দুর্নীতির টাকায় সম্পদের পাহাড়

পাঁচ বছরে ৫০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন খন্দকার মোহাম্মদ ইকবাল। স্ত্রী হালিমা ও শ্যালক জামসেদের নামে-বেনামে এই সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। কাগজে-কলমে দুদক ৫০ কোটি টাকা পেলেও দুর্নীতির মাধ্যমে এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা কামিয়েছেন ইকবাল। সীমাহীন দুর্নীতির কারণে শেষ রক্ষা হয়নি ইকবালের। স্ত্রী, শ্যালকসহ হয়েছেন দুদকের আসামি। এখন ফেরারি জীবন তাদের। ইকবাল এই দুর্নীতি করেছেন বর্তমান সরকারের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার অগ্রাধিকার প্রকল্প শাহ্‌জালাল ফার্টিলাইজার ফ্যক্টরির হিসেব বিভাগের প্রধান থাকাকালে। দম্ভোক্তি ছিল ইকবালের।

যারাই তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে তাদের নানাভাবে নাজেহাল করা হয়েছে। তখন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এমপিসহ সবার নজরে ছিলেন ইকবাল। তবে- দুদকের নজর পড়ার পর থেকে ইকবাল, তার স্ত্রী এবং সিন্ডিকেটের ১৮ সদস্যের বিরুদ্ধে ২৬টি মামলা করা হয়েছে। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের শাহ্‌জালাল ফার্টিলাইজার ফ্যক্টরি। স্বপ্নের একটি প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই এ প্রকল্প বাস্তয়ন হলে প্রায় তিন বছরের অধিক সময় ধরে উৎপাদনে রয়েছে রাষ্ট্রায়াত্ত এই প্রতিষ্ঠান। শাহ্‌জালাল ফার্টিলাইজার প্রকল্পটি দীর্ঘ ১৪ বছর শুধু সাইনবোর্ডে আটকা ছিল। সিলেটের মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগী হয়। সব ঝামেলা এড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ২৪শে মার্চ ফেঞ্চুগঞ্জ এসে শাহ্‌জালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার ওই প্রকল্পটি ৪০ মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন হয়ে যায়। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চীনের মেসার্স কমপ্লান্ট প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। ওই প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের বিনিয়োগ ছিল ১৪শ’ কোটি টাকা। বাকি অর্থ প্রদান করে চীন সরকার। তবে- প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শুরুর এক বছর পরই উল্লেখিত প্রকল্পকে ঘিরে একটি অসাধু চক্র গড়ে ওঠে। যারা সরকারের ওই প্রকল্প থেকে বেপরোয়া লুটপাট চালায়। তাদের দৌরাত্ম্য এতটা শক্ত ভিতের উপর ছিল যে কোনো কিছুরই তোয়াক্কা তারা করতো না। যার নজির তারা শাহ্‌জালাল সারকারখানার বাউন্ডারি দেয়াল নির্মাণকালে রেখে গেছে। ১৬৫ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা শাহ্‌জালাল সার কারখানার সীমানা প্রাচীর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিয়োগ রয়েছে। ২০১৫ সালের শুরুর দিকের কথা। খন্দকার ইকবাল শাহ্‌জালাল ফার্টিলাইজার ফ্যক্টরির প্রকল্পের হিসাব বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। প্রকল্পের ৬টি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে এই পদটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মোট সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা কাজের মধ্যে সরকারের তরফ থেকে দেয়া হয়েছে ১৪০০ কোটি টাকা। আর বাকি টাকা চীনের দেয়া। তবে- বাংলাদেশ সরকারের দেয়া ১৪০০ কোটি টাকায় ফ্যক্টরির আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে ব্যয় করা হয়। আর ওই টাকাতেই সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানিয়েছেন, খন্দকার ইকবাল ফেঞ্চুগঞ্জের প্রকল্পে যোগ দিয়েই ধান্ধা শুরু করেন। স্ত্রী হালিমা আক্তার, শ্যালক জামসেদের নামে একাধিক ঠিকাদারি লাইসেন্স চালু করেন। এসব লাইসেন্সের কার্যালয়ের ঠিকানা হয় ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর ইকবালের বাসা। ওই বাসাতে বসে ভুয়া প্রকল্প দিয়ে ৫০ কোটি টাকা লুট করেছেন। দুদকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আমাদের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। তদন্ত শেষে হয়তো টাকার পরিমাণ দিগুণ হতে পারে। এদিকে, দুদক সিলেটের উপ-পরিচালক নুর ই আলম বাদী হয়ে শাহ্‌জালাল ফাটিলাইজার প্রকল্পের কর্মকর্তা ঠিকাদারসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে সিলেটের স্পেশাল জজ আদালতে ২৬টি মামলা করেছে। এরমধ্যে ২০২১ সালের আগস্টে ১৫টি এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১১টি মামলা করা হয়। ১৪ই ফেব্রুয়ারির মামলার এজাহারে দুদক কর্মকর্তা জানান, প্রতারণা এবং জালিয়াতির মাধ্যমে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভুয়া বিল ভাউচার ও কোনোটিতে বিল ভাউচার ছাড়াই ৭১টি চেকের মাধ্যমে ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের বিভিন্ন তারিখে শাহ্‌জালাল ফার্টিলাইজার প্রকল্পের অনুকূলে জনতা ব্যাংক লিমিটেড কর্পোরেট শাখা দিলকুশা, ঢাকায় পরিচালিত হিসাব নম্বর ০০০০০৩৯৩৩০০৯৫৯৮ ও ০০০০০৩৬০০১১৭২ থেকে উত্তোলন করা হয় ১৩ কোটি ৬৭ লাখ ৪৫ হাজার ৯৫৬ টাকা। দণ্ডবিধির ৪২০/৪০৬/৪০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা তৎসহ ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় মামলাগুলো করা হয়। দুদকের মামলায় যাদেরকে আসামি করা হয়েছে তারা হলেন- শাহ্‌জালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরির হিসেব বিভাগীয় প্রধান (বর্তমানে চাকরি থেকে বরখাস্তকৃত) খোন্দকার মুহাম্মদ ইকবাল। তার মূল বাড়ি ফেনীর পরশুরামের ধনীকণ্ডা গ্রামে হলেও রাজধানী ঢাকার ৮৬/৪ সিদ্ধেশ্বরী রোড, রমনা, ঢাকায় তিনি বসবাস করেন। তিনিই হচ্ছেন এই লুটপাট ও দুর্নীতির প্রধান হোতা। এছাড়া- মামলার আসামি করা হয় ইকবালের শ্যালক মো. জামশেদুর রহমান খন্দকার। তিনি হচ্ছেন মেসার্স ডেফোডিলস ইন্ডারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী। ওই কোম্পানির সাইনবোর্ড ব্যবহার করা হয়েছে ভুয়া বিলে। ইকবালের স্ত্রী মোছাম্মাৎ হালিমা আক্তার। তিনি হচ্ছেন মেসার্স নুসরাত ট্রেডার্স, ঠিকানা ৮৬/৪ সিদ্ধেশ্বরী, রমনা, ঢাকা; এই কোম্পানির স্বত্বাধিকারী। এই কোম্পানির নামে ভুয়া বিলে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রকল্প ছিল কাগজে কলমে আর বিল চলে যেতো তাদের অ্যাকাউন্টে। এছাড়া মামলায় আসামি করা হয় শাহ্‌জালাল ফাটিলাইজার প্রকল্পের রসায়নবিদ (বর্তমানে বরখাস্তকৃত) নেছার উদ্দিন আহমদ, পিতা গিয়াস উদ্দিন আহমদ সাং পূর্ব চরমেহার, ডাকঘর বিবিরহাট, থানা রামগতি জেলা লক্ষীপুর। বর্তমান ঠিকানা হাউস নং-২/বি, ২য় তলা, রোড নং ১০/বি, সেক্টর নং ১১, উত্তরা ঢাকা। মো. হেলাল উদ্দিন প্রো. মেসার্স মা এন্টারপ্রাইজ, সাং- পুরুষোত্তমপুর, ডাক সোমপাড়া, থানা চাটখিল, জেলা নোয়াখালী, পিতা মৃত গোলাম জিলানী। বর্তমান ঠিকানা হাউস নং-২২, রোড নং-ডি সেকশন ৭ আরামবাগ হাউজিং, থানা মিরপুর, ডিএমপি, ঢাকা। মাসুদ রানা, প্রো. সানশাইন আইটি সল্যুশন। ঠিকানা মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার, লেভেল ৮, দোকান নং ৮৬১, মিরপুর, ঢাকা, পিতা মো. মফিজ উল্লাহ সাং ৬৯/৭১ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা। এর আগে ২০২১ সালের ৪ঠা আগস্ট খোন্দকার ইকবাল তার স্ত্রী হালিমা আক্তার, শ্যালক জামশেদুর রহমানসহ ওই চক্রটির বিরুদ্ধে ৩৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় আরও ১৫টি মামলা করেছে দুদক। মোট ৫২ কোটি ৩৮ লাখ ৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছে খোন্দকার ইকবাল চক্র। এ ব্যাপারে শাহজালাল ফার্টিলাইজার প্রকল্পের সাবেক হিসাব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান খোন্দকার মুহাম্মদ ইকবালের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও ফোন রিসিভ হয়নি। সিলেট জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. নুর ই আলম জানিয়েছেন, প্রাথমিক তদন্তে খোন্দকার ইকবাল, তার স্ত্রী হালিমা আক্তার, শ্যালক জামশেদুর রহমানসহ চক্রটির বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের বিপুল অবৈধ সম্পদের সন্ধানও পেয়েছেন বলে জানান। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়; শাহ্‌জালাল ফার্টিলাইজার প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের বিনিয়োগকৃত ১৪শ’ কোটি টাকার মধ্যেই বেশীরভাগ দুর্নীতি,অনিয়ম করা হয়েছে। দুদক এখনো তদন্তে রয়েছে বলে জানান তিনি।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ