও ছেলে-মেয়েদের কথা দিতে পারি না বাড়িতে ফিরতে পারবো কি-না। কারণ এখানে আপনার শত্রু বেশি। আমি যদি কাউকে আটক করি সে কিছুদিন পর ছাড়া পেয়ে যায়। তখন থেকেই ওই সন্ত্রাসীরা ছক কষে আমাকে হত্যার। আমার উপর হামলাও হয়েছে। আমার গাড়ির গ্লাস থেকে শুরু করে সবকিছু গুলি করে ভেঙে দেয় সন্ত্রাসীরা।

করোনাকালে নিজের সাহসিকতার গল্প বিষয়ে পুলিশ অফিসার নিয়ন চৌধুরী বলেন, এই সময়টা আমাদের সবার জন্য খারাপ, ভয়ঙ্কর ছিল। তার মধ্যে আমি যে শহরে ছিলাম এটির অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ। প্রতিদিন লাশ এবং লাশের গন্ধ নিয়ে কাজ করতে হতো। ঠিক সেই সময়ে আমার মাথায় চিন্তা আসল সবাইতো ঘরবন্দী, সবার বাড়িতে খাবার আছে কি-না? কোন জরুরি কিছুর প্রয়োজন কিনা? তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিয়ে আমি মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী কথা জানতাম। তারা আমাকে জানাতেন খাবার প্রয়োজন, ওষুধ প্রয়োজন। তখন আমি দায়িত্ব শেষ করে তাদের জিনিসপত্রগুলো কিনতে সুপার শপে যেতাম এবং আমাদের গাড়িতেই এসব নিয়ে এসে মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতাম। এই সময়টা আমি কখনো ভুলবো না। ফেসবুকে একটা পোস্ট করলে শত শত ম্যাসেজ চলে আসত মানুষের চাহিদার। তাই রাত গভীর হলেও আমি তাদের জরুরি জিনিসগুলো পৌঁছে দিয়েছি।

তিনি বলেন, আমি সাধারণ মানুষ। আমি ছোটবেলা থেকেই মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখতে পারতাম না। সেজন্য বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে হলেও আমি মানুষের সাহায্য করতাম। আমি মনে করি, এ সকল মানুষের আশীর্বাদে আজকে আমি পুলিশ অফিসার হতে পেরেছি। এই সাফল্যের পেছনে আমার বাবা ও মায়ের অনেক অবদান রয়েছে। বর্তমানে আমি দুই সন্তানের জনক। আমার বড় ছেলে দশম ও মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। আমার স্ত্রী চম্পা চৌধুরী লুসি সে আমাকে অনেক সার্পোট করে। আমার প্রতিটা কাজে সে আমাকে উৎসাহ দেয়। তার বাড়িও বাংলাদেশের সিলেটে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে নিয়ন চৌধুরী কল্লোল জানান, চাকরি শেষ হয়ে গেলে আমার ইচ্ছা বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম নিয়ে কিছু করার। আমার বাবার জন্মস্থান সুনামগঞ্জের শাল্লায় বাবার দেখে যাওয়া স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবো। মানুষের পাশে আমি নিয়ন চৌধুরী কল্লোল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকবো।

উল্লেখ্য, নিয়ন চৌধুরী কল্লোলের বাবা বিধু ভূষণ চৌধুরী ছিলেন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক। তিনি এ কলেজেই অধ্যাপনা করে কাটিয়েছেন জীবনের পুরোটা সময়। সেই সাথে হাল ধরেছিলেন প্রত্যন্ত অঞ্চল শাল্লা উপজেলার অনেক অসহায় পরিবারের।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ