অর্থ পাচারকারী কারা এরা কি আশপাশেই, আর্থিক খাতে অনিয়ম নিয়ে সংসদে এমপিদের প্রশ্ন

দেশের আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থাপনা ও নানা ধরনের অনিয়ম নিয়ে জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কয়েক জন সংসদ সদস্য। রাষ্ট্রপতির ভাষণের ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর গতকাল মঙ্গলবার আলোচনায় অংশ নিয়ে ক্ষুব্ধ এই সদস্যরা জানতে চেয়েছেন—অর্থ পাচারকারী ও এসব লুটেরা কারা? তাদের পরিচয় কী? তারা কি দলে, না সরকারে, নাকি সরকারের আশপাশে? সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা নিরলস পরিশ্রম করলেও আর্থিক খাতকে পিতামাতার অবাধ্য সন্তানের সঙ্গে তুলনা করে তারা বলেছেন, আর্থিক খাতকে কোনোভাবেই সোজা পথে আনা যাচ্ছে না।

 

 

 

আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে তিনি বলেন, এই লুটেরা কারা? এরা কী দলে না আশপাশেই? এদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন জানতে চাই। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি আয়ের তথ্যে ‘গরমিলের’ অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, সরকারের এ দুটি প্রতিষ্ঠানের পাঁচ বছরে রপ্তানি আয়ের যে গরমিল, তা দিয়ে ছয়টি পদ্মা সেতু করা সম্ভব। ইপিবির হিসাবে গত ৫ বছরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রপ্তানি আয় ৮০ বিলিয়ন ডলার। ইপিবির তুলনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০ বিলিয়ন ডলার কম। এই হিসাবে পাঁচ বছরে লাপাত্তা হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথায় আছে? আদৌ আছে কি না, তা জানেন না নীতিনির্ধারকেরা।

 

 

 

ফখরুল ইমাম আরো বলেন, দেশে ধনীদের আয় যেভাবে বাড়ছে, দরিদ্রদের আয় সেভাবে বাড়ছে না। এর ফলে আয়-ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ দরিদ্র। প্রায় ২ কোটি অতিদরিদ্র। তিনি বলেন, এখন শোনা যাচ্ছে, বিদ্যুেকন্দ্রে কয়লা ব্যবহার করা হবে না। তাহলে এত দিন এত আন্দোলন চলল কেন? এর অর্থদণ্ড কত? চীনের সঙ্গে ২৭টি সমঝোতা স্মারকে সাড়ে ৩৭ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের ঘোষণা এসেছে। বাস্তবে এর সামান্যই এসেছে বাংলাদেশে। কত এসেছে তা জানতে চাই। দেশের বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির বিরাট অভিযোগ উঠেছে। বৃহত্ প্রকল্পের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে কি না, জানতে চাই।

 

 

 

জাপার আরেক এমপি পীর ফজলুর রহমান আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। দুর্নীতি হলে সবার আগে রাজনীতিবিদদের কলুষিত করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশে বেশি টাকা পাচার করছেন। কোন কোন কর্মকর্তা অর্থ পাচার করছেন, এটা দেখা দরকার। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী অনেক কাজ করছেন। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক সেক্টর পিতামাতার বখে যাওয়া সন্তানের মতো। অবাধ্য সন্তানের মতো। সরল পথে আনা যাচ্ছে না। হাইকোর্টও বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ঠগবাজ, প্রতারকদের আশ্রয় দিচ্ছেন। এক মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই পর্যবেক্ষণ এসেছে। পিপলস লিজিং কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তবে পি কে হালদারের বান্ধবীরা সুখে আছেন। পি কে হালদারের অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত, যারা তার আশপাশে ছিলেন, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

 

 

 

আগের দিন সোমবার রাষ্ট্রপতির ভাষণের ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে সংরক্ষিত আসনে বিএনপি দলীয় সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, লুটের এক ‘টেক্সটবুক এক্সাম্পল’ এখন বাংলাদেশ। লুটের টাকার বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়ে তৈরি হয় বেগমপাড়া কিংবা সেকেন্ড হোম। গত এক যুগে জানা-অজানা লুটের ফল হয়েছে বাংলাদেশে কোটিপতির বাম্পার ফলন। ২০০৯ সালে কোটিপতি ছিলেন ২১ হাজার ৪৯২ জন। ২০২০ সালে সেটি দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ৪৮৮ জনে। ব্যাংকের এই হিসাবের বাইরে আছেন আরো বহু কোটিপতি। বিশ্বে ২৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক হিসেবে অতিধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ প্রথম আর ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ তৃতীয়, কিন্তু বিশ্বে দরিদ্র মানুষের সংখ্যায় বাংলাদেশ পঞ্চম।

 

 

 

রুমিন ফারহানার বক্তব্যের সমালোচনা করে গতকাল পীর ফজলুর বলেন, ‘উনি বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ খাদ্য পাচ্ছে না। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, বাংলাদেশে কেউ অনাহারে নেই, ওনার কথা মিথ্যা।’ টিকা নিয়ে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, প্রথমে বলেছে ভ্যাকসিন আসবে না। এখন যখন এলো, বলছে তারা নেবেন না। আগে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। সংকটের সময় তারা বলে ‘পেহেলে আপ’। ১/১১-এর সময়ও তারা এমন করেছে, এখনো করছে। টিকা নিয়ে রাজনীতির সুযোগ নেই। ক্রান্তিকালে রাজনীতি হয় না। মানুষের জীবন নিয়ে রাজনীতি হয় না।

 

 

 

আলোচনায় অংশ নিয়ে জাপার অধ্যাপিকা রওশন আরা মান্নান বলেন, পি কে হালদারকে বিদেশ থেকে ধরে এনে কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক। যেন ভবিষ্যতে উদাহরণ হয়ে থাকে। না হলে অনেকে টাকা-পয়সা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাবে। এ ধরনের আরো কত পি কে হালদার আছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) তা খুঁজে বের করতে হবে। জাপার এই সদস্য আরো বলেন, হলমার্কের কর্মকর্তা কারাগারে বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। এগুলো বন্ধ করতে হবে। টাকা দিয়ে এসব ব্যবস্থা করেছে। এসব টাকা ব্যাংকের, তারা বান্ধবীদের পেছনে খরচ করছে। এই দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।

 

 

 

সরকারি দলের সদস্যরা যা বললেন

 

 

 

রাষ্ট্রপতির ভাষণের ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর গতকাল আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের এ বি তাজুল ইসলাম বিএনপির রাজনীতির সমালোচনা করে বলেন, ‘আমাদের সিনিয়র সংসদ সদস্য সেলিম ভাই (শেখ ফজলুল করিম সেলিম) একান্ত আলাপে আমাকে বলেছিলেন, জিয়াকে হত্যা করলে না কেন? তোমার পক্ষে এটা সম্ভব ছিল। আমি তখন ক্যাপ্টেন ছিলাম। তাই আমার পক্ষে এটা সম্ভব ছিল না।’ তাজুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপতি যে ভাষণ দিয়েছেন, তা উন্নয়নের দলিল। এই উন্নয়ন আপনা-আপনি হয়নি। নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই উন্নয়ন করেছেন।

 

 

 

সরকারি দলের এমপি সাইফুজ্জামান বলেন, বিএনপি-জামায়াতের ইতিহাস মিথ্যায় ভরা। পৌর নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে দেখছি, জনগণ তাদের ভোট দিতে চায় না। এ কারণে বিএনপি উন্মাদের মতো আচরণ করছে। তিনি বলেন, ভারত যে দামে করোনার টিকা পাচ্ছে, বাংলাদেশও একই দামে পাচ্ছে। অনেকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ সবার আগে টিকা নিয়েছেন—এ তথ্য সঠিক নয়। কুমিল্লার সুবিদ আলী ভূঁইয়া বলেন, সব সূচকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ভালো করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল।

 

 

 

সরকারি দলের এমপি আব্দুস সালাম মুর্শেদী শ্রমিকদের প্রণোদনার জন্য যে টাকা দেওয়া হয়েছে, তা পরিশোধে আরো ছয় মাস সময় দেওয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে খুলনার অতীত ঐতিহ্য ফিরে আসবে। শিল্পনগরী হিসেবে ঘুরে দাঁড়াবে।উৎসঃইত্তেফাক

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ