স্ব-নির্ভর বাংলাদেশের স্থপতি শহীদ জিয়া

প্রফেসর জসীম উদ্দিন আহমদ, আজ থেকে ৩০ বছর আগে ৩০ মে ১৯৮১ সালে চট্রগ্রামের
সার্কিট হাউজে কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে নির্মম ভাবে শাহাদৎ বরণ
করেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ১৯৭১ সালে যে চট্রগ্রামের কালুরঘাট বেতার
কেন্দ্র থেকে প্রচারিত “আমি মেজর জিয়া বলছি” বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা
প্ৰথমে নিজে ও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে ঘোষণা করে সারা জাতিকে
উদ্বেলিত করেছিলো, মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলো, সেই
চট্রগ্রামেরই সার্কিট হাউজে আধিপত্যবাদী ও ওদের সহযোগীদের চক্রান্ত ছিনিয়ে
নিয়ে গেল এ দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে।

১৯৭১ সালের মার্চের আগুন ঝরা দিনগুলোতে এ দেশের ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক,
শ্রমিক, ব্যবসায়ী, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারীসহ দেশের আপামর জনসাধারন
যখন দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, সে সময়
পাকিস্তানের ক্ষমতার মসনদে আসীন হওয়ার স্বপ্নে বিভোর আওয়ামী নেতৃত্ব
সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দিনের পর দিন ক্ষমতা হস্তান্তরের আপোষ
আলোচনা চালিয়ে গেছেন। এমনকি ৭১ সালের ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগের প্রেস
ব্রিফিংয়ে আলোচনা সন্তোষজনক ভাবে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানানো হলেও ২৫
মার্চের কালো রাতে বাংলাদেশের জনগণের ওপর শুরু হলো পাকিস্তানী হানাদার
বাহিনীর ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ। আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ
ঘটনা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রায় অপ্রস্তুত একটি জাতির ওপর নেমে
এলো হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুরতম, পূর্ব পরিকল্পিত আক্রমন। বঙ্গবন্ধুকে

পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেফতার করে। আওয়ামী লীগের অন্যান্য শীর্ষ পর্যায়ের
নেতৃবৃন্দের বেশির ভাগই তাড়াহুড়ো করে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয়ের জন্য ছুটে
গেলেন। ঘটনার নিষ্ঠুরতা এবং নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে কোন নির্দেশনা না পেয়ে
দেশবাসী যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, দিশেহারা, সেই সময়ই মেজর জিয়ার কন্ঠে
প্রচারিত হয়েছিলো শ্বাধীনতার ঘোষণা। দেশের কোটি কোটি জনগনের মতই আমিও
২৭ মার্চ জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম, অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।
আজকাল স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়ার নামকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা চলছে,
কিন্তু ইতিহাসের বাস্তবতাকে কেউ কোন দিন মুছে ফেলতে পারেনা।

ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দুই দুইবার শহীদ জিয়া তাঁর উপর অর্পিত ঐতিহাসিক দায়ীত্ব
নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। প্রথমটি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান আর দ্বিতীয়টি
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর
দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখা এবং বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে
মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা। এই দুইটি মহান দায়ীত্ব পালনেই তিনি পুরোপুরি
সফল হয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন উন্নয়নের রাজনীতির প্রবক্তা। রাষ্ট্র
পরিচালনার দায়ীত্ব গ্রহণের পর পরই দেশের উন্নয়নে তাঁর প্রশাসনের সকলের
প্রয়াসকে একতাবদ্ধ করার প্রচেষ্টা গ্রহন করেন। তিনি বাংলাদেশী
জাতীয়তাবাদীবাদের বিকাশ এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য
সকল দেশ প্রেমিক জনগনের একটা বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়াস নেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়া তাঁর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্ৰবন্ধে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ
করেছেন – “আমাদের মূল লক্ষ্য তথা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিমূল রয়েছে যে
শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে
জনগনের সম্মিলিত অংশ গ্রহণের মাধ্যমে। শোষণমুক্ত সমাজ বলতে মূলত বুঝায়
ধর্ম, বর্ন ও গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা,
বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার মৌলিক চাহিদা পূরণের পর্যাপ্ত
ব্যবস্থা। ………… এ কথা স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল

লক্ষ্য হচ্ছে একটি শোষণমুক্ত সমাজ যা অত্যন্ত বাস্তব ও প্রগতিশীল একটি
সমাজ – যেখানে থাকবে সমতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার।“

এই শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯ দফা কর্মসূচি
প্রণয়ন করেছিলেন। এই কর্মসূচির প্রথমটিতেই তিনি দেশের স্বাধীনতা, অখন্ডতা
ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার শপথ ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি তাঁর অন্য একটি
কর্মসূচিতে সর্ব উপায়ে নিজেদেরকে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে
তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। অন্য দু’টি কর্মসূচিতে তিনি “সর্বোচ্চ
অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীন তথা জাতীয় অর্থনীতিকে
জোরদার করা” এবং “ দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং কেউ যাতে ভুখা না
থাকে তার ব্যবস্থা করার” অঙ্গীকার করেছিলেন। এই জন্যই প্রেসিডেন্ট জিয়া
কৃষির আধুনিকায়নের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুন করার প্রচেষ্টা গ্রহণ
করেছিলেন। তিনি দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে অনেক সাফলতা
অর্জন করেছিলেন।
স্বাধীনতার পরের কয়েক বছর তৎকালীন সরকারের অব্যবস্থাপনার ফলে কৃষি
উৎপাদনে দারুন নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ১৯৭৪ সনে স্মরনাতীত কালের এক মহা
দুর্ভিক্ষের ফলে কয়েক লক্ষ লোকের প্রাণহানি হয়। খাদ্য উৎপাদন ঘাটতি,
বিতরণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া এবং শাসক দলের নেতাকর্মীদের সীমাহীন দুর্নীতিই এই
দুর্ভিক্ষের কারন বলে দেশি বিদেশি পর্যবেক্ষকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
এখানে শুধু বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য চাল অর্থাৎ ধান উৎপাদনের সে সময়কার
কয়েক বছরের চিত্র তুলে ধরলে জিয়ার কর্মসূচি বাস্তবায়নের অগ্রগতির প্রমান
পাওয়া যায়। ১৯৭৪-৭৫ সালে দেশে ধান উৎপাদনের মোট পরিমান ছিল ১ কোটি ১১
লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা
প্রবর্তন অর্থাৎ জমিতে সার ও সেচের মাধ্যমে পানির যথাযথ প্রয়োগের ফলে
কৃষি উৎপাদন বেশ বৃদ্ধি পায়। তাই ১৯৮০-৮১ সালে দেশে মোট ধান উৎপাদনের
পরিমান এসে দাঁড়ায় ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার মেট্রিক টনে, যা ৭৪-৭৫ সালের
ভিত্তিতে ১২৩%। ধান উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বাজারেও এর শুভ প্রভাব পড়ে।
১৯৭৪-৭৫ সালে যেখানে প্রতি কেজি চালের মূল্য ছিল ১০ টাকার বেশি, তা ১৯৮০-৮১

সালে ৫.৫৫ টাকায় নেমে আসে। আর ফলে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে “দু’বেলা
দু’মুঠো ভাত খাওয়ার” স্বপ্ন বাস্তবে পরিনত হয়েছিল। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর
রহমানের আমলে শুধু যে ধানের উৎপাদন বেশ বেড়েছিল তাই নয়, অন্যন্য কৃষিজাত
পণ্য- আখ, গম, শাক-সবজি ইত্যাদির উৎপাদনও বেশ বেড়েছিল।

শহীদ জিয়া দেশের উন্নয়নে যে গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার
প্রমান আগের বাকশালী সরকারের আমলের তুলনায় জি ডি পি তাঁর আমলে ৩.৩৩ গুন
বৃদ্ধি পেয়েছিলো। একটি দেশ প্রেমিক, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বে দেশ পরিচালনা
হয়েছিল বলে তা সম্ভব হয়েছিল। শহীদ জিয়াউর রহমান একটি আশাহীন জাতির মাঝে
আশার সঞ্চার করতে পেরেছিলেন। তাই জনগণের হৃদয়ের মণিকোঠায় তাঁর নাম
চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে রইবে।

প্রেসিডেন্ট জিয়া তাঁর ১৯ দফা কর্মসূচিতে “প্ৰশাসন, উন্নয়ন ব্যবস্থা
বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার” অঙ্গীকার ব্যক্ত
করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন প্রশাসনকে জনগনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে। এই
লক্ষে তিনি চারনের মত সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট জিয়া গ্রামীন জনগণকে উদ্ধুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করতে এবং প্রশাসনকে
জনগনের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য যে ভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তা
দেখে অভিভূত হওয়ার কোন বিকল্প ছিলনা। এখানে আমি একটি ব্যক্তিগত স্মৃতির
উল্লেখ করতে চাই।
১৯৭৭ সালের প্ৰথম দিক থেকেই “স্ব-নির্ভর বাংলাদেশ” গড়ার প্রয়াসে
জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রত্যন্ত
অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি “আদর্শ গ্রাম” গড়ার এক কর্মসূচি হাতে নেন।
নরসিংদীর শিবপুর থেকে এই কর্মসূচি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত নেন।
শিবপুর ও আশে পাশের বিরাট অঞ্চলে আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে কৃষক

সমিতির শক্তিশালী সংগঠন। মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী দেশের স্বাধীনতা ও
সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে ইতিমধ্যেই জিয়াকে অকুন্ঠ সমর্থন প্রদান করেছেন।
শিবপুর, মনোহরদী, নরসিংদী, রায়পুরাসহ এই অঞ্চলের মান্নান ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন
কৃষক সমিতির নেতা কর্মীরাও প্রেসিডেন্ট জিয়াকে অকুন্ঠ সমর্থনের সিদ্ধান্ত
নেয়। তাই শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজ মাঠের সভা থেকে “আদর্শ গ্রাম” কর্মসূচি
ঘোষণার পরিকল্পনা নেন প্রেসিডেন্ট। এ জন্য মান্নান ভাইসহ স্থানীয় নেতাদের
সঙ্গে আলাপ আলোচনার জন্য এন এস আই-এর তৎকালীন ডি জি হাকিম সাহেবকে
শিবপুরে এসে সভার প্রস্তুতির কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দেন। হাকিম সাহেব
শিবপুরে একাধিকবার এসে মতবিনিময় করেন। সিদ্ধান্ত হলো ডিসেম্বরের শেষ দিকে
জনসভা অনুষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রধান অতিথি ও বক্তা। স্থানীয় একজন
ইউনিয়ন কাউন্সিল নেতা সভায় সভাপতিত্ব করবেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নির্দেশ
মোতাবেক ওই সভায় মান্নান ভাই এবং স্থানীয় ৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও নেতৃবৃন্দ,
মোট ৭ জনকে সাতটি নির্ধারিত বিষয়ের ওপর বক্তব্য দেওয়ার জন্য ঠিক করা
হলো। আমিও একজন বক্তা হিসেবে মনোনীত হই, আমার বক্তব্যের বিষয় ছিলো
“স্ব-নির্ভর দেশ গঠনে যুব সমাজের ভূমিকা”। অন্যান্য করেকটি বিষয় ছিল “
ভিখারির হাতকে কে কর্মীর হাতে পরিণত করতে হবে”, “আমাদের সাত কোটি মুখ
থাকলেও ১৪ কোটি হাত আছে”, “সাগরের নিচের সম্পদ আহরণ করতে হবে” ইত্যাদি।

শিবপুরে ২ দিনের সফরে আসার কার্যক্রম গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। শহীদ
আসাদ কলেজ মাঠে বিরাট মঞ্চ তৈরি করা হলো। মঞ্চে ৯ টি আসন, প্রেসিডেন্ট
জিয়ার আসন, সভাপতি এবং অন্য ৭ জন বক্তার আসন। আগের দিন ঢাকা থেকে
কয়েকজন সচিব আসলেন। তারা সভার প্রস্তুতি নিয়ে আমাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে
বসলেন। তারা প্রেসিডেন্টের কাছে প্রিয় হওয়ার জন্য মান্নান ভাই ছাড়া অন্য ৬
জন স্থানীয় বক্তার পরিবর্তে ৬ জন সচিব বক্তব্য দেবেন বলে জানান। আমাদের
মন স্বভাবতই খারাপ হয়ে গেল।

সভার দিন সকাল ১০ টার দিকে নরসিংদীর পরের রেল স্টেশন মেথিকান্দায় সফর
সঙ্গীদের নিয়ে নামলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। সাথে কয়েকজন সচিব ও উচ্চ পদস্থ

আমলা। তিনি ওখান থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করলেন। পথে বিভিন্ন স্থানে থেমে
কোথাও কোন কৃষকের বাড়ি, কখনো কোন অবস্থাপন্ন ব্যক্তির বাড়ি যান। সবাইকে
বেশি বেশি করে চাষাবাদ করা এবং কোন জমি যাতে অনাবাদী না থাকে সেজন্য
নির্দেশনা দিতে থাকেন। একবার এক বিধবা বুড়ির পর্ণ কুটিরে ঢুকেন। বলেন, “ মা
একটু পানি খাবো”। বুড়ি তাড়াতাড়ি টিউবওয়েলের পানি একটি পরিষ্কার গ্লাসে নিয়ে
আসলেন, সাথে কিছু মুড়ি। জিয়া বুড়িকে বললেন,” মা এই অঞ্চলে তো খুব ভালো লেবু
হয়। বাড়ির পাশের পতিত জায়গায় লেবুর গাছ লাগাবেন। পরের বার আসলে আপনার
গাছের লেবুর শরবত খাবো।“ বুড়ির খুশির সীমা থাকেনা।
এক অবস্থাপন্ন কৃষকের বাড়িতে যান। বাড়ির আঙিনায় ডাব গাছ। তাড়াতাড়ি ডাবের
পানি ও কলা খেতে দিলেন। জিয়া খুব খুশি হলেন এবং বললেন “এক ইঞ্চি জমিও
অনাবাদি রাখা যাবেনা। বেশি বেশি করে তরী তরকারি চাষ করবেন, আপনাদের
অঞ্চলের সবজির সুনাম সারা দেশে।“ এই ভাবে প্রায় ১৪ কিলোমিটার অঞ্চল হেঁটে,
বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শন করে এবং মাঝে মাঝে স্থানীয় জনগণের
সঙ্গে কথা বলে, তাদেরকে অনুপ্রাণিত করে সভা শুরুর নির্ধারিত সময় বিকেল
চারটার ২/৩ মিনিট আগে সভা স্থলে এসে পৌঁছে মঞ্চে ওঠে যান। মঞ্চে ইতিমধ্যেই
২/৩ জন সচিব আসন গ্রহণ করেছিল, আর তাঁর সাথে থাকা হাটায় অনভ্যস্ত
ঘর্মাক্ত শরীরের আরও ৪ জন সচিব মঞ্চে উঠলেন। তিনি তাকিয়ে বললেন,
আপনারা এখানে কি করছেন? যান নীচে নেমে জনগনের সাথে বসুন, আমি এখানকার
জনগনের কথা শুনতে এসেছি। স্থানীয় যাদের বক্তব্য দেওয়ার কথা তারা মঞ্চে
আসুন। আমরা মঞ্চে উঠে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আসন গ্রহণ করি এবং পূর্ব নির্ধারিত
বক্তারা তাদের জন্য নির্ধারিত বিষয়ের ওপর বক্তব্য রাখি। সে দিনের স্মৃতি আজও
আমাকে অনুপ্রাণিত করে।

রাতে শিবপুরের ছোট ডাক বাংলোতে তিনি রাত্রিযাপন করেন। রাতে খাবারের জন্য পোলাও,
মুরগির রোস্ট,খাসির রেজালা, করল্লা ভাজি, দই মিষ্টি ইত্যাদির আয়োজন। তিনি
খাবারের এই সমারোহ দেখে অখুশি হলেন, বললেন এই অঞ্চলে তো ভাল করল্লা হয়,
আপনারা করল্লা ভাজি, সবজি আর ডাল রান্নার ব্যবস্থা করেননি? প্রেসিডেন্ট জিয়া
করল্লা ভাজি, সবজি আর ডাল দিয়েই রাতের খাবার খেলেন আর বললেন পোলাও ও
অন্যান্য উপাদেয় খাবারগুলো আমার সাথের লোকজন এবং আপনার খেয়ে নেন। ভবিষ্যতে

এ ধরনের দামী খাবারের আয়োজন করে অপচয় করবেননা। প্রেসিডেন্ট জিয়া কত সাধারণ
খাবার গ্রহণ করতেন তা সেই দিন নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হতো। ওই
রাতে দীর্ঘ সময় উনি আমাদের সঙ্গে মত বিনিময় করেন এবং দেশ গড়ার কাজে
আমাদেরকে আরো বেশি করে আত্মনিয়োগের আহবান জানান।

কাজী জাফর আহমদ জিয়ার মন্ত্রিসভায় শিক্ষা মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। তিনি গনমুখী
শিক্ষানীতি চালুর জন্য একটি কমিশন গঠন করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রফেসর সৈয়দ সফিউল্লাহ তখন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের
মহাসচিব। কাজী জাফরের খুবই ঘনিষ্ঠ। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রফেসররা
জাতীয় বেতন স্কেলের ৪ ধাপে ছিলেন। সফিউল্লাহ ভাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষক নেতাদের নিয়ে কাজী জাফর এবং প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে কয়েকবার বৈঠকের
পর সিদ্বান্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সিনিয়র মোস্ট অধ্যাপক জাতীয় বেতন স্কেলের
সর্বোচ্চ ধাপে বেতন পাবে। সার্কুলার জারির আগে কয়েকজন সিনিয়র সচিব প্রেসিডেন্ট
জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, স্যার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতন
আমাদের চেয়ে এক টাকা হলেও কম করে প্রজ্ঞাপন জারীর নির্দেশ দিন। জিয়া হেসে
বললেন, আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারি করুন, আপনাদের এক টাকার এত
প্রয়োজন হলে আমি নিজে প্রতি মাসে আপনাদেরকে এক টাকা করে দিয়ে দেব। সচিবরা
ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসে। শহীদ জিয়া মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন আমলারা
জনগনের সেবক, প্রভু নয়।
আমি ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ এর জোট সরকারের কার্যক্রম বেশ কাছে থেকে
দেখার সুযোগ পেয়েছি। প্রেসিডেন্ট জিয়ার তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে অদ্ভুত ক্ষমতা
ছিলো, তা পরবর্তী কালে অনেকটা অনুপস্থিত ছিল, বিশেষত সরকারগুলো অনেকটা আমলা
নির্ভর হয়ে পড়েছিলো।

শহীদ জিয়ার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে শহীদ জিয়ার
আদর্শকে পুরোপুরি অনুসরণ করা। শহীদ জিয়া যুগ যুগ ধরে, অনন্ত কাল ধরে
বাংলাদেশের আপামর জনগনের মনে চির ভাস্বর, চির অম্লান হয়ে থাকবে। মহান
আল্লাহ তাঁকে বেহেস্তের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করুন। আমীন!

প্রফেসর জসীম উদ্দিন আহমদ
সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা, বাংলাদেশ

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ