বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জোটে যোগ দিতে চায় বাংলাদেশ

ইসমাইল আলী: ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর আত্মপ্রকাশ করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জোট রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি)। আসিয়ানভুক্ত ১০টি সদস্য দেশ ছাড়াও চীন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ড এ ফোরামে যোগ দিয়েছে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা ও ৩০ শতাংশ জিডিপি ধারণক্ষমতা-সম্পন্ন আরসিইপিকে বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক ফোরাম হিসেবে অভিহিত করা হয়।

যদিও এ ফোরামের সদস্য হতে পারেনি বাংলাদেশ। এজন্য বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জোট আরসিইপিতে যোগ দিতে চায় বাংলাদেশ। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

সরকারের এক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ২০ বছরের মধ্যে আরসিইপিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য অর্থনীতি চালু হবে। কিন্তু বাংলাদেশকে এ ফোরামে যোগদানের বিষয়ে কূটনৈতিকভাবে অনুরোধ করা হয়নি। এদিকে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য মূলত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নমুখী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি মোট বাণিজ্যের ১০ শতাংশ। এছাড়া চীনের বাজারে ৯৭ শতাংশ রপ্তানি দ্রব্যের ওপর বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা অর্জন করেছে। তবে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও বাণিজ্যিক পরিসর বৃদ্ধি বিবেচনা করে আরসিইপিতে বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

বাণিজ্যনির্ভর এ আঞ্চলিক ফোরাম কার্যকর হতে আরও তিন বছর লাগবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আইন পরিষদে অনুমোদন গ্রহণের জন্য এই সময় নেয়া হয়েছে। তবে পুরোপুরিভাবে কার্যকর হতে ১০-১৫ বছর প্রয়োজন হবে বলে সদস্য রাষ্ট্রগুলো সম্মত হয়েছে। তবে এই আঞ্চলিক ফোরামে শক্তিধরের পাশাপাশি দুর্বল অর্থনীতির রাষ্ট্রও রয়েছে। এ রাষ্ট্রগুলো হলোÑকম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম, যাদের সংক্ষিপ্তভাবে বলা হয় সিএলএমভি কান্ট্রিজ। তাদের এই বৃহৎ অর্থনৈতিক ব্লকের ভেতরে দীর্ঘ সময়ের মধ্য দিয়ে একীভূত করতে এই আঞ্চলিক ফোরামকে অতিরিক্ত সময় নিতে হচ্ছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, মিয়ানমার সরকার আরসিইপিতে যোগ দেয়ায় লাভবান হবে। অন্যান্য সদস্য দেশকে যেখানে ৬৫ শতাংশ দ্রব্যের ওপর শুল্কবিহীন সুবিধা দিতে হবে, সেখানে সিএলএমভি দেশগুলো মাত্র ৩০ শতাংশ দ্রব্যের ওপর শুল্কবিহীন সুবিধা দেবে। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় তাদের এই সুবিধা দেয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ তার সমপর্যায়ের অর্থনীতি হিসেবে মিয়ানমার ও ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে বিরূপ বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে।

এদিকে ভারত অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক স্বার্থে এই ফোরামে যোগদান থেকে বিরত রয়েছে। তারা মনে করছে চীনের স্বল্প মূল্যের তৈরিকৃত জিনিস ভারতে অতি সহজে প্রবেশ করবে। ভারতের ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অবলুপ্তির হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা থেকে ভারত এ আঞ্চলিক ফোরাম থেকে নাম প্রত্যাহার করেছে। এছাড়া আরসিইপিতে চীনের প্রভাব থাকার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবসায়ী সংগঠন ‘কনফেডারেশন অব অল দ্য ইন্ডিয়া ট্রেডার্স’ (সিএআইটি) তিন হাজার চীনা দ্রব্য বয়কটের দাবি জানিয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, আরসিইপিতে যোগদানের বিষয়ে বাংলাদেশ কৌশলগত অবস্থান নিতে চায়। কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা আশিয়ানভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আমদানি-নির্ভর। সরকার তার মোট বার্ষিক রাজস্ব আয়ের ৩০ শতাংশ আমদানি শুল্ক এ অঞ্চল থেকে পেয়ে থাকে। এর মধ্যে ২৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে বেসরকারি পর্যায়ে চীন থেকে আমদানিকৃত দ্রব্যের ওপর আরোপিত শুল্ক বাবদ।

এদিকে সিএলএমভি দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশকে বাণিজ্য প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হতে পারে। কারণ ওই দেশগুলো শুল্কবিহীন বাণিজ্যিক সুবিধার কারণে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে যাবে। সেখানে বৈদেশিক বিনিয়োগও বেশি আসবে। বাংলাদেশ সেই মাত্রায় বৈদেশিক বিনিয়োগ পাবে না। বিশেষ করে বাংলাদেশের মূল প্রতিযোগিতা হচ্ছে ভিয়েতনামের সঙ্গে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় হলেও রপ্তানি আয়ের দিক থেকে ভিয়েতনাম এগিয়ে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় যেখানে ৪০ বিলিয়ন ডলার সেখানে ভিয়েতনামের বার্ষিক রপ্তানি আয় ২৫৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের রপ্তানি মূলত তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল হলেও ভিয়েতনাম রপ্তানি বহুমুখীকরণের মাধ্যমে শুল্কবিহীন বাণিজ্যে অনেক এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশ্লেষকরা মতামত প্রকাশ করেন যে, বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ আসিয়ান ও আরসিইপির সদস্য হওয়ার যোগসূত্র পেতে পারে। বিমসটেকের থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের মাধ্যমে বাংলাদেশ কর্তৃক আরসিইপিতে যোগদানের পথ উš§ুক্ত হতে পারে।

প্রতিবেদনটিতে ১৪টি পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আগামী ১০ বছরে চীন কর্তৃক ২২ ট্রিলিয়ন (লাখ কোটি) ডলার সমমূল্যের দ্রব্য আমদানি ঘোষণার পাশাপাশি আরসিইপির আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা আশিয়ানভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এ জোটে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ ফোরাম আঞ্চলিক নৈকট্যে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে অভিন্ন স্থানে নিয়ে এসেছে। জাপান ও অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জোটের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও অর্থনৈতিক দিক থেকে চীন প্রভাবিত এ ফোরামে যোগ দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ড চীনবিরোধী পশ্চিমা-অনুকূল হিসেবে পরিচিত। তবে তারাও চীনের নেতৃত্বে সংগঠিত আঞ্চলিক ফোরামে যোগদান থেকে বিরত থাকেনি।

বিশ্লেষকরা আরসিইপিকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বৈশ্বিক মহামারি-পরবর্তী অতি প্রয়োজনীয় একটি অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা মনে করেন, বৈশ্বিক মহামারি বিশ্বের অর্থনীতিতে একটি ব্যাপক অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। সে প্রেক্ষাপটে আরসিইপির সদস্য রাষ্ট্রগুলো চীনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত থেকে বাণিজ্যিক সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি তাড়িত করেছে।

যদিও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। কারণ বাংলাদেশের শিল্প স্থাপনার মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশ সিএমএসএমইর (কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ) অন্তর্ভুক্ত এবং দেশের মোট কর্মশক্তির ৩৫ শতাংশ এর সেক্টরের সঙ্গে জড়িত। তাই উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর উৎপাদিত পণ্যের অবাধ প্রবেশাধিকার পেলে বাংলাদেশের উদীয়মান শিল্পের সম্ভাবনা ব্যাহত হতে পারে।

এদিকে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজারে প্রবেশের সুবিধা হারানোর আগে তিন বছরের অন্তর্বর্তীকালীন সময় অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে সময় দেয়া হবে। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য বিস্তৃত করার জন্য বিশ্বের সর্ববৃহৎ আঞ্চলিক ফোরাম আরসিইপিতে যোগদানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

পর্যালোচনায় কূটনৈতিক প্রভাবের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, চীন প্রভাবিত আরসিইপিতে যোগ দিলে বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওই দুই রাষ্টের সঙ্গে সম্পর্কে সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব যাতে না পড়ে, সে বিষয়ে আগাম কূটনৈতিক বোঝাপড়া সম্পন্ন করা সমীচীন হবে।

এদিকে আরসিইপিতে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে চীন ও জাপান বাংলাদেশের জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, চীন বাংলাদেশকে বাণিজ্য ও অবকাঠামোগত বিনিয়োগের দিক থেকে কৌশলগত মিত্র মনে করে। অন্যদিকে জাপান তার বিগ-বি কৌশলে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মনে করে। এ লক্ষ্যে চীন ও জাপানের সঙ্গে এ বিষয়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ কার্যকর হতে পারে। পাশাপাশি আরসিইপির বাইরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় এফটিএ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এসব বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। আর ভারত, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং এশিয়ান হাইওয়ের ফলপ্রসূ বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ নিতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ