ওয়ান-ইলেভেনঃ বুটের তলায় গণতন্ত্র

কাদের গনি চৌধুরী                                                                                                      ওয়ান-ইলেভেনের ষড়যন্ত্রের কালো দিন আজ। নবম সংসদ নির্বাচনের মাত্র ১১ দিন আগে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি আজকের এদিনে দেশের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, দেশের অর্থনীতির বিরুদ্ধে এবং জাতীয়তাবাদী শক্তি ও জিয়া পরিবারকে ধবংসের এক গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছিল। প্রতিবেশী একটি দেশের আঁকা নীলনকশা অনুযায়ী এই দিনে ঘটেছিল বেসামরিক মোড়কে সামরিক সরকারের আবির্ভাব। আর এসামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করে গণতনন্ত্রের গলা চেপে ধরেছিল। ক্ষমতা দখল করেই দেশে জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। দেশী-বিদেশী প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আগত সেই ঘটনা পরবর্তীতে কলংকিত “ওয়ান ইলেভেন” নামে পরিচিতি পায়।
দুর্ভাগ্যজনক হলে সত্য আলোচিত সমালোচিত সেই সামরিক সরকারকে স্বাগত জানিয়েছিল বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং ভারতের পদলেহনকারি এক শ্রেণির সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী। ইয়াজ উদ্দিন, মইনুদ্দিন, ফখরুদ্দিনদের সেই সরকার ৩ মাসের স্থলে ২ বছর ক্ষমতায় থেকে নানা বিতর্কের জন্ম দেয়। খালেদা জিয়ার আপোসহীন অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত সহজ ট্রানজিট হিসেবে আওয়ামী লীগকেই বেছে নেয় দখলদার ওয়ান ইলাভেন সরকার।আর এর মমধ্যস্থতা করেন ভারতের প্রণব মুখার্জি। ২০০৮ সালের শেষ ডিসেম্বরে তাদের ব্যবস্থাপনায় যে নির্বাচন হয় তাতে আওয়ামী মহাজোট ক্ষমতাসীন হয়।
বিএনপি-জামায়াতসহ ৪ দলীয় জোট সরকারের মেয়াদপূর্তি শেষে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় মহাজোট সারা দেশে লগি- বৈঠার তান্ডব চালায়। ঢাকার পল্টনে ৬ জনসহ সারা দেশে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন অনেক নেতা-কর্মীকে লগি আর বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আহত করা হয় অনেককেই। প্রতিবেশী দেশের প্রত্যক্ষ মদদে সারা দেশে রক্তের হোলিখেলা শুরু হয়। এরফলে দেশ জুড়ে সৃষ্টি হয় এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি।
আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্রদের দাবি ছিল সংবিধানসম্মত বিচারপতি কেএম হাসান যেন প্রধান উপদেষ্টা না হন। এহেন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানালে রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। তার নেতৃত্বে নতুন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন হলে সংবিধান সম্মতভাবেই নির্বাচন হতে যাচ্ছিল। আওয়ামী লীগের সব দাবি একের পর এক মেনে নিয়েই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু প্রার্থী দেয়ার পরও শেষ মুহূর্তে এসে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন তারা সব প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। এতে সৃষ্টি হয় আরো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার।
এহেন উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবরণে গঠিত হয় সেনা নিয়ন্ত্রিত অন্তর্বর্তিকালীন সরকার। পরবর্তীতে এটিকে “ওয়ান ইলেভেন” হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।ওইদিন চারদিকে ছিল নানা গুজব, গুঞ্জন সাথে আতঙ্ক ও অনিশ্চিয়তা। সার্বিক পরিস্থিতি ছিল থমথমে। এই অবস্থায় বিকেল চারটার দিকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও কাজী জাফর উল্যাহ এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল যোগ দেন কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠক। কূটনীতিকদের মধ্যে বৈঠকে ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার ডগলাস ফসকেট, জাপানের রাষ্ট্রদূত ইনোওয়ে মাসাইয়েকি, ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) ডেলিগেশন প্রধান রাষ্ট্রদূত ড. স্টিফান ফ্রোইন ও জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রেনাটা ডেজালিয়েন। বিকেল পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত বৈঠক শেষে বেরিয়ে আসেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে সাংবাদিকদের কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান তারা। কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসা থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা সরাসরি চলে যান দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার ধানমন্ডির সুধাসদনের বাসায়।
আওয়ামী লীগ নেতারা বের হওয়ার আধাঘণ্টা পর বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসায় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। এর নেতৃত্বে ছিলেন বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। বৈঠক শেষে তারাও মুখ খোলেননি। সোজা চলে যান গুলশানের হাওয়া ভবনে। সেখানে তারা বৈঠক করেন দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। এর আগে দুপুর পৌনে বারোটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের সঙ্গে তার বারিধারার বাসায় বৈঠক করেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী।
কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রধান দু’টি দলের বৈঠকের আগে প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দুপুর বারোটায় বৈঠক করেন আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সঙ্গে। এতে কমিটির সদস্যরা ছাড়াও সব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকের পরপরই রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন বঙ্গভবনে তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন। অন্যদিকে বিকেল সাড়ে চারটায় উপদেষ্টা পরিষদের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করা হয়। দু’-একজন ছাড়া উপদেষ্টাদের প্রায় সবাই বঙ্গভবনে গিয়ে বৈঠক বাতিলের খবরে ফিরে আসেন।
বঙ্গভবনের বৈঠক শেষে বিমান বাহিনী প্রধান, নৌ বাহিনী প্রধান, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র‌্যাব, বিডিআরসহ সব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের নিয়ে সেনাসদরে বৈঠক করেন ওয়ান ইলাভেনের নায়ক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ. আহমেদ।
রাত সাড়ে আটটায় বঙ্গভবনে পুনরায় ডাকা হয় উপদেষ্টাদের। কোনো বৈঠক ছাড়াই উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে উপদেষ্টাদের অবহিত করা হয়। এ সময় উপদেষ্টাদের সবাইকে পদত্যাগের অনুরোধ জানানো হয়। এরপর প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়ান রাষ্ট্রপতি। একইসঙ্গে উপদেষ্টারাও পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় আওয়ামী সমর্থক আমলা ডক্টর ফখরুদ্দিন আহমদকে। তিনি নতুন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন।
এসব নাটকীয় ঘটনা ও টান টান উত্তেজনা-উদ্বেগের মধ্যেই সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয় ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন এবং বিপদের সম্মুখীন হওয়ায় রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন’। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে জরুরি অবস্থা কার্যকর হবে। একইসঙ্গে রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ঢাকাসহ সকল মহানগর এবং জেলা শহরে কারফিউ বলবৎ থাকার ঘোষণাও দেয়া হয়।
এরপর নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রাত সাড়ে এগারোটায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। ভাষণে তিনি বলেন, একইসঙ্গে দু’টি দায়িত্ব নেয়ার পর তাকে ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়। এই অবস্থায় সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথকে সুগম করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাতে সরকারের তথ্য অধিদফতর থেকে মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলোকে রাজনৈতিক সংবাদ ও সরকারের সমালোচনামূলক সংবাদ প্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য বলা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ হয়ে যায় টিভি চ্যানেলের খবর ও টকশো।
বস্তুত জোট সরকারের মেয়াদ পূর্তির বেশ আগে থেকেই বিদেশী কূটনীতিকরা ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কয়েকজন কূটনীতিক সরাসরি ভূমিকা রাখেন ১১ জানুয়ারির ঘটনা পর্যন্তু। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশের অপতৎপরতা ছিল লক্ষ্যণীয়।তবে ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর কূটনীতিকদের কিছু ভূমিকা দেখা গেলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট জাহেদ চৌধুরী ভাষায়ঃ
“তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তার অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনে গিয়ে বন্দুকের নলের মুখে রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে জিম্মি করে সরকারপ্রধান তথা প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে তার পদত্যাগপত্র আদায় করেন এবং দেশে জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে রাষ্ট্রপতিকে চাপ প্রয়োগের পর এক পর্যায়ে জেনারেল মইন তৎকালীন নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীকে দিয়ে সামরিক যান ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বঙ্গভবন ঘেরাও করে ফেলেন। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি জেনারেল মইনের কথামত কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সেনাসমর্থিত একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়।”
ওয়ান-ইলেভেনের পর সেনাসমর্থিত সরকার দুর্নীতি উচ্ছেদের নামে দেশে বিরাজনীতিকরণ শুরু করে। রাজনীতিবিদদের ঢালাওভাবে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করে এক একে তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। নবম পদাতিক ডিভিশনের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীকে গুরুতর অপরাধ দমন জাতীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী নিয়োগ করে তার নির্দেশে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীসহ পেশাজীবীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ডিজিএফআইয়ের তত্কালীন দুই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলুল বারী ও ড. এটিএম আমিনের নেতৃত্বে ন্যক্কারজনকভাবে রাজনীতিবিদদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে দল ভাঙার চেষ্টা চালানো হয়। ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনকেও দল ভাঙার ষড়যন্ত্রে জড়ানো হয়। সংস্কারের নামে দুই নেত্রীকে রাজনীতির বাইরে পাঠাতে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ কার্যকরের চেষ্টা চলে। ওয়ান-ইলেভেন সরকারকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাদের আন্দোলনের ফসল আখ্যায়িত করে তাদের সব কাজের বৈধতা দেয়ার ঘোষণা শুরুতেই দিয়েছিলেন। তারই ধারবাহিকতায় এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে ওয়ান-ইলেভেনের সরকার নিজেদের জন্য সেফ প্যাসেজ বের করে নেয়। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট কখনই ওয়ান-ইলেভেনের সরকারকে মেনে নিতে পারেনি।
ওয়ান-ইলেভেনের ‘শক্তিধর’ জেনারেলরা এখন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী সরকারের সঙ্গে বুঝাপড়া এবং নির্বাচন-পূর্ব সমঝোতায় সংবিধান লংঘন, জোর করে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে রাখা কিংবা দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বা অর্থনীতি ধ্বংস করার জন্য তারা এখনও বিচারের মুখোমুখি হওয়ার হাত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তবে কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকের ঠিকানা হয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।প্রভাবশালী উপদেষ্টাদের ক’জন এখন নিজেরাই দুর্নীতি-অনিয়মের মামলা মোকাবিলা করছেন। ষড়যন্ত্রের অংশীদার বিদেশি কূটনীতিকদের অধিকাংশই নতুন অ্যাসাইমেন্টে দেশ ছেড়েছেন।
দিন যত যাচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফসল ছিল ওয়ান-ইলেভেন। তত্কালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ঘটনার দু’দিন আগে সেনাপ্রধান জেনারেল মইনের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতিতে পরিবর্তন এনে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রেনাটা লক ডেসালিয়ান ‘সেনাবাহিনী ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ অনিশ্চয়তায় পড়বে’ বলে হুমকি দেন। শুধু তাই নয়, জরুরি অবস্থা জারির আগেই ওই দিন বিকালে পশ্চিমা কূটনীতিকদের সংগঠন ‘ট্যুইসডে গ্রুপ’-এর বৈঠক বসে তত্কালীন কানাডীয় হাইকমিশনার বারবারা রিচার্ডসনের বাসায়। আওয়ামী লীগের তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ও বিএনপির তত্কালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে দুটি প্রতিনিধি দলকে কানাডীয় হাইকমিশনারের বাসায় বিকালেই ডেকে নিয়ে বলে দেয়া হয়, দেশে জরুরি অবস্থা জারি হচ্ছে, এতে কূটনীতিকদের সমর্থন রয়েছে। এছাড়া তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া এ বিউটেনিস, ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রিও ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টিতে নেপথ্যে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া কিছু ব্যবসায়ী নেতারও এর পেছনে ইন্ধন ছিল। এফবিসিসিআই’র সভাপতি আনিসুল হক, তত্কালীন সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আলীসহ অনেক নেতা সমর্থন জানিয়েছিলেন ওয়ান-ইলেভেন সরকারকে। বিশেষ করে তেল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী প্রকাশ্য টিভি অনুষ্ঠানে ওয়ান-ইলেভেন সরকার প্রতিষ্ঠার আগেই দেশে জরুরি অবস্থা জারির পক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখেছিলেন। গতকালও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী ‘রিহ্যাব’-এর সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে কিছু অতিউৎসাহী ব্যবসায়ী ওয়ান-ইলেভেনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বলে যথার্থই উল্লেখ করেছেন।
ওয়ান-ইলেভেনের সরকারকে বঙ্গভবনে গিয়ে অভিনন্দন এবং তাদের সব কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেয়ার ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ শুরুতেই দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। দেশের মানুষের মনোভাব, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক সমর্থনও পাল্টে যায়। এ অবস্থায় ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা যখন দেখেন তাদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা দুরূহ হয়ে উঠছে, তখন তারা সেফ প্যাসেজ খুঁজতে থাকেন। দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ভিত্তিক ধারণা এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের লন্ডনে গিয়ে দেয়া বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, জেনারেল মইন গংকে সেফ প্যাসেজ দিতে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তি রচিত হয়। এর ফলেই নির্বাচনপূর্ব সমঝোতা হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক বিজয় আসে। ফলে ওয়ান-ইলেভেনে সংবিধান লংঘনকারী ড. ইয়াজউদ্দিন, ড. ফখরুদ্দীন ও জেনারেল মইনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করছে না বর্তমান সরকার।
ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ সরকারি দলের বেশ কিছু নেতা সংবিধান লংঘনকারী, দেশে বিরাজনীতিকরণের নেতৃত্বদানকারী ওয়ান-ইলেভেনের ‘উদ্দিনদের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে সোচ্চার হলেও দলের হাইকমান্ডের সায় না থাকায় তারার এখন চুপসে গেছেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তৎকালীন সরকারপ্রধান ও প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে সরকারপ্রধানের পদ থেকে জোর করে পদত্যাগ করানোর পর উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য বিচারপতি ফজলুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টা করার কথা রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হলেও সংবিধান অনুযায়ী তাকে কোনো শপথ করানো হয়নি। ১২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ড. ফখরুদ্দীন আহমদ প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ২৪ ঘণ্টা দেশে কোনো সরকার ছিল না। তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের ওপর সেনাসমর্থিত সরকার চাপ প্রয়োগ করে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় ব্যত্যয় ঘটাতে বাধ্য করেছিল। এছাড়া সংবিধান লঙ্ঘন করে বিভিন্ন আইন জারি করে অবৈধভাবে প্রায় দু’বছর সেনাসমর্থিক সরকার ক্ষমতায় ছিল।
জোর করে জরুরি অবস্থা জারি ও ড. ফখরুদ্দীনের পুতুল সরকার গঠনের তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন তার সহযোগীদের মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সম্মেলনের নামে তার রাজনৈতিক দর্শন জাতির সামনে তুলে ধরেছিলেন। ‘নিউ ব্র্যান্ড অব ডেমোক্র্যাসির’ কথা বলে নিজস্বধারার রাজনীতি সূচনার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। তার রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করতে দেশের সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক নির্বাসনে পাঠানোর জন্য সংস্কারের নামে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ কার্যকর করতে চেয়েছিলেন। ডিজিএফআই’র তত্ত্বাবধানে গঠন করা হয়েছিল নতুন নতুন ‘কিংস পার্টি’। অনেককে তারা তাদের দলে ভিড়িয়েও ছিলেন। প্রধান দু’দলেরই কেন্দ্রীয় বহু নেতাকে জেনারেল মইন তার ও তার কিংস পার্টির সঙ্গে ভিড়াতে পারলেও দু’দলেই তৃণমূল নেতাকর্মীরা জেনারেল মইনের অভিলাষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। দেশের বাইরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মইনের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তৃণমূল নেতারা নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেও তাদের নেত্রীর প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখেন। একপর্যায়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে বাধা দেয়া হয় এবং খালেদা জিয়াকে জোর করে সৌদি আরবে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে। কিন্তু খালেদা জিয়ার অনড় মনোভাব তাদের সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়। এরপরই চাপ প্রয়োগের জন্য খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির তত্কালীন সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব তারেক রহমানকে জেলে নেয়া হয়। একপর্যায়ে সেনা সমর্থিত সরকার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে জেলে নেয়া হয়। নির্যাতন চালিয়ে দু’ছেলেকে প্রায় পঙ্গু করে দেয়া হলেও খালেদা জিয়া সেনাসমর্থিত সরকারের সঙ্গে কোনো আপস করেননি। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় একে একে তিনি সর্বোচ্চ আদালত থেকে জামিন পান। সরকারও দেশি-বিদেশি চাপের কাছে মাথানত করে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। অবশ্য সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে আগেই চিকিত্সার কথা বলে শেখ হাসিনা সরকারের নির্বাহী আদেশে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। জরুরি অবস্থার মধ্যে নির্বাচনে রাজি হলেও খালেদা জিয়ার অনড় মনোভাবের কারণে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের আগে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা হয়।
জেনারেল মইন যখন ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে পরিচালিত তার বিভিন্ন পদক্ষেপে একের পর এক হোঁচট খেতে থাকে, তখন তিনি সেফ প্যাসেজ খুঁজতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করেন। পরবর্তী পর্যায়ে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল লল্ডনে গিয়ে তাদের এ আঁতাতের কথা ফাঁসও করে দেন। এ নিয়ে দলে ব্যাপক তোলপাড় হয়। সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ হারান আবদুল জলিল। তার বিরুদ্ধে নিজের দলের সরকারই ট্যাক্স ফাঁকির মামলা দায়ের করে।
বিএনপির এমপিদের দ্বারা সংসদ থেকে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ওয়ান ইলেভেনে চাপের মুখে দেশে জরুরি অবস্থা জারি ও প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করলেও পরবর্তীতে জেনারেল মইন ও ফখরুদ্দীনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আরও দুই বছর রাষ্ট্রপতি পদে আসীন ছিলেন। ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডের আনুষ্ঠানিকতা তার হাত দিয়েই সারা হয়। রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে যাওয়ার পর বেসরকারি টিভি চ্যানেল বাংলাভিশনের এক অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো হাজির হয়ে রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ওয়ান-ইলেভেন নিয়ে কিছু অপ্রিয় কথা তুলে ধরলেও তার স্ত্রী পরে বিবৃতি দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে মন্তব্য করেন। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ দায়িত্ব থেকে বিদায় নেয়ার পর বেশিরভাগ সময়ই যুক্তরাষ্ট্রে কাটাচ্ছেন। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদও যুক্তরাষ্ট্রে চুপচাপ সময় পার করছেন। বিভিন্ন মহল থেকে সংবিধান লঙ্ঘন ও দু’বছরে দেশের অর্থনীতিকে ২০ বছর পিছিয়ে দেয়া ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ এনে তার বিচারের দাবি উঠলেও সরকারের সর্বোচ্চ মহলের অদৃশ্য এক আশীর্বাদে তিনি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরেই আছেন। তার বিরুদ্ধে বিএনপি নেতা সাবেক বিদুত্ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর একটি মানহানি মামলা চলছে। তার স্ত্রীর বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে মৌলভীবাজার জেলায় জোর করে চাঁদা আদায়ের একটি মামলা হয়েছে। তার অপর সহযোগী লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী অস্ট্রেলিয়ায় হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বর্তমান সরকারের সময়। সরকারের বদান্যতায় এখন তিনি সংসদ সদস্য।
ওয়ান-ইলেভেনের প্রতাপশালী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী জরুরি সরকার থাকাবস্থায়ই আমেরিকায় মিলিটারি অ্যাটাশের চাকরি নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্রিগেডিয়ার বারীকে দেশে তলব করা হলে তিনি পালিয়ে যান। সরকার থেকে জানানো হয়েছে, সরকারের খাতায় তিনি এখন পলাতক।
ডিজিএফআই’র অপর প্রভাবশালী ব্রিগেডিয়ার জেনরেল ড. এটিএম আমিনকে সেনাবাহিনীর চাকুরি থেকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। কিছুদিন আগে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের মামলায় সিআইডি ড. আমিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তিনি দেশের বাইরে চলে যান। ওয়ান-ইলেভেনের সময় সেনাবাহিনীর পিএসও’র দায়িত্ব পালনকারী লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছিল। এখন তিনিও বিদেশে আছেন।ওয়ান ইলেভেনের আরেক ক্ষমতাধর জেনারেল সিনা ইবনে জামালীর চাকরিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত ছিল।তিনিও দেশের বাইরে আছেন বলে জানা গেছে।
#রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা মোখলেসুর রহমান চৌধুরীর বর্ণনায় সেদিনের বঙ্গভবনের ভেতরে-বাইরের অজানা তথ্যঃ
সেদিন বঙ্গভবনের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা মোখলেসুর রহমান চৌধুরী। বর্তমানে তিনি লন্ডনে পিএইচডি গবেষণায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ব্যস্ততার ফাঁকে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গভবনের ভেতরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ বর্ণনা করেছেন সরকারের রোষানলে বন্ধ হয়ে যাওয়া দৈনিক আমার দেশ-এর কাছে, যা আমার দেশ অনলাইন ভার্সনে ছাপা হয়েছিল।
লন্ডনে নির্বাসিত দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি অলিউল্লাহ নোমানের প্রশ্নের উত্তরে উঠে আসে সেই দিনের অনেক অজানা তথ্য। নিচে তা পাঠকের জন্য উপস্থাপন করা হলো :
আমার দেশ : আপনি তখন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের উপদেষ্টা। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গভবনের ভেতরে কী ঘটেছিল। পাঠকের উদ্দেশ্যে দয়া করে সংক্ষেপে বলবেন কি?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : অনেক বড় ঘটনা। সংক্ষেপ করে বলতে গেলেও অনেক কিছু আসবে। ১১ জানুয়ারি প্রতিদিনের মত সকালে মিন্টু রোডের বাসা থেকে বঙ্গভবনের উদ্দেশে রওনা হই। বঙ্গভবন ছিল আমার কর্মস্থল। সেদিন বঙ্গভবনে যাওয়ার পথে সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে ফকিরাপুল মোড়ে পৌঁছাই। তখন আমার সঙ্গে থাকা সিকিউরিটি ও ড্রাইভার দেখাচ্ছিলেন সেনাবাহিনীর একটি কনভয়। এই কনভয়ে ছিলেন ডিজিএফআইর তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার চৌধুরী ফজলুল বারী। তিনি আমার গাড়িটি আগে যাওয়ার জন্য সিগন্যাল দেন। তারা আমাদের সাইড দিলেন। তাদের গাড়ি ওভারটেক করে আমার গাড়িটি আগে যাওয়ার সুযোগ দিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে বঙ্গভবনের গেটে পৌঁছাই। গেটে পৌঁছে দেখি সেখানে প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, এসএসএফ (স্পেশাল সিকিউরিটে ফোর্স)-এর ডিজি মেজর জেনারেল সৈয়দ ফাতেমী আহমদ রুমী, এনএসআই-এর ডিজি মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী গাড়ি থেকে নেমে নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের গাড়িগুলো বঙ্গভবনের প্রধান ফটকে কর্তব্যরত সেনা সদস্যরা চেক করছেন। এটাই বঙ্গভবনের নিয়ম। আমার গাড়ি বঙ্গভবনের সিংহদ্বারে পৌঁছামাত্র সঙ্গে থাকা সিকিউরিটির গাড়িটি যথারীতি বাইরে রেখে আমাকে সরাসরি গাড়ি নিয়ে ভেতরে চলে যেতে অনুরোধ করা হলো। তখন কয়েকবার বললাম আমিও নামি। আমার গাড়িও চেক করা হউক। জবাবে বলা হলো স্যার মিনিস্টারের গাড়ি চেক করা হবে না। স্যার, ভেতরে চলে যেতে পারেন।
আমার দেশ : ভেতরে প্রবেশ করে কী দেখলেন। পরিস্থিতি কি অন্যান্য দিনের মতোই ছিল?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : সেদিন পরিবেশ ভেতরেও একটু ভিন্ন ছিল। ভেতরে প্রবেশের পর মূল ভবনে যাওয়ার পথে গাড়ি থেকে বঙ্গভবনের সবুজ লনে চোখ পড়ল। দেখি গাছের নিচে জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাদা পোশাকে লোকজন গিজগিজ করছে। তাদের সকলের বুকে সিকিউরিটি পাস ঝুলছে। যথারীতি গাড়ি থেকে নেমে যখন অফিস রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তখনো দেখি আমার অফিসের আশপাশের করিডোরে সাদা পোশাকে লোকজন ভর্তি। বঙ্গভবনের সবুজ চত্বরে এবং ভবনের ভেতরের করিডোরে সাদা পোশাকে যারা ছিলেন সবাই ডিজিএফআই-এর সদস্য।
আমার দেশ : রুমে পৌঁছে আপনি প্রতিদিনের ন্যায় কাজ করতে পারছিলেন নাকি কোন বাধার সম্মুখীন হলেন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : রুমে পৌঁছার পর আমি প্রতিদিনের মত কাজ শুরু করি। প্রথমেই রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সাথে হটলাইনে কথা বলি। গেট থেকে অফিসে পৌঁছানো পর্যন্ত দেখা দৃশ্যগুলো বর্ণনা করি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথেও টেলিফোনে কথা বলার চেষ্টা করি তখন। পাশাপাশি বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পেট্রিসিয়া এ বিউটেনিসের সাথেও ফোনে কথা বলার চেষ্টা করি। তাকে বললাম, সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে যাচ্ছে। আমি সব সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণœ রেখে বিদেশী দূতদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করতাম। গণতন্ত্র ও সংবিধান সমুন্নত রাখতে যখন তারা একমত হলেন তখন তাদের সাহায্য চাইতে কার্পণ্য করিনি।
আমার দেশ : বিউটেনিসের সাথে তখন আপনার কী কথা হয়েছিল?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : বিউটেনিস তখন বঙ্গভবন এবং তার বাসভবনে আমাদের দু’জনের অনেকগুলো বৈঠকের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন- আমরা বাংলাদেশে সামরিক শাসন বন্ধ করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিচার্ড এ বাউচারের বাংলাদেশ সফরের ব্যবস্থা করেছি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট নিকোলাস বার্নস ও রিচার্ড বাউচার স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে আপনার সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছেন। এর বাইরে জাতিসংঘ মহাসচিবের সাথে আপনার যোগাযোগের পর মহাসচিবের বিশেষ দূত বাংলাদেশে সফর করে গেছেন। আপনার বক্তব্যের সূত্র ধরে গত ৮ এবং ৯ জানুয়ারি আমরা দুইজন রাষ্ট্রদূত যথাক্রমে সেনাপ্রধান ও প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের (পিএসও) সাথে দেখা করেছি। তাদেরকে মার্শাল ল’র বিরুদ্ধে আমাদের সুস্পষ্ট অবস্থান ঘোষণা করেছি। ফলে এটা বলতে পারি যে, সামরিক শাসন জারি হবে না। তবে স্টেট অব ইমার্জেন্সি জারি হলে সেই ক্ষেত্রে আমরা কিছু করতে পারছি না। বাংলাদেশের সংবিধানে স্টেট অব ইমার্জেন্সি জারির সুযোগ রয়েছে। এই কথাগুলো তখন বিউটেনিস আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন।
আমার দেশ : আপনারা বঙ্গভবনের পক্ষ থেকে তখন কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : ওই দিন দুপুর ১২টায় বঙ্গভবনের কেবিনেট কক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সভাপতিত্বে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। আমরা মিটিং যথাসময়ে শুরুর চেষ্টা করি। ওই মিটিং চলাকালে বেলা পৌনে ১টায় এমএসপি (রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব) মেজর জেনারেল আমিনুল করিম বললেন, তিন বাহিনী প্রধান বঙ্গভবনে আসছেন। মিটিং চলাকালে এমএসপি কয়েকবার টেলিফোনে কথা বলেন। এমনকি এমএসপি মিটিং থেকে উঠে বাইরে গিয়েও মোবাইলে কথা বলতে দেখা গেছে। বঙ্গভবনে আসার ব্যাপারেই সেনাপ্রধানের সাথে এমএসপি তখন ফোনে কথা বলায় তৎপর ছিলেন। এখানে উল্লেখ করতে চাই, ১১ জানুয়ারি ক্ষমতা দখলের আগেও বঙ্গভবনের বিভিন্ন কক্ষে এমএসপি এবং সেনাপ্রধানকে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করতে দেখা গেছে।
আমার দেশ : এমএসপি যখন জানালেন তিন বাহিনী প্রধান আসছেন, তখন রাষ্ট্রপতি ও অন্যান্য উপদেষ্টারা কী করলেন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : এমএসপি যখন জানালেন তিন বাহিনী প্রধান আসছেন, তখন রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে বলা হলো আমরা সরকারের উচ্চপর্যায়ের মিটিংয়ে আছি। এ ছাড়া তিন বাহিনী প্রধানকে রাষ্ট্রপতি ডাকেননি। এমনকি তারা রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্টও চাননি। তারপরও এমএসপির বক্তব্য ছিল তখন মিটিং বন্ধ করতে হবে এবং রাষ্ট্রপতিকে তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে বসতে হবে। এমএসপি বারবার আর্মি চিফ, আর্মি চিফ করছিলেন। মিটিংয়ে উপস্থিত উপদেষ্টা এবং সচিবসহ উচ্চপর্যায়ের সবাই বুঝতে পারছিলেন সামরিক সচিব আমিনুল করিম রাষ্ট্রপতির চেয়ে সেনাপ্রধানের প্রতি বেশি অনুগত।
আমার দেশ : আপনারা কি শেষ পর্যন্ত মিটিং চালিয়ে যাচ্ছিলেন নাকি বন্ধ করে দিয়েছিলেন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে মিটিং স্থগিত করা হয়। রাষ্ট্রপতি ও আমি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির অফিস কক্ষে যাই। রাষ্ট্রপতির অফিস কক্ষ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কারণ এখানে রাজনৈতিক পক্ষ- বিপক্ষের কোন বিষয় নয়। গণতন্ত্রের প্রশ্নে রাজনীতিকদের সবার এক হওয়ার কথা। বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হলেও একটি দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে না ফোন রিসিভ করা হয়, না ব্যাক করা হয়।
আমার দেশ : আমি জানতে চাচ্ছিলাম আপনারা প্রতিরোধের কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলেন কি না?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের মিটিং শুরু হওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট (পিজিআর) কমান্ডেন্ট মেজর জেনারেল আবু সোহায়েল আমার কক্ষে আসেন। তখন বঙ্গভবনের ভেতরে ডিজিএফআই-এর ব্যাপক উপস্থিতির কারণে কিছুটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল। পিজিআর কমান্ডেন্ট আমার কাছে জানতে চান জেনারেল মইন ক্ষমতা দখল করতে এলে আমরা কী করবো। তখন তাকে বললাম, আপনাদের ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবেন। যেকোনো অবৈধ এবং অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে হবে। তিনিও আমার সাথে একমত হলেন এবং প্রতিহত করার একটি মানসিক প্রস্তুতি আমাদের ছিল।
আমার দেশ : এই প্রস্তুুতি অনুযায়ী কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল কি?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : সেনাপ্রধান ও তার সঙ্গীদের যথারীতি বঙ্গভবনের প্রধান গেটে পিজিআর আটকে দেয়। অতি উৎসাহী এমএসপি আমিনুল করিম তখন অফিস থেকে বের হয়ে বঙ্গভবনের গেটে আসেন। পিজিআর চিফের সাথে এমএসপি’র অনেক বাদানুবাদ হয়। একপর্যায়ে পিজিআর চিফকে উদ্দেশ করে এমএসপি বলেন, আমি হলাম তোমার ঊর্ধ্বতন। সুতরাং সেনা আইন অনুযায়ী আমি তোমার পাওয়ার সিজ করলাম। তারপরও পিজিআর প্রধান তার অবস্থানে দৃঢ় ছিলেন। একপর্যায়ে এমএসপি তিন বাহিনী প্রধানকে তার রুমে চা খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। এবং আরো বলেন, তারা কোনো মুভ করবেন না। এমএসপি এবং পিজিআর চিফের বাদানুবাদের সময় পিজিআর অর্গানোগ্রামের কথা উল্লেখ করেন এমএসপি। তিনি পিজিআর চিফকে বলেন, আই অ্যাম নাউ অপারেশনাল কমান্ডেন্ট অব পিজিআর। এক পর্যায়ে উত্তেজনা সাময়িক নিরসন হলে তিন বাহিনী প্রধানকে চা আপ্যায়নের কথা বলে এমএসপি ভেতরে নিয়ে যান।
আমার দেশ : ভেতরে নিয়ে যাওয়ার পর সেনাপ্রধানসহ অন্যদের ভূমিকা কী ছিল?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : ভেতরে এমসএসপির রুমে নিয়ে প্রথম তাদের বসানো হয়। তখন স্যান্ডওইচ-এর ট্রেতে করে ন্যাপকিনে মোড়ানো ৩টি পিস্তল তিন বাহিনী প্রধানকে সরবরাহ করেন এমএসপি। কারণ বঙ্গভবনে বহিরাগত যে কারো অস্ত্র নিয়ে প্রবেশে আইনত নিষিদ্ধ। তাই তারা অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করতে পারেননি। এ জন্যই বঙ্গভবনের ভেতরে এমএসপি তাদের তিনটি পিস্তল সরবরাহ করলেন।
আমার দেশ : এটাতো এমএসপি’র রুমের ভেতরের কথা বলছেন। আমি জানতে চাচ্ছিলাম তারা কী ভূমিকায় ছিলেন তখন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : তারা একপর্যায়ে রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করার কথা বলেন। আমরা তখন রাষ্ট্রপতিকে অফিস কক্ষ এবং গেস্ট ডাইনিং হলসহ বিভিন্ন কক্ষে নিয়ে যাই। কখনো দুপুরের খাবার আবার কখনো ইনস্যুলিনের কথা বলে সময় ক্ষেপেণের চেষ্টা করা হয়। একই সঙ্গে জেনারেল মইনের ক্ষমতা দখলের বিষয়ে বঙ্গভনে তৎপরতা প্রসঙ্গে রাজনৈতিক মহলে অবহিত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। এই যোগাযোগের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরামর্শ মোতাবেক মইন ইউ আহমদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করা।
আমার দেশ : রাজনৈতিক মহল থেকে আপনারা কি ফিডব্যাক পেয়েছিলেন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেদিন আমাদের ডাকে সাড়া দিতে ব্যর্থ হন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের এক পক্ষ চেয়েছিলেন জেনারেল মইন ক্ষমতা দখল করুক। তার ধারাবাহিকতায় তারা ক্ষমতায় আসবেন। আরেক পক্ষকে সেনাপ্রধান হিপনোটাইজ করে ফেলেছিলেন যে, জরুরি অবস্থার মাধ্যমে তাদেরকে ক্ষমতায় পুনর্বহাল করা হবে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে আলাপ করেই সিদ্ধান্ত নিতেন। এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস ১৯৯৬ সালের ২০ মে একটি সামরিক ক্যু প্রচেষ্টা ভন্ডুল করে দিয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সহযোগিতা নিয়ে। সেদিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া লে. জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমের সামরিক ক্যু প্রচেষ্টা প্রতিহত করা সম্ভব হতো না। এ ছাড়া তৎকালীন এমএসপি মেজর জেনারেল রুহুল আলম চৌধুরী, নবম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান, ডিজিএফআই-এর ডিজি মেজর জেনারেল এম এ মতিন ও ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আবু রুশদ রোকন উদদৌলা, প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভুঁইয়া সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের পাশে থেকে তৎকালীন সেনাপ্রধানের সামরিক অভ্যুত্থানপ্রচেষ্টা রুখে দিয়েছিলেন। অন্য দিকে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি এমএসপি মেজর জেনারেল আমিনুল করিম, ডিজিএফআই, এসএসএফ, নবম ডিভিশন সকলেই ছিলেন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদের ক্ষমতা দখলের পক্ষে। শুধুমাত্র পিজিআর কমান্ডেন্ট এবং এনএসআই-এর ডিজি ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে ছিলেন। এখানে আরেকটু বলে রাখতে চাই, মাঝারি পর্যায়ের কিছু অফিসারও জেনারেল মইনের ক্ষমতা দখলকে সমর্থন করেনি। তাদেরকে পরবর্তীতে ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকান্ডের আগে বিডিআর-এ বদলি করা হয়েছিল, অর্থাৎ ডাম্পিং করা হয়েছিল। তারা সকলেই এই হত্যাকান্ডে শহীদ হয়েছেন।
আমার দেশ : আপনি বলেছেন তিন বাহিনী প্রধানকে এমএসপি ভেতরে নিয়ে যান। নবম পদাতিক ডিভিশনের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী তখন কি তাদের সঙ্গে ছিলেন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : না। মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী তখন অনুপস্থিত ছিলেন। তখনো তিনি এসে পৌঁছাননি। সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদসহ অন্যান্য অফিসার যখন রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা জারির জন্য চাপ সৃষ্টি করছিলেন তখন রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, জেনারেল মাসুদ উদ্দিন কোথায়। জেনারেল মাসুদ আপনাদের সঙ্গে আছেন? আমি রাষ্ট্রপতিকে আগেই বলেছিলাম জেনারেল মইন কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে আমাদেরকে নবম ডিভিশনের জিওসির বক্তব্য শুনতে হবে। রাষ্ট্রপতির এই জিজ্ঞাসার পর মইন ইউ আহমদ জানান, তাকে বঙ্গভবনে আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি আবার রাষ্ট্রপতির সামনে থেকে মাসুদ উদ্দিনকে টেলিফোন করেন। সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতির সামনে থেকে নবম ডিভিশনের জিওসি মাসুদ উদ্দিনকে বঙ্গভবনে আসার নির্দেশ দেন মইন ইউ আহমদ। মাসুদ উদ্দিন এসে মইনের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিলেন।
আমার দেশ : রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়েছিল। অপর একজন উপদেষ্টাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ছাড়া অন্য কোন উপদেষ্টার নিকট থেকেও কি পদত্যাগপত্র নেয়া হয়েছিল?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি মধ্যরাতে অথাৎ ১২টার পর সেনাপ্রধান লে: জেনারেল মইন ইউ আহমদের সাথে আমি রেড টেলিফোনে কথা বলি। তাকে বললাম, জরুরি অবস্থা জারির নামে এবং রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরাতে গিয়ে সংবিধানের বেশ কিছু ধারার লঙ্ঘন হয়েছে। তখন তিনি জানতে চাইলেন কী কী ধারা লঙ্ঘন হয়েছে। বললেন, সংবিধানের বিষয়ে কি ত্রুটি ঘটেছে একটু বলবেন। তখন আমি পরিষ্কার করে বললাম, সংবিধান অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করার সাথে সাথে উপদেষ্টা পরিষদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু আপনারা প্রধান উপদেষ্টার নিকট থেকে পদত্যাগপত্র নিয়েছেন। একই সাথে একজন ছাড়া বাকি সকল উপদেষ্টার নিকট থেকেও পদত্যাগপত্র নিয়েছেন, যার কোনো দরকার ছিল না। তাকে আমি আরো বললাম, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করলেও নতুন প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত বিদায়ী প্রধান উপদেষ্টাই দায়িত্বে থাকবেন। এটাই সংবিধানের নিয়ম। অথচ আপনারা ভারপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত উপদেষ্টা বলে সংবিধানে কোনো পদবি নেই। এ ছাড়া প্রেসিডেন্টের ভাষণ আপনারা যেটি লিখে এনেছেন তার মধ্যে অনেক ভুল রয়েছে। ভাষণে কিছু রাষ্ট্রবিরোধী কথা আমি কেটে দিয়েছি।
আমার দেশ : জবাবে মইন ইউ আহমদ তখন আপনাকে কিছু বলেছিলেন কি?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : আমার কথা শোনার পর মইন ইউ আহমদ বললেন আমরা তো রাজনীতি বুঝি না। এখন আপনি কিছু বলার দরকার নেই, যা হবার হয়ে গেছে।
আমার দেশ : আমরা তো মইন ইউ আহমদের লেখা বইয়ে দেখেছি আপনি সেনাবাহিনীর সহানুভূতি লাভের চেষ্টা করেছিলেন সেদিন।
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : তিনি উল্টাটা বলেছেন। আমি তার সহানুভূতি চাইনি। তিনিই বরং আমার সহানুভূতি চাইতেন। আমি মইন ইউ আহমদকে যা বলেছিলাম সেটা স্পষ্ট করেই বলেছিলাম। আমি এখানে যা উল্লেখ করেছি তাতে কি সহানুভূতির কোনো গন্ধ আছে! কিন্তু কোন কোন কথা সাহিত্যিকের সহযোগিতা নিয়ে লেখা মইন ইউ আহমদের বইয়ে বলার চেষ্টা করা হয়েছে, আমার কথাবার্তায় তার নাকি মনে হয়েছিল সহানুভূতি লাভের চেষ্টা করছি। অথচ বাস্তবতা হলো ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে জেনারেল মইন প্রতিনিয়ত আমার সহানুভূতি লাভের চেষ্টা করতেন। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার বিদায়ের আগে শেষ ৩ মাস মইন ইউ আহমদ প্রতিনিয়ত তার সহানুভূতি লাভের যে চেষ্টা চালাতেন তা ছিল দৃশ্যমান। একইভাবে ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে তিনি আমারও সহানুভূতি লাভের চেষ্টা করতেন। এটা তখন তার দরকার ছিল।
আমার দেশ : সংবিধান লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো আপনি তখন আর কারো সাথে আলোচনা করেছিলেন কি, নাকি মইন ইউ আহমদের কথামত নীরব ছিলেন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির সময়ে সংবিধান লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো বঙ্গভবনে উপস্থিত অন্যান্য সেনাকর্মকর্তাদের সাথেও আলোচনা করেছি। তারা আমাকে বলেছিলেন এগুলো সেনাপ্রধানকে বলার জন্য। তাদের পরামর্শে আমি সেনাপ্রধানের সাথে রেডফোনে কথা বলি এবং সংবিধান লঙ্ঘনের বিষয়গুলো অবহিত করি।
আমার দেশ : আপনিতো আগে উল্লেখ করেছেন জরুরি অবস্থা জারির আগে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগের করার চেষ্টা করেছেন। জরুরি অবস্থা জারির পর সেই রাতে কোনো শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে আপনার কথা হয়েছিল কি?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদের সাথে কথা শেষ হওয়ার একটু পরই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। তিনি বললেন- মোখলেস চৌধুরী, আপনি থাকতে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের পরও অন্যান্য উপদেষ্টাদের কাছ থেকে পদত্যাগপত্র গ্রহণ এবং ভারপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের মতো সংবিধানপরিপন্থী ঘটনাগুলো কিভাবে ঘটল!
আমার দেশ : জবাবে আপনি কী বলেছিলেন এবং শেখ হাসিনা আপনাকে তখন আর কী কী বললেন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : আমি তাকে বললাম এইমাত্র সেনাপ্রধানকে এ বিষয়গুলো বলেছি। তিনি আরো বললেন, আপনাকে দুইজন লোক বঙ্গভবনে থাকতে দেবে না। জিজ্ঞাসা করলাম বলুনতো তারা কে কে। তিনি জানালেন তাদের একজন সেনাপ্রধান ও আরেকজন এমএসপি।
আমার দেশ : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আপনার কোনো কথা হয়েছিল সেদিন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : শেখ হাসিনার ফোন রাখার একটু পরই বেগম খালেদা জিয়াও ফোন করেছিলেন। তিনি বললেন, ঘটনা তো ঘটে গেছে। এখন দেখুন অ্যাডজাস্ট করে থাকা যায় কি না। আমি বললাম, এটা সম্ভব হবে না। আমি থাকবো না, থাকা সম্ভব হবেও না। শেখ হাসিনা পর্যন্ত এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
আমার দেশ : আপনিতো সেই রাতেই বঙ্গভবন থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। জরুরি অবস্থা জারির উদ্যোক্তা সেনাকর্মকর্তাদের কেউ কি আপনাকে কিছু বলেছিলেন তখন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : হ্যাঁ। আমি সেই রাতেই বঙ্গভবন থেকে বিদায় নিই। কেউ কিছু বলেনি। তবে রাত সাড়ে ১২টার দিকে সেনা গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তা আমার রুমে আসার অনুমতি চাইলেন। আমি তাকে রুমে আসতে বলি। তিনি আমাকে বললেন, স্যার মুখে কিছু বলতে পারব না। আপনাকে একটি চিরকুট দিতে চাই। আমার সম্মতি পেয়ে তিনি চিরকুট টেবিলে রেখে যান। একই সঙ্গে বললেন স্যার, এটা আপনি একটু পর খুলবেন এবং আধাঘন্টা পর আপনার সাথে আবার দেখা করব। তখন আমি বঙ্গভবনের জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং প্রেসিডেন্টের একটি ভাষণ নিয়ে কাজ করছিলাম। চিরকুটের কথা ভুলে যাই।
আমার দেশ : চিরকুটে কী লেখা ছিল?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : তিনি যখন দ্বিতীয়বার এলেন চিরকুট তখনো পড়া হয়নি। আমার অফিস কক্ষে তখন এসি এবং ফ্যান একসাথে চলছিল। ফ্যানের বাতাসে চিরকুট কোথায় যেন উড়ে গিয়েছিল। সেনা গোয়েন্দা বিভাগের ওই কর্মকর্তা বুঝতে পেরেছিলেন চিরকুট পড়ার সুযোগ হয়নি আমার। এটি না পাওয়ায় আবার আমাকে বললেন, স্যার আরেকবার লিখে দিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয়বার চিরকুট লিখে পেপার ওয়েটারে চাপা দিয়ে রেখে যান তিনি। এবং বললেন স্যার, চাপা দিয়ে রেখে যাচ্ছি। আপনি দেখুন। আমি একটু পর আবার আসছি। এবার ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বাইরে যাওয়ার পরপরই আমি এটা দেখলাম। তাতে লেখা ছিল-‘অথরিটি হ্যাজ রিক্যুয়েস্টেড ইউ টু গো অন লিভ, স্যার।’
আমার দেশ : ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আবারো কি ফিরে এসেছিলেন আপনার কাছে?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : হ্যাঁ, একটু পর আবার এসেছিলেন তিনি। আমি তাকে বললাম, দেখুন আমি কিন্তু চলে যাওয়ার জন্য সবকিছু রেডি করছি। না বললেও এমনিতেই আমি চলে যেতাম। তিনিও দেখছিলেন যে আমি ইতোমধ্যে অফিস গোছগাছ করছি। বঙ্গভবন থেকে এইবারের মতো চূড়ান্ত চলে যাওয়ার জন্য আমার স্যুটগুলোসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত সরঞ্জামাদি এক জায়গায় জমা করি। সব প্রস্তুতি শেষে রাত আড়াইটায় বঙ্গভবন থেকে বিদায় নিই।
আমার দেশ : বিদায় নেয়ার সময় আপনি কি আপনার বরাদ্দ করা গাড়িতেই ফিরছিলেন, নাকি অন্য কোন গাড়িতে করে বাড়িতে গিয়েছিলেন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : আমার জন্য বরাদ্দ করা নিয়মিত সরকারি গাড়িতে করেই বাড়িতে ফিরি। তখন কারফিউ চলছিল। রাত আড়াইটার দিকে যখন গাড়িতে ওঠার জন্য প্রস্তুত হই, তখন দেখি ওই সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তাটি আমার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। অর্থাৎ যিনি আমাকে চিরকুট দিয়ে এসেছিলেন তিনি। তাকে বললাম এত রাতে এখানে আপনি কী করছেন। জবাবে জানালেন বাসায় যাবে। কিভাবে যাবেন জানতে চাইলাম। কারণ কারফিউ চলাকালে বাইরে কোনো যানবাহন নেই। তখন আমার সামনে পেছনে প্রটোকল গাড়ি রেডি। সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তাটি বললেন স্যার, আমি হেঁটে হেঁটে বাসায় যাওয়ার চিন্তা করছি। সেনাবাহিনীর সদস্য, কিন্তু গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত থাকায় তিনি সিভিল ড্রেসে ছিলেন। আমি বললাম, এই কারফিউ অবস্থায় সিভিল ড্রেসে আপনি হেঁটে কিভাবে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত যাবেন। আপনাকে তো রাস্তায় গুলি করবে। তারাতো আর চিনবে না আপনি আর্মির একজন মেজর। একপর্যায়ে তাকে বললাম আপনি আমার গাড়িতে উঠুন। তিনি বললেন, এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমার পক্ষে মন্ত্রি পর্যায়ের কারো গাড়িতে ওঠা উচিত নয়, সম্ভবও নয়।
আমার দেশ : ওই কর্মকর্তা শেষ পর্যন্ত কিভাবে বাড়ি ফিরেছিলেন কিছু জানেন কি?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : সেটাই তো বলছিলাম। আমি যতই তাকে গাড়িতে উঠতে বলি, তিনি ততই জোর দিয়ে না না করতে থাকলেন। একপর্যায়ে আমি বললাম ‘দিস ইজ মাই অর্ডার, ইউ হ্যাভ টু ক্যারি আউট’। তখন ওই সেনাকর্মকর্তা আমার গানম্যান বা সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা সদস্যকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি আমার মিন্টু রোডের বাসার দিকে রওনা দিলো। কারফিউয়ের মধ্যে রাস্তায় সুনসান নীরবতা। কোনো শব্দ নেই। এমনকি পশুপাখি পর্যন্ত নেই। বঙ্গভবন থেকে মুহূর্তেই কাকরাইল মসজিদের পাশে চলে আসি। তখন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে বললাম এই অবস্থায় আপনি কেমন করে ক্যান্টনমেন্ট যাবেন। তিনি বললেন স্যার, আমাকে দয়া করে এখানে নামিয়ে দিয়ে আপনি মিন্টুরোডে ঢুকে যান। আমাকে এখানে নামিয়ে আপনি বাসায় চলে যান। বললাম কোন অবস্থাতেই এটা সম্ভব নয়। অর্ডার দিলাম গাড়ি ক্যান্টনমেন্ট যাবে। বললাম, ক্যান্টনমেন্টে বাসার সামনে তাকে নামিয়ে মিন্টুরোডে নিজের বাসায় ফিরব। সঙ্গে সঙ্গে আমার সিকিউরিটি ও সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে থাকা ওয়ারল্যাসগুলো সচল হয়ে উঠে। শুনতে পাচ্ছিলাম মেসেজ থ্রো হচ্ছে। বলা হচ্ছে মহামান্য রাষ্ট্রপতির মাননীয় উপদেষ্টা ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাচ্ছেন। গাড়ি শেরাটন হয়ে বাংলামোটর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। ওয়ারলেস মেসেজে তখন আওয়াজ আসছিল ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশপথে জাহাঙ্গীর গেটের সামনে রাখা সামরিক ট্যাংকগুলো সরানো হচ্ছে। জাহাঙ্গীর গেটের একপাশ মুহূর্তের মধ্যেই পরিষ্কার করা হলো। গাড়ি এই জায়গা অতিক্রম করার সময় গেটে কর্তব্যরত সেনাসদস্যরা স্যালুট করল। ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার বাসায় তাকে পৌঁছে দিই। তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমার গাড়ি আবার উল্টা দিকে মিন্টুরোডে রওনা দেয়। কারফিউ থাকায় দ্রুততম সময়ে আমি মিন্টুরোডের বাসায় পৌঁছাই। ততক্ষণে রাত পৌনে ৩টা।
আমার দেশ : আপনি বারবার এমএসপি আমিনুল করিমকে জরুরি অবস্থা জরির সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করছেন। আপনারা দুইজনই তো বঙ্গভবনে দায়িত্ব পালন করতেন। আপনারা দুইজন একে অপরের সহকর্মী। আপনার বিরুদ্ধে এমএসপি যাবেন কেন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : সেটার অনেক কারণ ছিল। সেনাপ্রধানের ক্যুর প্রধান হাতিয়ার ছিলেন এমএসপি মেজর জেনারেল আমিনুল করিম। ২৯ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর একজন উপদেষ্টার সাথে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডির বাসভবনে গিয়েছিলেন এমএসপি। অর্থাৎ ২৯ অক্টোবর শপথ নেয়া উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্যের সাথে। বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে বঙ্গভবনের প্রচেষ্টার পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে সব উপদেষ্টাকেও এগিয়ে আসার আহবান জানানো হয়েছিল। শেখ হাসিনার সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল উপদেষ্টা শফি সামির। উপদেষ্টা সিএম শফি সামি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন ১৪ দলীয় নেত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য উপদেষ্টা সিএম শফি সামির সাথে সামরিক ইউনিফর্ম লাগিয়ে মেজর জেনালের আমিনুল করিম সেদিন শেখ হাসিনার ধানমন্ডির বাসায় গিয়েছিলেন। আমরা তখন রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্যে নানা চেষ্টায় ব্যস্ত। উপদেষ্টা সিএম শফি সামিকে এগিয়ে দেয়ার কথা বলে অর্থাৎ বিষয়টি ফ্যাসিলেটেট করার কথা বলে সামরিক কোড অব কন্ডাক্ট ভঙ্গ করে আমিনুল করিম একেবারে শেখ হাসিনার সামনেই চলে যান। উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে কিছু কথা বলে তার আপন হওয়ার চেষ্টা করা। কিন্তু উপদেষ্টা সিএম শফি সামি এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকায় তার সেই লক্ষ্য ব্যর্থ হয়।
আমার দেশ : আপনি কিভাবে বুঝলেন এমএসপি গিয়েছিলেন শেখ হাসিনাকে কিছু কথা বলতে এবং আপন হতে? আপনার সেই ধারণা সঠিক না-ও হতে পারে!
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : তাহলে আরো কিছু কথা বলতে হয়। এতেই পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। এই ঘটনার কয়েকদিন পরই বঙ্গভবনের উদ্যোগে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। অর্থাৎ উপরে যে ঘটনাটি বললাম। নিয়মানুযায়ী প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের সামনে গাড়ি পৌঁছালে এমএসপি রিসিভ করেন। সেই দিন সুযোগটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন এমএসপি আমিনুল করিম। গাড়ি বারান্দায় শেখ হাসিনাকে রিসিভ করে রাষ্ট্রপতির রুমের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়ি বারান্দা থেকে রাষ্ট্রপতির রুমে যাওয়ার পথে এমএসপি শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেন. ‘আপা আমি শেখ কামালের কোর্সমেট।’ তার কথা শুনে মাথা নাড়েন শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতির রুমে পৌঁছার আগে সিঁড়িতে আমি তাকে রিসিভ করি। তখন উপরে উঠে আসার সময় আমাকে উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘শুনলেন, আপনাদের বেঈমান এমএসপি আমাকে কী বলল’। জবাবে বললাম, আমরা জানতাম সময়মত এমএসপি এই বক্তব্য নিয়ে আপনার সামনে হাজির হবেন।
আমার দেশ : সরকার পরিবর্তনের আগে অর্থাৎ চারদলীয় জোট সরকার থাকার সময় এমএসপির ভূমিকা নিয়ে কোন রিপোর্ট করেননি?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : অবশ্যই বলেছি। যাদেরকে বলেছিলাম তাদেরকে বিশ্বাস করাতে পারিনি। উল্টো আমাদের মধ্যকার একটি গ্রুপ বিভিন্ন সময়ে আমার বিরুদ্ধে এবং এমএসপি’র পক্ষে অপপ্রচার তথা বিভ্রান্তিজনক প্রচার চালিয়েছেন।
আমার দেশ : এমএসপি যখন শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেন তখনতো প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। তখনো জরুরি অবস্থা জারি হয়নি। তখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কেন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : এমএসপি সবার সামনে জোর গলায় বলেই সেদিন সিএম শফি সামীর সাথে শেখ হাসিনার কাছে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার সাথে উপদেষ্টা শফিক সামি বৈঠক করে বঙ্গভবনে ফিরে আসার পর রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এবং উপদেষ্টাবৃন্দ এমএসপির কাছে জানতে চেয়েছিলেন কেন সেনাবাহিনীর পোশাকে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের বাসায় গিয়েছিলেন। তখন এমএসপি একটু বিব্রতবোধ করেছিলেন। শফি সামি বলেন, আমি তাকে নিইনি। তিনি সেখানে গিয়ে বঙ্গভবনের দোহাই দিয়েছেন। শেখ হাসিনাও বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। বেগম জিয়াও এ ব্যাপারে আমাদের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, সেনাবাহিনীর পোশাক পরে এমএসপি কেন সুধাসদনে গিয়েছিলেন। আসলে এমএসপি জানতেন জেনারেল মইনের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে যদি সেনাবাহিনী পুরোপুরি ক্ষমতা দখল করতে না পারে তাহলে তাদের বিকল্প চয়েস ছিল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য সুধাসদনে গিয়েছিলেন। এই ঘটনা সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এমএসপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক রিপোর্ট প্রদান করে।
আমার দেশ : তখন কি শুধু বঙ্গভবনেই এ ধরনের লোক ছিলো না কি সেনাবাহিনীর আরো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এমএসপি’র মত শেখ কামালের কোর্সমেটরা ছিলেন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ক্যুর ঘটনায় বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে অংশ নিয়েছেন। অথবা নিতে বাধ্য হয়েছেন। একদিন সকাল বেলা শেখ হাসিনা আমাকে ফোন করলেন। বললেন, আপনার সাথে কাজ করা সম্ভব নয়। সঙ্কট সমাধান হবে না। বললাম কেন? জবাবে বললেন, গত রাতে আপনি বেগম জিয়ার সাথে গোপনে বৈঠক করেছেন। বললাম, কোন বৈঠকই করিনি। এমনকি গত রাতে তার সাথে আমার কোনো কথাও হয়নি। তিনি বললেন চ্যালেঞ্জ। আমিও বললাম চ্যালেঞ্জ। বললেন, এর প্রমাণ আপনাকেই করতে হবে। বললাম, প্রমাণ করতে পারলে সঙ্কট সমাধানের কাজ চলবে তো! তিনিও বললেন চলবে। প্রমাণ করুন আগে। শেখ হাসিনার সাথে নাস্তার টেবিলে বসা মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী (অব) ওই সময় একই ফোনে আমাকে বললেন আপাকে এই কথা আমাদের সামনেই জানানো হয়েছে। আমি বললাম, আই উইল গ্যাট ব্যাক টু ইউ স্যুন।
আমার দেশ : আপনি কি প্রমাণ করতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : সেটাই বলতে চাচ্ছি আমি। তাদের সাথে কথা শেষ করেই তৎক্ষণাৎ রেডফোনে সংশ্লিষ্ট একজন জেনারেলের সাথে কথা বললাম। তিনি বললেন, স্যার প্রতিদিন আমি আপনাকে কতবার ফোন করি। আর আপনি কিনা আজ নিজেই এই সাত সকালে আমাকে ফোন দিলেন। নিশ্চয়ই কোন জরুরি খবর আছে। সেটা কি? আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, আচ্ছা বলুনতো আমি নাকি গত রাতে বেগম জিয়ার সাথে গোপন বৈঠক করেছি। তার সাফ জবাব-স্যার, দুই নেত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার। একটি সুই বা পিঁপড়া ঢুকলেও আমার বাহিনীর মাধ্যমে সার্ভিলেন্সের ভেতরে দিয়ে দুই নেত্রীর কাছে যেতে হয়। স্যার আপনাকে আমি কনফার্ম করতে পারি গত রাতে আপনি বেগম জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেননি। কিন্তু দয়া করে স্যার বলবেন কি, এই কথা কে বলেছেন আপনাকে? তিনি বারবার আমার কাছে অনুরোধ করতে থাকলেন। অনুরোধের এক পর্যায়ে জবাবে বললাম শেখ হাসিনা। শুনে একটু হতভম্ভ হলেন তিনি। ক্ষণিকের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন স্যার, আমার রেফারেন্স দিয়ে বলতে পারেন বেগম জিয়ার সাথে আপনি দেখা করেননি।
আমার দেশ : শেষ পর্যন্ত আপনার চ্যালেঞ্জের কী হয়েছিল?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : রেডফোনটি রেখেই আমি শেখ হাসিনাকে কল ব্যাক করলাম। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আশা করেননি এত দ্রুত সময়ে তাকে রিটার্ন কলটি করব। তিনি বললেন আপনার সাক্ষীটা কে? জবাবে বললাম, আপনারা ২ নেত্রীর সিকিউরিটির দায়িত্বে যিনি রয়েছেন সেই জেনারেল। অর্থাৎ এসএসএফ। শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বললেন, জেনারেল রুমী! আমার উত্তর ‘জি’। আবার বললেন-সাদাটা, নাকি কালোটা? বললাম প্রথমজন। (এখানে একটু বলে রাখতে চাই তখন দুই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা অর্থাৎ এসএসএফ এবং ডিজিএফআই ডিজির নামের শেষে রুমী ছিল। দুইজনই বিএনপি’র নেতৃত্বে চারদলীয় জোটের আমলে পদায়ন হয়েছিলেন।) আমার কথা শুনে শেখ হাসিনা হা হা করে হাসতে থাকলেন। বললেন, সে-ই তো আমাকে বলেছে।
তাহলে বুঝেন বেগম জিয়া কাদের ওপর ভরসা করেছেন! শেখ হাসিনা একই সাথে আমাকে বললেন, দেখবেন ক্ষমতায় গেলে আমি প্রথমেই এই দুইজনের চাকরি খাবো। অবশ্য তিনি তাই করেছিলেন। এসএসএফের ডিজি মেজর জেনারেল সৈয়দ ফাতেমী আহমদ রুমী আগাগোড়াই সুন্দর কথা বলতেন। আর বলতেন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনতে পারবেন না। পরবর্তীতে জরুরি অবস্থা জারির পর মইন ইউ আহমদ ইন্ডিয়া সফরে গিয়েছিলেন। যেই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব হরণের প্রতীক হিসেবে মইন ইউ আহমদকে ৬টি ঘোড়া উপহার দেয়া হয়েছিল। সেনাপ্রধানের এই সফরে এসএসএফ ডিজি ফাতেমী আহমদ রুমিকে সফর সঙ্গী করা হয়েছিল। এতেই অনুমান করা যায় চারদলীয় জোট সরকারের আমলে শেখ কামালের কোর্সমেটদের মত লোকেরা বঙ্গভবন এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন হয়েছিলেন কিনা।
আমার দেশ : আচ্ছা এরশাদকে নিয়ে তখন একটা গেম হয়েছিল। এ ব্যাপারে আপনার কোনো ধারণা আছে কি?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : এরশাদ কিন্তু প্রথম চারদলীয় জোটের পক্ষে ছিলেন। সবার মনে আছে নিশ্চয়ই ২৮ অক্টোবর থেকে দেশে একটি অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। বিচারপতি কে এম হাসান দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করলে এই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। তখন কে হবেন প্রধান উপদেষ্টা এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। সংবিধানের তৎকালীন বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই প্রথম অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তবে রাজনীতির মাঠে অনেক গেম হয়েছে তখন। তারপরও এরশাদ যখন নির্বাচনে আসতে সম্মতি জানাল তখন একটি গ্রুপ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরশাদকে নির্বাচনপ্রক্রিয়া থেকে সরানোর জন্য জোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হন তারা। এরশাদের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার পর সেনাবাহিনীর ওই গ্রুপটাই তার পক্ষ নিয়ে বলতে লাগলেন এটা মানা যায় না। বিএনপির একজন নেতার নাম উল্লেখ করে তারা প্রচার চালাতে লাগলেন ডাকাতকে ইলেকশন করতে দেয়া হবে আর চোরকে করতে দেয়া হবে না, এটা মানা যায় না। এটা আমাদের আর্মির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। অথচ আর্মির গুটি কয়েক পদস্থ অফিসারই এরশাদের মনোনয়ন বাতিলের পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
আমার দেশ : আপনি তৎকালীন মেজর জেনারেল সৈয়দ ফাতেমী আহমদ রুমীর কথা বলছিলেন। শেখ হাসিনার সাথে তার যোগাযোগের একটি উদাহরণও দিয়েছেন। মেজর জেনারেল আমিনুল করিমের বিষয়েও একটি ঘটনা বলেছেন। আপনি কি মনে করেন তারা সকলেই একজোট ছিল?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : দেখেন চারদলীয় জোট সরকারের সময় অমিনুল করিমের তৎপরতা কিছুটা সন্দেহজনক ছিল। তাই তাকে বঙ্গভবন থেকে সরিয়ে অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের পদ থেকে অন্য জায়গায় বদলির একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তার স্থলে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ২৪ পদতিক ডিভিশনের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল এম এ মুবিনকে এমএসপি পদে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া হয়। এক রাতে বিষয়টি আলোচনার পরই সকালে বঙ্গভবনে রেডফোনে আমার সাথে কথা বলেন জেনারেল সৈয়দ ফাতেমী আহমদ রুমী। তিনি বললেন স্যার, আমিনুল করিম স্যারকে সরাবেন না প্লিজ। এই আলোচনার কথা জেনারেল রুমীর জানার কথা ছিল না। তার এই রিক্যুয়েস্ট শুনে আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম। আমিনুল করিম আর্মিতে সৈয়দ ফাতেমী আহমদ রুমীর ৬ মাসের সিনিয়র ছিলেন। আগেই বলেছি ফাতেমী আহমদ রুমী ছিলেন তখন এসএসএফ-এর ডিজি। যার দায়িত্ব ছিল প্রধানমন্ত্রীর সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
আমার দেশ : সৈয়দ ফাতেমী আহমদ রুমী কি তাহলে ১১ জানুয়ারির ক্যুর সময় মইন ইউ আহমদের সাথে উপস্থিত ছিলেন?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির আগে দুপুরে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সভাপতিত্বে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের মিটিং চলছিল। ওই মিটিংয়ে ফাতেমী আহমদ রুমীও উপস্থিত ছিলেন। কারণ তখন দুই নেত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তার। ওই মিটিংয়ের পর তিনি জেনারেল মইনের সাথে যোগ দেন। রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগে এবং জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য করানোর সময় মইনের সাথে তিনিও সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। জরুরি অবস্থা জারির পর সেনাবাহিনীর কতিপয় অফিসার বলছিলেন পিজির-এর বাধার মুখে এমএসপি এবং এসএসএফ-এর ভূমিকার কারণেই সেনাপ্রধান ক্ষমতা দখলে সফল হয়েছিলেন।
আমার দেশ : ১/১১-এর সময় সেনাবাহিনীর মেরুকরণটা তাহলে কী ছিল?
মোখসেুর রহমান চৌধুরী : সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদের গ্রুপে সরাসরি ছিলেন এমএসপি, ডিজিএফআই, এসএসএফ চিফ। এনএসআই-এর ডিজি তাদের পক্ষে ছিলেন না। তাই তারা এনএসআই-এর ডিজির বিরুদ্ধে লেগেছিলেন। প্রায়ই তারা এমএসপির রুমে বসে এনএসআই-এর ডিজির বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলতেন। কখনো কখনো এনএসআই-এর ডিজির উপস্থিতিতেও তাকে আক্রমণ করে কথা বলতে শোনা গেছে। এমনো সময় গেছে তারা এনএসআই-এর ডিজিকে রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট পেশ করতে বাধা দিতেন। তাদের বাধার মুখে হতাশ হয়ে তিনি আমার সহযোগিতা চাইতেন। এমনো ঘটনা দেখা গেছে এমএসপি, এসএসএফ-এর ডিজি এবং ডিজিএফআই-এর ডিজিকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনের অফিস থেকে রাষ্ট্রপতিকে বাসভবনে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেন। যাতে এনএসআই-এর ডিজি রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করে রিপোর্ট পেশ করতে না পারেন। তখন বাধ্য হয়ে এনএসআই ডিজি আমার হস্তক্ষেপ সহযোগিতা চাইতেন। বলতাম দুই গোয়েন্দা সংস্থার অর্থাৎ ডিজিএফআই এবং এনএসআই-এর মধ্যে একজন রিপোর্ট পেশ করেছেন। আরেকজনকেও রিপোর্ট পেশ করার সুযোগ করে দিতে হবে। তারপর এনএসআই-এর ডিজিকে রাষ্ট্রপতির রুমে পাঠাতাম। এতেই বোঝা যায় মেরুকরণটা কেমন ছিল।
আমার দেশ : ১/১১-এর পর ডিজিএফআই এবং এসএসএফ ডিজির কোনো প্রমোশন হয়েছিল কি?
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী : জেনারেল মইন জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে ক্ষমতা দখলের পর তাদের অবস্থান ওপরে ওঠেনি। ডিজিএফআই-এর ডিজি মেজর জেনারেল মুহাম্মদ সাদিক হাসান রুমীকে আনসার ভিডিপির মহাপরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়। এসএসএফ-এর ডিজি সৈয়দ ফাতেমী আহমদ রুমীকে বদলি করা হয় রংপুর ডিভিশনের জেনারেল কমান্ডিং অফিসার (জিওসি) হিসেবে। এ সময় সেনাপ্রধান তিনবার রংপুর সফর করেন। রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল তখন।
কাদের গনি চৌধুরী

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ