দ্রুত ফিরে আসার প্রত্যাশায়

মতিউর রহমান চৌধুরী

মনটা খারাপ। বড্ড খারাপ। এমনিতেই আট মাস ধরে ঘরে বন্দি। অফিসে যেতে পারি না। সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা হয় না। প্রতি মুহূর্তে নানা খবর আসে। মন ভালো থাকার কোনো সংবাদ নেই। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই।

একমাত্র সন্তান তার সঙ্গেও এক বছর হয়ে গেল দেখা নেই। স্কাইপে কথা বলে মন ভরে না। শান্তি পাই না। কি খায়, না খায়!  সেও ১০ মাস ধরে বিলেতে একঘরে আটকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাস নেয়াও এখন বন্ধ। তাকে নিয়ে আমরা দু’জন বিচলিত থাকি সব সময়। এক অজানা, অচেনা ভাইরাস তামাম দুনিয়াকে কাবু করেছে। গোটা পৃথিবী এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে। এ নিয়েই আমরা বেঁচে আছি। আরো কতদিন থাকতে হবে তা কে জানে। ভ্যাকসিন এসে সব পাল্টে দেবে- এমন নিশ্চয়তাও নেই। যাইহোক মনে হচ্ছে, এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। আসলে এসব নিয়ে ভেবে আর কোনো লাভ নেই। শুরুতে বলেছিলাম মনটা খারাপ। আসলে আমার প্রিয় দুই সহকর্মীর খবরে সত্যি আমি আবেগ আপ্লুত। অন্তহীন দুশ্চিন্তায় জীবন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। মিজানুর রহমান খান ও পীর হাবিবুর রহমান। দুই পেশাদার সাংবাদিক। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই দুইজনের সঙ্গে কাজ করার। মিজান এসেছিল আগে। যোগ দিয়েছিল বাংলাবাজার পত্রিকায়। আমি তখন পত্রিকার সম্পাদক। অনেক দিন ছিল। চিফ রিপোর্টারের দায়িত্বও পালন করেছিল কিছুকাল। এ থেকেই ঘনিষ্ঠতা। আজ অব্দি অটুট। সহকর্মীর সম্পর্ক রূপ নিয়েছে পারিবারিক বন্ধনে। মিজান প্রথম আলোর ডেপুটি এডিটর। আপাদমস্তকে একজন নির্ভেজাল সাংবাদিক। দলের তকমা তার গায়ে লাগেনি কখনো। যা সত্য তা বলার চেষ্টা করে। মাঝে-মধ্যে বিপদও আসে। আইনের ছাত্র না হয়েও আইনবিশারদ হয়ে গেছে। প্রয়াত প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল আমাকে বলেছিলেন, ‘মিজান যা জানে, অনেক আইনবিদও তা জানেন না। তার কোনো জুড়ি নেই।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয় আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। গর্বে বুকটা ভরে যায়। টেলিভিশন টক শোতেও সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। চ্যানেল আই’র আজকের সংবাদপত্র অনুষ্ঠানে প্রথম যেদিন তাকে হাজির করেছিলাম, সে তখন কিছুটা নার্ভাস। কারণ আমার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অভয় দিয়ে বলেছিলাম, টেক ইট ইজি। শতভাগ সফল হলো প্রথম রাতেই। দর্শকদের ফোন পেলাম অনেক। সবার প্রশ্ন-এই ভদ্রলোককে আনেন না কেন। এই মুহূর্তে মিজান অসুস্থ।

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। এখন নিবিড় পরিচর্যায় রয়েছে। সবাই জানেন আবেগ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। সেই আবেগ স্পর্শ করেছে আমাকেও। আবেগহীন মানুষের কাছে মানবিকতার কোনো মূল্য নেই।

আরেক সহকর্মী পীর হাবিবুর রহমান। বাংলাদেশ প্রতিদিনের কার্যনির্বাহী সম্পাদক। কোভিড নয়, তার শরীরে মরণব্যাধি ক্যান্সার ঢুকে পড়েছে। সে নিজেই খবরটা দিয়েছে কলাম লিখে। দুর্দান্ত সাহস বটে। লেখায়, বলায় তার মধ্যে ভিন্নতা খুঁজে পাইনি কখনো। এমনকি টেলিভিশন টক শোতেও। রিপোর্ট বা কলাম লেখায় সে আলাদা এক মানুষ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে যখন সুনামগঞ্জ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক তখনই একদিন বাংলাবাজারে এলো আমার সঙ্গে পরিচিত হতে। একথা, সেকথা বলার পর বললো, আমি সাংবাদিকতা করতে চাই। বললাম, খুব ভালো কথা। বার্তা সম্পাদককে ডেকে বললাম, ওর নাম পীর হাবিবুর রহমান। কাজ করতে চায় রিপোর্টিংয়ে। অল্পদিনের মধ্যেই সে তার যোগ্যতার প্রমাণ রাখলো। এরপর অনেক দিন হয়ে গেল। হাবিব অন্য পত্রিকায়। নতুন ধরনের কলাম লেখা শুরু করলো। রিপোর্টারদের সমস্যাটাই এখানে। একবার রিপোর্টার হয়ে গেলে কলামেও তার ছাপ থেকে যায়। আমি আজও মুক্ত হতে পারিনি। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক পীর হাবিবকে মূল্যায়ন করেছেন অন্যভাবে। তার কথা, ‘চরম সত্য যে কোনো মুহূর্তে অবলীলায় বলতে পারা পীর হাবিবের বড় গুণ। তার লেখার ভক্ত-পাঠকরা হয়তো স্বীকার করবেন যে, বাংলাবাজার পত্রিকা পর্ব থেকে, অর্থাৎ তার সাংবাদিকতার শুরু থেকে তিনি কোন পথে কীভাবে হাঁটবেন এটা তার কাছে পরিষ্কার ছিল। কি বলে শেষ করবো জানি না। মিজান-পীর হাবিবের জন্য আপনারা সবাই দোয়া করবেন। ওরা যেন আমাদের মধ্যে দ্রুত ফিরে আসে। এ জাতি-রাষ্ট্রের জন্য যা খুবই প্রয়োজন।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ