হেমাশ্রমের ফরাসিনী লালন সাধকের অনুসন্ধিৎসা

 জাহিদ হোসাইন খান ,কুষ্টিয়া শহর থেকে ৫৩ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম প্রাগপুর।পাশেই মাথাভাঙা নদী। দূর থেকে স্রোতহীন মনে হয় নদীকে। বর্ডারে তাকালেই চোখে পড়ে শিমুল গাছ, পাতাহীন গাছের পুরোটাই যেন শিমুলে রক্তাক্ত। বর্ডারের সীমান্তরক্ষী বললেও ভুল হবে না শিমুলগাছগুলোকে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষা এই গ্রামে লালন দর্শন কেন্দ্র হেমাশ্রম।

এখানে সময় যেন ইচ্ছে করেই ধীরে ছোটে। সেই সাত সকালের সূর্য অনেকটা দেরি করেই সন্ধ্যায় ঘুমোতে যায়। প্রবীণ লালন অনুরাগী ও বাউল সাধক নহির শাহর আশ্রমের নাম হেমাশ্রম। এই আশ্রমেই ১০-১১ মার্চ আয়োজন করা হয় সাধুসঙ্গ। রওশনারা ও রশিদা ফকিরাণীর স্মৃতি বার্ষিকী স্মরণে হেমাশ্রমে এই সাধুসঙ্গেই বসেছে ৪২তম সাধুসঙ্গ। লালন অনুরাগী ও বাউল দর্শনে আগ্রহী অংশ নেন এই সাধুসঙ্গে। দুর-দূরান্তের এলাকা থেকে ছুটে আসেন লালন অনুরাগীরা। যদিও করোনার কারণে এবারের আয়োজন ছিল সংক্ষিপ্ত। 

শিমুলের সঙ্গে লালনসন্ধান

এক বিশাল শিমুল গাছের নিচে বিশাল বাগানজুড়ে অবস্থিত হেমাশ্রম। সঙ্গ শুরুর সকাল থেকেই হেমাশ্রমে আসন পেতে বসেন খেলাফতধারী বাউলরা। বাউলমতের নানান বিষয় নিয়ে চর্চা চলে দুদিনের নানা আয়োজনে। সাধুসঙ্গ ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। নিয়মিতই ফি-বছর এই সাধুসঙ্গের আয়োজন করা হচ্ছে। বাউল দর্শনের বহুমাত্রিকতা জানতে এবারের আয়োজনে আমরা ঢাকা থেকে ছুটে যাই তিনজন আগ্রহী। আমাদের দলের সদস্য ছিলেন লেখক ও শিল্পী আইরিন খান, ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফেলো নিলয় দাশ। 

জীবনের অনন্য অর্থের খোঁজে

সাইঁজির বাণী আর সুরের মাঝে জীবনের দর্শনকে বোঝার চেষ্টা ছিল আমাদের। লালন সাঁইজির সঙ্গে তাঁর উত্তরাধিকার সম্পর্ক–লতিকার পর্যায়ক্রমটা এই রকম: ফকির লালন শাহ, ভোলাই শাহ, কোকিল শাহ, লবান শাহ ওরফে আব্দুর রব শাহ, তারপরই ফকির নহির শাহ। লালনের আদর্শ কিভাবে বিশ্বমানবতার শান্তির বাণী হিসেবে প্রচারিত হচ্ছে তার গুরুত্ব জানতে সুফিশিল্পী ও গবেষক আইরিন খান চেষ্টা করেন। বিবিসি বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জরিপে ১২ নম্বরে বাউল সাধক ফকির লালন শাহ। লালন ফকির নিজ ভাবনায় বিশ্বাস করতেন সব মানুষের মধ্যেই বাস করে এক মনের মানুষ। সেই মনের মানুষের সন্ধান মেলে আত্মসাধনার মাধ্যমে। দেহের ভেতরেই সেই মনের মানুষ অচিন পাখি হিসেবেই বাস করে।
 
জীবনের প্রেক্ষিত বুঝতে যত অনুসন্ধান

“যা আছে ভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে” – এই ছিল লালনের দর্শন। বৈষ্ণব সহজিয়া, বৌদ্ধ সহজিয়া ও সুফিবাদের সংমিশ্রণে মানবগুরুর ভজনা, দেহ-কেন্দ্রিক সাধনাই লালন প্রদর্শিত বাউল ধর্মের মূলমন্ত্র। সেই মন্ত্রের প্রেক্ষিত জানার প্রচেষ্টা ছিল আমাদের। আমাদের সঙ্গ দেন ফরাসি লালন গবেষক ও সাধক দেবোরা কিউকারম্যান। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমে বাংলাদেশে আসেন দেবোরা। বর্তমানে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে বসবাস করেন। তার কাছেই আমরা লালনের ভাব ও আদর্শের বৈশ্বিকমাত্রা সম্পর্কে জানতে পারি। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে আত্মিক সংযোগ ও সম্পর্কে নানামুখি সম্পর্ক ও লালনের কথার তাৎপর্য নিয়ে দেবোরা আমাদের মধ্যে কৌতুহল তৈরি করে। লালন সাঁইজির দর্শনকে মেনে চলে কিভাবে আত্মার সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা যায়, নিজের মধ্যকার নানান প্রশ্নের অনুসন্ধান করা যায় তা নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেন এই ফরাসি গবেষক। ঈশ্বরের ভাবনা, নানান সৃষ্টি, মানুষের জীবনের মহত্ব, মহাকালের রহস্যের নানান প্রশ্নের উত্তর যেপথে আছে তার অনুসন্ধানই মানবজীবনকে মহান করে তোলে বলে তার ধারণা।

কৌতুহল থেকেই বেরিয়ে পড়া

প্রচুর বই পড়েন দেবোরা কিউকারম্যান। নানান দেশ ও সমাজ ঘোরার গল্প আছে তার ঝুলিতে। প্যারিসের পথঘাট নিয়ে যেমন গল্প করতে করতে আমাদের প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের সামনে নিয়ে যান। আবার তেমনি বাংলাদেশ-ভারতের নানান আশ্রম-ঐতিহাসিক স্থানের গল্প দারুণ বাংলায় আমাদের শোনান দেবোরা।লালন সাঁইজির দর্শনকে সাধনার মাধ্যমে নিজের কৌতুহলকে জানার চেষ্টা করছেন তিনি। সৃষ্টির নানা বিস্ময়কে জানতে দেবোরার লালনচর্চা। লালন সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকেই তাঁর কুষ্টিয়ায় আসা। গুরুজি নহির শাহর কাছ থেকেই শিষ্যত্ব নিয়ে সাধুসঙ্গে আছেন তিনি। প্রাগপুরের শিশুদের কাছে খুব পরিচিত তার নাম। এই শিশুদের পৃথিবীর গল্প শোনান দেবোরা। সেই গল্পে আছে অসংখ্য প্রশ্ন, অসংখ্য জিজ্ঞাসা। সেই অনুসন্ধিৎসু জিজ্ঞাসার গল্প নিয়েই আমরা ফিরে আসি ইট-পাথরের এই শহর ঢাকাতে।

লেখক: জাহিদ হোসাইন খান, গবেষক ও মানসিক স্বাস্থ্য অধিকারকর্মী
 

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ