“জোয়ান অফ আর্ক – ফ্রান্সের মুক্তিদাত্রী বীরকন্যা।”

মাহবুবুর রব চৌধুরী,টরেন্টো

ফ্রান্সের মিউজ নদীর তীরে ডোমরেমি গ্রামে (Domrémy ), এক কৃষক পরিবারে জোয়ান অফ আর্ক ৬ জানুয়ারি, ১৪১২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। অঞ্চলটি ফ্রান্সের উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থিত। (ফরাসীতে Joan of Arc কে – Jeanne ď Arc জেয়ানে দ’ আর্ক্ -নামে ডাকা হয়।) তের বছর বয়সে তাকে নিয়ে একটি কাহিনী দ্রুতই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যখন একদিন সে মাঠে ভেড়ার পাল চরাচ্ছিলো তখন সে একটি দৈববাণী শুনতে পায়।
ওই বাণীতে তাকে মাতৃভূমির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার ও ফ্রান্সের প্রকৃত রাজাকে ক্ষমতায় পূনর্বহাল করার জন্য হাতে রাখালের লাঠির পরিবর্তে, অস্ত্র তুলে নেবার কথা বলা হয়।
এই দৈববানী তার জীবনকে আমূল পালটে দেয়। এর পর জোন অনেক চেষ্টা করে চুল ছেঁটে পুরুষ পোশাকে একদিন সে রাজার সঙ্গে দেখা করেন। ফ্রান্সের প্রকৃত রাজা সপ্তম চার্লস তখন সিংহাসন হারা। পরিস্থিতি তখন ছিল উত্তাল। চলছে ফ্রান্সের সিংহাসন নিয়ে শত বছরের যুদ্ধ (আসলেই যুদ্ধটার নাম ছিল ‘শতবর্ষী যুদ্ধ’)। পার্শ্ববর্তী ইংল্যান্ডের সাথে দ্বৈরথ তো আছেই। জোয়ানের জন্মের সময় রাজা ছিলেন ষষ্ঠ চার্লস, কিন্তু তিনি ছিলেন পাগল। তাই তার হাতে রাজ্য দেয়া চলে না, সুতরাং নতুন রাজা লাগবে। শুরু হয়ে গেল কামড়া কামড়ি রাজার কাজিন জন এবং আপন ভাই লুই-এর মাঝে। ওদিকে লুই তলে তলে পরকীয়া করছিল রাণীর সাথে, এসব নিয়ে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা তখন ফ্রান্সের।
পাগলা ষষ্ঠ চার্লসের ছেলের নামও ছিল চার্লস। তিনিই হলেন সপ্তম চার্লস এবং তাকেই মনোনীত করা হলো ভবিষ্যৎ রাজা হিসেবে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে। তখন কাছাকাছি প্রায় একই সময়ে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ড দু’দেশের রাজাই মারা গেলেন। ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন পঞ্চম হেনরি, রেখে গেলেন উত্তরাধিকারী ষষ্ঠ হেনরিকে। পরিষদ আমত্যদের পরামর্শেই চলছিলেন শিশু রাজা ষষ্ঠ হেনরি, আর সপ্তম চার্লস। ইংল্যান্ডের কূটনীতিতে ফ্রান্স ধরাশায়ী তখন তারা ফ্রান্সের মীর জাফর দিয়েই তাদেরকে পদানত করে ফেলেছে।
জোয়ানের চোখে স্বপ্ন। মনে হতে লাগল ফেরেশতারা ও সত্যের পক্ষে অবস্থান নেওয়া বুজুর্গ পীররা বলছে, ফ্রান্সকে রক্ষা কর ইংরেজ গোলামী আর আধিপত্যর আগ্রাসী ছোবল থেকে। দিনে দিনে জোয়ান বদ্ধপরিকর হতে থাকল ফ্রান্সকে বাঁচাতেই হবে।
তার নেতৃত্বে একের পর এক দুর্গ জয় করতে লাগল ফ্রান্সের সেনাবাহিনী। মে মাসের সাত তারিখে, লে তুরেলে দুর্গ অবরোধ করল ফ্রেঞ্চ বাহিনী। সে যুদ্ধে একটা তীর এসে জোয়ানের কাধে বিঁধে গেল, তিনি পড়ে গেলেন। কিন্তু এরপরই তিনি ফিরে এলেন এবং যুদ্ধ চালিয়েই গেলেন। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে ফ্রেঞ্চরা নব উদ্যমে আক্রমণ চালালো। সেদিন ইংল্যান্ড হেরে যায় যুদ্ধে। দুর্গ জয় করে নেয় ফ্রান্স।
এরপর জোয়ানের পরিকল্পনা অনুযায়ী রেইমস নগরী বিজয়ের পালা। ঠিকই জোয়ানের নেতৃত্বে তারা জিতে নিল রেইমস। সেদিন থেকে ফ্রান্সের রাজা সপ্তম চার্লস। ঠিক তার পাশেই ছিলেন জোয়ান অফ আর্ক। জোন সাদা পোশাক পরে একটি সাদা ঘোড়ায় চড়ে তরবারি হাতে ৪০০০ সৈন্য নিয়ে ১৪২৯ সালের ২৮শে এপ্রিল অবরুদ্ধ নগরী অরলেয়াঁয় প্রবেশ করেন। প্রথম আক্রমণেই তারা জয়লাভ করেন এবং এরপর তাদের একের পর এক সাফল্য আসতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই তারা ইংরেজ সৈন্যদের কবল থেকে তুরেলবুরুজ শহর উদ্ধার করেন। এর পর পাতে’র যুদ্ধেও ইংরেজরা পরাজিত হয়। জুন মাসে জোন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে শত্রুদের ব্যুহ ভেদ করে রীইঁ(Reims) নগরী অধিকার করেন। এরপর ১৬ই জুলাই সপ্তম চার্লস ফ্রান্সের রাজা হিসেবে আবার সিংহাসনে অভিষিক্ত হন এবং এভাবে জোন ফ্রান্সকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে দেন। জোনের এই যুদ্ধ জয় এবং বিপ্লবী পথ ধরেই ফ্রান্স ইংল্যান্ডের মধ্যকার শতবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধ অবসান ঘটে।
ফ্রান্সের স্বাধীনতার পর ইংরেজরা জোনকে জব্দ করার ফন্দি আঁটতে থাকে। কঁপিঞ্যান্ – (Compiègne) শহরের বহির্ভাগে শত্রুসৈন্যদের ওপর আক্রমণকালে ফ্রান্সের রাজনৈতিক দল বার্গেন্ডি-কর্মীদের বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা জোনকে আটক করতে সক্ষম হয়। তারপর চলে এক ইংরেজ পাদ্রির অধীনে এক ষড়যন্ত্র মূলক বিচারকাজ ।
( In early 1430, Joan organized a company of volunteers to relieve Compiègne, which had been besieged by the Burgundians French allies of the English. She was captured by Burgundian troops on 23 May. After trying unsuccessfully to escape, she was handed to the English in November. She was put on trial by Bishop Pierre Cauchon on accusations of heresy, which included blaspheming by wearing men’s clothes, acting upon visions that were demonic, and refusing to submit her words and deeds to the judgment of the church. She was declared guilty and burned at the stake on 30 May 1431, aged nineteen.)
পরিশেষে মেয়ে হয়ে ছেলের পোশাক পরে ছদ্দ বেশে যুদ্ধ করতে চার্চের ও ধর্মের প্রতি অবমাননা করা হয়েছে এই অজুহাত তুলে তাকে ‘ডাইনি’ নাম অপবাদ দেওয়া হয়। এবং তাকে ১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। সকল ডাইনির মতন তার ভাগ্যেও হল আণ্ডনে পুড়ে মৃত্যু। সীন নদীর তীরে ব্যস্ত লোকালয় রোয়াঁ’র বাজারে উইঞ্চেস্টারের কার্ডিনালের আদেশে তাকে তিনবার পোড়ানো হলো। এরপর ছাই ছিটিয়ে দেয়া হলো নদীতে। তখন স্বাধীনতাকামি জোয়ান অফ আর্ক এর বয়স হয়েছিল মাত্র উনিশ। পৃথিবীর ইতিহাসে মুক্তি কামি মানুষের সামনে চির দিন জোয়ান অফ আর্ক এক প্রেরণার নাম হিসাবেই থাকবে ।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো।
(লেখক পরিচিতি : ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক)

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ